ফুটপাতের এই হাল! by মিঠুন চৌধুরী

বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত বন্দর নগর চট্টগ্রামের অধিকাংশ ফুটপাতই দখল হয়ে গেছে। নগরের ফুটপাতগুলোতে স্থায়ী-অস্থায়ী কাঠামো নির্মাণ করে ব্যবসা করছেন প্রায় ২০ হাজার হকার। নগরবাসীর চলাচলের জন্য তৈরি করা এসব ফুটপাতে এখন হাঁটা ছাড়া সব কাজই হয়।


নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ফুটপাত দখল করে কোথাও চলছে গাড়ি মেরামত কোথাও স্তূপ করে রাখা হয়েছে নির্মাণসামগ্রী। এ ছাড়া রাস্তার পাশঘেঁষে গড়ে ওঠা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য রাখছে ফুটপাতে। সকাল-বিকেল দুবেলা বিভিন্ন এলাকার ফুটপাতজুড়ে কাঁচাবাজারও বসছে।
এদিকে তৈরি পোশাক, জুতাসহ নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসেন বিপুলসংখ্যক হকার। কেউ কেউ ফুটপাতজুড়ে গড়ে তুলেছেন স্থায়ী অবকাঠামোও। তবে ফুটপাতে ব্যবসা করা অধিকাংশ হকার জানান, তাঁরা নিরুপায় হয়েই ফুটপাতে বসছেন। বিভিন্ন সময় তাঁদের পুনর্বাসনের আশ্বাস দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, আইনের প্রয়োগ না থাকায় নির্বিঘ্নে দখল হয়ে গেছে ফুটপাত। এতে নগরবাসী ফুটপাতে হাঁটার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে বন্দর নগরের সৌন্দর্যও। অন্যদিকে হকার নেতৃবৃন্দ দাবি করেন, পুনর্বাসন ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (সিসিসি) সূত্রে জানা গেছে, নগরে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার সড়কে ফুটপাত আছে। এসব ফুটপাতের বেশির ভাগই ছয় থেকে আট ফুট চওড়া। গত দুই দশক ধরে বিভিন্ন উপায়ে দখল হয়েছে নগরের ফুটপাতগুলো।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরের পুরোনো রেলস্টেশন থেকে নিউমার্কেট মোড় হয়ে তিন পোলের মাথা পর্যন্ত ফুটপাতের পুরোটাই হকারদের দখলে। স্থায়ীভাবে চৌকি বসিয়ে এখানে বিক্রি হয় পোশাক, জুতা, প্লাস্টিকপণ্য, বই, ঘড়ি, ফল ও সিডি। নিউমার্কেট মোড় থেকে সদরঘাটের দিকে যাওয়ার সময় সড়কের বাঁ পাশের ফুটপাতে রাখা আছে শত শত সাইকেল। সদরঘাট মোড় থেকে রাস্তার দুই পাশে কাঁচাবাজারে বেচাকেনা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত।
নগরের সিরাজউদ্দৌলা সড়ক, জামালখান সড়ক ও বউবাজার এলাকার ফুটপাতও চলে গেছে কাঁচাবাজারের দখলে। এর মধ্যে কোনো ফুটপাত শুধু সকালে কোনোটি সারা দিন বাজার হিসেবে ব্যবহূত হয়।
চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদের ফুটপাতগুলোতেও হকারদের রাজত্ব। হরেক রকম দেশি-বিদেশি জুতা আর পোশাক বিক্রি হয় এখানে। বিমানবন্দর সড়কের বন্দরটিলা থেকে সিইপিজেড পর্যন্ত অংশও চলে গেছে হকারদের দখলে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানে প্রায় চার শ দোকান আছে।
গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিপরীত পাশের ফুটপাতে দেখা যায় ‘চট্টগ্রাম হকার্স লীগ’ নামের একটি ব্যানার ঝোলানো। সেখানে কয়েকজন ক্যারাম খেলছিলেন। ফুটপাতজুড়ে রাখা হয়েছে খাটসহ বিভিন্ন ধরনের আসবাব। গত এপ্রিলে জব্বারের বলীখেলায় আনা এসব আসবাব এখনো রাখা আছে ফুটপাতে। চকবাজারের প্যারেড ময়দানসংলগ্ন ফুটপাতে চলে নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসা।
এসব ফুটপাত ছাড়াও নগরের বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার থেকে বহদ্দারহাট মোড় হয়ে বহদ্দার বাড়ির মসজিদ পর্যন্ত ফুটপাতের একাংশ, মুরাদপুর মোড়, ষোলশহর ২ নম্বর গেট, বিপ্লব উদ্যানসংলগ্ন ফুটপাত, নাসিরাবাদ থেকে জিইসি মোড় পর্যন্ত ফুটপাতের এক পাশ, সাগরিকা মোড়, নিমতলা মোড়, ছোটপোল এলাকা, স্টিল মিল, বিআরটিসি মোড়, কোতোয়ালি মোড়, কর্ণফুলী তৃতীয় সেতুসংলগ্ন এলাকার ফুটপাতও বেদখল হয়ে গেছে।
নগরের এসব ফুটপাতের হকারদের নিয়ন্ত্রণকারী সংগঠন হলো চট্টগ্রাম সম্মিলিত হকার ফেডারেশন। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে হকারদের আরও চারটি সংগঠন আছে। ফেডারেশনের হিসাব মতে, নগরে মোট হকারের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এর সঙ্গে ফলের মৌসুমে যোগ হয় আরও কয়েক হাজার হকার।
এ বিষয়ে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকাররাই কর্মসংস্থানের অভাবে হকার হন। ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ পুনর্বাসনের আশ্বাস দিলেও কিছুই হয়নি। গত মাসেও পুনর্বাসনের জন্য জাম্বুরি মাঠ ও সিনেমা প্যালেসসংলগ্ন পাহাড় এ দুটি স্থানের নাম প্রস্তাব করে সরকারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। সরকার চাইলে এলাকাভিত্তিক পুনর্বাসনও করতে পারে।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে মাসুদ রানা বলেন, ‘আমরা চাই ফুটপাতে মানুষ চলাচল করুক। কিন্তু হকারেরা নিরুপায়।’ তবে ফুটপাতের ব্যবসাকে ঘিরে কোনো ধরনের চাঁদাবাজি হয় না বলে দাবি করেন তিনি।
চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার হোসেন মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনের কঠোর প্রয়োগ থাকলে ফুটপাত দখল হতো না। নিউমার্কেট মোড় একসময় চট্টগ্রামের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে পরিচিত ছিল। এখন সেখানে দাঁড়ানোর সুযোগও নেই।’
নগরের যানজটের অন্যতম কারণ ফুটপাত দখল উল্লেখ করে দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘পথচারীরা বাধাহীনভাবে হাঁটার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। লোকজন রাস্তার মাঝ দিয়ে হাঁটাচলা করে। এখন সমস্যা এমন রূপ নিয়েছে যে সবাইকে পুনর্বাসনের আর্থিক সামর্থ্য হয়তো সরকারেরও নেই।’
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোশতাক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সড়কে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে তা আমরা সরিয়ে দিই। তবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে হকারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা জরুরি।’

No comments

Powered by Blogger.