মৈত্রী এক্সপ্রেস-একজন জনপ্রতিনিধির ভ্রমণ অভিজ্ঞতা by মোঃ শাহ আলম

চমৎকার এ ট্রেনটিকে সচল করে 'যাত্রীবান্ধব' করা কোনো কঠিন কাজ বলে মনে হয় না, প্রয়োজন উদ্যোগের। টিকিট বিক্রির জন্য পাসপোর্ট-ভিসার বাধ্যবাধকতা না থাকলে ক্ষতি কী? কোনো যাত্রী যদি টিকিট ক্রয়ের পর ভিসা জটিলতায় না যেতে পারে, তাতে রেলওয়ের কোনো ক্ষতি হবে কি?


অত্যাধুনিক ট্রেনে চড়ে এখন বার্লিন থেকে মস্কো কিংবা লন্ডন থেকে লিসবন প্রাত্যহিক যাতায়াত করে ইউরোপবাসী। টিকিট কাটে 'এসএমএস' কিংবা 'অনলাইনে' যত্রতত্র অনেকটা মোবাইল রিচার্জের মতো। জেনে আনন্দিত হই, বিশ্বের অনেক আধুনিক শহরের মতো ঢাকার সঙ্গে কলকাতার ট্রেন চালু হবে সরাসরি, যা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ভারত-পাকিস্তান বৈরিতার কারণে। অবশেষে চালু হয় 'মৈত্রী এক্সপ্রেস' নামে ৮ এপ্রিল ২০০৮। অনেকবার ভারত যাতায়াত করেছি বিমান ও সড়কপথে। এবার আমার নিজ ও আত্মীয়ের পরিবার সিদ্ধান্ত নিই ট্রেনে ভারত গমনের। ট্রেন ছাড়ে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে। বুকিং দিতে গিয়ে জানা গেল, 'আগাম বুকিং দেওয়ার কোনো সিস্টেম নেই মৈত্রী এক্সপ্রেসে', টিকিট কাটতে হবে সরাসরি। তাও আবার ট্রেন ছেড়ে যাওয়া স্টেশন থেকে নয়, কাটতে হবে কমলাপুর থেকে। অনেক কষ্টে বিশাল কমলাপুরের এক কোণে খুঁজে পাওয়া গেল শিরোনামহীন 'আন্তর্জাতিক টিকিট কাউন্টার', যাতে টিকিট ক্রয়ের 'নিয়মাবলি' কম্পিউটারের যুগে 'কাঁচা হাতে' সাদা কাগজে লেখা। যার মোদ্দা কথা হচ্ছে, টিকিট ক্রয়ের জন্যে অবশ্যই আগাম প্রয়োজন 'ভারতীয় ভিসা'র। পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া কোনোভাবেই টিকিট ইস্যু করা সম্ভব নয় বলে জানালেন 'ইস্যু ক্লার্ক'।
যথাযথ ভিসাপ্রাপ্তির পর ৫ যাত্রীর টিকিট কাটা হলো উচ্চশ্রেণীতে এক হাজার ৯১০ টাকা হিসেবে প্রতিটি। সংসদ সদস্য হিসেবে অনুরোধ জানানো হলো, ভিসা ছাড়াই পাসপোর্ট নম্বরের ভিত্তিতে বাকি টিকিটটি ইস্যু করার জন্য, কারণ বাকি যাত্রীর ভারতীয় ভিসাটি পাওয়া যাবে যাত্রার আগের দিন। কিন্তু 'কঠোর আইনে'র কারণে কিছুতেই টিকিট ইস্যু করতে রাজি হলেন না ইস্যুক্লার্ক, যদিও ইস্যুকৃত টিকিটের কোথাও ভিসা নম্বর কিংবা এই সম্পর্কিত কোনো তথ্য নেই। যাত্রার আগের দিন বিকেল সাড়ে ৪টায় পাওয়া গেল ভিসাসহ পাসপোর্টটি। কিন্তু কমলাপুরের 'আন্তর্জাতিক টিকিট কাউন্টার' বন্ধ হওয়ার সময় হচ্ছে 'ঠিক বিকেল ৫টা'। যানজটপূর্ণ ঢাকায় গুলশান ভারতীয় দূতাবাস থেকে কমলাপুরে ৩০ মিনিটে পেঁৗছা সম্ভব নয়। আবার ৫টার পর কমলাপুর কিংবা যাত্রার প্রাক্কালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাৎক্ষণিক টিকিট ইস্যু করার কোনো ব্যবস্থাও রাখেননি রেল কর্তৃপক্ষ। অতএব একই পরিবারের ৬ যাত্রীর ৫ জন ট্রেনে উঠতে সমর্থ হলো, বাকি নারী যাত্রী রেল কর্তৃপক্ষের 'যাত্রী-অবান্ধব' নীতিমালার কারণে বাধ্য হয়ে বিমানে টিকিট কিনে 'আগাম' কলকাতা গিয়ে বসে রইল অতিরিক্ত টাকা খরচ করে।
সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে ট্রেনটি ছাড়ার কথা থাকলেও ৭টা ৪৫ মিনিটে যাত্রা আরম্ভ করল। কারণ হিসেবে জানা গেল, ৭টা ১৫ হচ্ছে কমলাপুরের টাইম, মানে ট্রেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ছাড়লেও সময় দেখানো হয়েছে কমলাপুর থেকে ছাড়ার। চমৎকার যুক্তি বটে! অবশেষে ২৩৬ আসনের ট্রেনটি মাত্র ৬৪ যাত্রী নিয়ে ১০ মে যাত্রা করল কলকাতার উদ্দেশে। দর্শনা পেঁৗছলে যাত্রীকে পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াও সঙ্গে থাকা সব মালপত্র নিয়ে নামতে হয় 'কাস্টম চেকিংয়ের' জন্য, যদিও ট্রেনে ওঠার আগেই সব যাত্রীর মালপত্র 'স্ক্যানিং' করে ট্রেনে তোলা হয়েছিল।
একজন বিমানযাত্রী বিমানবন্দরে তার মালপত্র 'স্ক্যানিং' করে বিমানে তোলার পর পুনরায় বিমানে কিংবা পরবর্তী কোনো স্টেশনে এভাবে আবার 'কাস্টম' চেকিংয়ের বিধান আমার জানা মতে বিশ্বে কোথাও নেই।
বাংলাদেশ পর্বের পর শুরু হয় দ্বিতীয় ভারত পর্ব। দুপুর ২টার ট্রেনটি 'গেদে' পেঁৗছলে সব যাত্রীকে মালপত্রসহ নামতে হয়। গেদেতে 'সফল ইমিগ্রেশন' সমাপ্তির পর সব যাত্রীকে 'পুলসিরাত'সম ভারতীয় কাস্টমের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়, জবাব দিতে হয় নানাবিধ প্রশ্নের। পরীক্ষা পাসের পর সব যাত্রীকে একটি কক্ষে 'যুক্তিহীন কারণে' কমপক্ষে ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় ট্রেনটি ছাড়ার 'টাইম' হওয়ার জন্য।
কলকাতা থেকে ১৮ মের ট্রেনে ঢাকা ফেরার টিকিট কাটতে যাই 'ফেয়ারলি প্লেসে' ৪ দিন আগেই। ৬টি ফর্ম পূরণ করে (এবার বর্ণিত বিমান যাত্রীসহ) যাত্রীর স্বাক্ষর হোটেল থেকে করিয়ে পাসপোর্টসহ জমা দিলে কাউন্টার থেকে জানানো হয়, টিকিট ক্রয়ের জন্য ৬ যাত্রীর সশরীরে উপস্থিতি কিংবা 'লেটার অব অথরিটি' লাগবে টিকিট কেনার জন্য, মানে কলকাতার আইন 'ঢাকার চেয়ে এক ডিগ্রি উপরে'। একটি কূপে ৬টি সিট থাকলেও, ৬টি সিট দেওয়া হয় দুটি কূপে কিন্তু ঢাকা থেকে ভাড়া এক হাজার ৯১০ টাকা হলেও ভারতীয় মুদ্রায় ভাড়া নেওয়া হয় ৮৬৮ টাকা, যা বাংলাদেশি প্রায় ১১০০ টাকার সমান। একই ট্রেনে ২ দেশে ২ রকম ভাড়া যাত্রীদের বিস্মিত করে! ৭টা ১০ মিনিটে 'ডিপারচার' টাইম থাকাতে ৬টা ৩০ মিনিটে কলকাতা স্টেশনে প্রবেশ করে খোঁজ নিলে স্টেশনে দাঁড়ানো কর্মকর্তারা ট্রেনকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন প্রায় ১ কি.মি. দূরে, যদিও প্রবেশমুখের কাছেই প্লাটফর্ম খালি। যাত্রীরা তাদের ভারী লাগেজপত্র টানতে টানতে হেঁটে চলেন দূরের ঢাকাগামী ট্রেনের উদ্দেশে। বিদেশিসহ স্বদেশী যাত্রীরা যথারীতি 'স্ক্যানিং' ও সিকিউরিটি চেকের পর মালপত্রসহ ট্রেনে ওঠার পর বিরক্তিকর 'গেদে' নামের পরীক্ষায়। আমার মেয়ে প্রাগুক্তের বর্ণনানুসারে বিমানে গিয়ে ট্রেনে আমাদের সহযাত্রী হওয়ায় 'গেদে'র ইমিগ্রেশন অফিসার এটিকে 'মারাত্মক অনিয়ম' হিসেবে গণ্য করলেন।
ট্রেনে কর্মরত স্টাফরা জানালেন, তাদের সমস্যা, হতাশা আর বৈষম্যের কথা। ট্রেনে কর্মরত যে ৩ জন বাংলাদেশিকে 'দয়া করে' কলকাতা পর্যন্ত ট্রেনের সঙ্গে যেতে দেওয়া হয়, তাদের ভারতে প্রবেশের জন্য 'আন্তর্জাতিক পাসে'র পরিবর্তে পাসপোর্টে লাগাতে হয় ১ বছরের 'মাল্টিপল ভিসা' সাধারণ যাত্রীর মতোই। তাছাড়া তাদের বিধি মোতাবেক বৈদেশিক ভাতার বদলে দেশের অভ্যন্তরে কর্মরতদের মতো নামমাত্র ভাতা প্রদান করা হয়, যদিও তাদের থাকতে হয় বিদেশে এবং খেতে হয় সেখানের খাবার নিজ খরচে।
চমৎকার এ ট্রেনটিকে সচল করে 'যাত্রীবান্ধব' করা কোনো কঠিন কাজ বলে মনে হয় না, প্রয়োজন উদ্যোগের। টিকিট বিক্রির জন্য পাসপোর্ট-ভিসার বাধ্যবাধকতা না থাকলে ক্ষতি কী? কোনো যাত্রী যদি টিকিট ক্রয়ের পর ভিসা জটিলতায় না যেতে পারে, তাতে রেলওয়ের কোনো ক্ষতি হবে কি? এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট টাকা কেটে রেখে বাকি টাকা ফেরত দিলেই আগাম টিকিট দেওয়ার যৌক্তিকতা থাকে। তাছাড়া 'ওপেন টিকিট' কিংবা যাত্রার আগ মুহূর্তে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে তাৎক্ষণিক টিকিট ইস্যু করা কি খুব কঠিন কাজ? স্ক্যানিং করে মালপত্র তোলার পর তা চেকিংয়ের নামে পুনরায় দর্শনা বা গেদেতে নামানোর যৌক্তিকতা কী? প্রয়োজনে বিমানের মতো যাত্রীদের 'লাগেজ' টোকেন দিয়ে আলাদা করে 'গুডস ভ্যানে' রাখা যেতে পারে। আর ইচ্ছা থাকলেও সহজেই হতে পারে ট্রেনের ভেতরে 'চলমান ইমিগ্রেশন' ও চেকিং। আর ইমিগ্রেশন যেহেতু বাংলাদেশে ও ভারতের শেষ স্টেশন তথা দর্শনা ও গেদেতে হচ্ছে, তবে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল, ঈশ্বরদী থেকে যাত্রী উঠলে কিংবা টাঙ্গাইল-ঈশ্বরদীর যাত্রীকে ঢাকার স্টেশনে টেনে এনে আবার ঈশ্বরদী পাঠানো কোন যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য? ট্রেনটিতে কলকাতা পর্যন্ত যাতায়াতকারী বাংলাদেশি স্টাফদের সংখ্যা ভারতীয় রীতি অনুসারে ৬ জনে উন্নীত এবং তাদের রীতি অনুসারে বৈদেশিক ভাতা প্রদান যুক্তিযুক্ত। গেদেতে ইমিগ্রেশন কাস্টম সম্পন্ন হওয়ার পরও ২ ঘণ্টা যাত্রীকে বসিয়ে রাখাটা কার স্বার্থে? উপযুক্ত কার্যক্রম গ্রহণ করলে 'মৈত্রী' ট্রেনটি প্রকৃতই 'এক্সপ্রেস' ট্রেনে পরিণত হবে, অন্যথায় যাত্রী সংকটে একদিন হয়তো ট্রেনটি বন্ধও হয়ে যেতে পারে বর্ণিত 'জটিলতর' যাত্রী-অবান্ধব আইন-কানুনের কারণে।

অধ্যক্ষ মোঃ শাহ আলম : সংসদ সদস্য পিরোজপুর-২
 

No comments

Powered by Blogger.