গোলটেবিল বৈঠক-‘অতিদারিদ্র্য নিরসন: সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি’

২০ জুন ২০১২ প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘অতিদারিদ্র্য নিরসন: সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সহযোগিতায়ছিল ‘ব্র্যাক অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ’। এতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো।


যাঁরা অংশ নিলেন
রাশেদা কে চৌধূরী
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন
সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
হোসেন জিল্লুর রহমান
নির্বাহী পরিচালক, পিপিআরসি
এ কে এম নূর-উন-নবী
অধ্যাপক, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মাহবুব হোসেন
নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক
বিনায়ক সেন
গবেষণা পরিচালক, বিআইডিএস
মোয়াজ্জেম হোসেন
সম্পাদক, দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস
আখতার আহমেদ
চিফ অব পার্টি, বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি সাপোর্ট প্রোগ্রাম, ইফপ্রি
শীপা হাফিজা
পরিচালক, জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি, ব্র্যাক
আনিসুল হক
উপসম্পাদক, প্রথম আলো
মতিউর রহমান
সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা
মতিউর রহমান
বিভিন্ন সামাজিক বিষয় নিয়ে আমরা এ ধরনের আয়োজন করে থাকি। অতিদারিদ্র্য নিরসন নিয়ে আজকের আলোচনা। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে সব ধরনের দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে আসতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি দারিদ্র্য নিরসনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। দারিদ্র্য নিরসনের বিভিন্ন উপায় যেন এই আলোচনা থেকে উঠে আসে। সে উদ্দেশ্যেই আজকের এই আয়োজন। আপনারা অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও আলোচনায় অংশগ্রহণ করছেন। এ জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আব্দুল কাইয়ুম
দেশের ৩১ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ২০১৫ সালের মধ্যে তা ২৯ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। অতিদারিদ্র্য নিরসন কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকলে দারিদ্র্যের হারের লক্ষ্যমাত্রা ২৯ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব। দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের ৯০টি কার্যক্রম আছে। এগুলোর ক্ষেত্রে সঠিক নীতিমালা নেই। সরকারের দিক থেকে দারিদ্র্য নিরসনে বড় বাধা হলো স্থানীয় সরকারের দুর্বলতা। আজ আমাদের আলোচনা থেকে এ বিষয়ের নানা দিক উঠে আসবে। প্রথমে আলোচনা করবেন রাশেদা কে চৌধূরী।

রাশেদা কে চৌধূরী
দেশে এখন ৩১ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ২০১৫ সালে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৯ শতাংশ। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কেন ১০ শতাংশ বা ১৫ শতাংশ নয়? অনেকে এ লক্ষ্যমাত্রাকে উচ্চাভিলাষী মনে করতে পারেন। শুধু দারিদ্র্য নিরসনের দিক থেকে দেখলে উচ্চাভিলাষী মনে হবে। কিন্তু সামাজিক ন্যায়বিচারের আলোকে দেখলে এই লক্ষ্যমাত্রাই সঠিক। এ ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে হবে। কর্মকাণ্ডকে আরও লক্ষ্যভিত্তিক করতে হবে। নীতি, পরিকল্পনা, কৌশল সবই আছে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাস্তবায়ন ও জবাবদিহি নিয়ে। এ জায়গায় আজ আমাদের সবাইকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষজ্ঞ আলোচকেরা নিশ্চয়ই এ বিষয় আলোচনা করবেন। তাঁদের আলোচনার নির্দেশনাগুলো আমাদের কাজের ক্ষেত্রকে ফলপ্রসূ করবে। দারিদ্র্য বিমোচনে দৃশ্যমান লক্ষ্য অর্জন করতে চাই। এ ক্ষেত্রে দারিদ্র্য নিরসনে গতানুগতিক চিন্তার বাইরে আসতে হবে এবং সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের ভাবনা থেকে বিষয়টিকে দেখতে হবে।
স্থানীয় সরকারকে এত দুর্বল করে রাখা হয়েছে যে দারিদ্র্য বিমোচনে এটা কোনো কাজ করছে না। যে কারণে উপবৃত্তি চালু হয়েছিল সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। মাতৃত্ব ভাতা বাড়ানো হয়েছে। দালালদের জন্য মায়েরা কতটুকু পাচ্ছে সেটি একটি প্রশ্ন। সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাবে অনেক দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি থমকে যাচ্ছে। কোনো কর্মসূচি টেকসই হচ্ছে না। আবার অনেক কর্মসূচি আছে প্রকল্পভিত্তিক। প্রকল্প শেষ হয়ে গেলে কর্মসূচি শেষ। প্রকল্প যাতে শেষ না হয়, সে বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
রাশেদা কে চৌধূরী সামাজিক ন্যায়বিচারের ওপর জোর দিয়েছেন। এবার বলবেন শীপা হাফিজা।

শীপা হাফিজা
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর মাধ্যমে অতিদরিদ্রদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার একটি প্রয়াস। সরকারও দারিদ্র্য বিমোচনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চায়। তাহলে দেখতে হবে আমরা কী অবস্থায় আছি। ২০০৫ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দারিদ্র্যের হার কিছুটা কমেছে। কিন্তু এই কমার হার আরও দ্রুতগতিতে হওয়া উচিত বলে মনে করি। ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্য কেন ১০ থেকে ১৫ শতাংশে নেমে আসবে না, সে প্রশ্ন আসছে। আমরাও চাই এটি ১০ থেকে ১৫ শতাংশে নেমে আসুক। ২০০২ সালে আমরা অতিদারিদ্র্য নিরসনের কর্মসূচি শুরু করেছিলাম। ২০০২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত চার লাখ নারী এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে কাজ করেছি। এই মানুষগুলো অতিদারিদ্র্য থেকে দারিদ্র্য পর্যায়ে উঠে এসেছে। এখন তারা বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সেবা গ্রহণ করতে পারছে। এদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমাদের বেশ অভিজ্ঞতা হয়েছে। অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে, শুধু পলিসি বা আইন করলে হবে না। মানুষ যাতে আইনটি গ্রহণ করে, সে ব্যাপারেও কাজ করতে হবে। এ জন্য আপনাদের মতো বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, আইনপ্রণেতা ও সাধারণ মানুষসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে আমরা এ রকম আলোচনা করি। তাদের চিন্তাভাবনা, দিকনির্দেশগুলো কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার চেষ্টা করি। আজও আমরা একই উদ্দেশ্যে আপনাদের সঙ্গে বসেছি। ২০১২ সালে আমরা একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে যাব। আজকের আলোচনায় সঠিক নীতিমালা না থাকার বিষয়টি এসেছে। কিন্তু নীতিমালা যেটুকু আছে তারও কোনো প্রয়োগ নেই। দুর্বল স্থানীয় সরকার। তার ওপর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব। ইত্যাদি নানাবিধ কারণে অতিদরিদ্রদের যে সুবিধা পাওয়ার কথা, সেটা তারা পাচ্ছে না। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, যে মানুষটিকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা হলো তিন বা চার বছর পর কী পরিবর্তন হলো সেটা দেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে বুঝতে পারছি না সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আসা অতিদরিদ্র মানুষগুলোর কী পরিবর্তন হচ্ছে। আজ আমাদের আলোচনার উদ্দেশ্য হলো, আপনাদের কাছ থেকে বাস্তবমুখী ও বাস্তবায়নযোগ্য যে পরামর্শগুলো বা দিকনির্দেশনা আসবে আমরা সেভাবে কাজ করব, যাতে অতিদারিদ্র্য নিরসনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়। সব ক্ষেত্রে আমরা এ রকমই আলোচনার আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকি।

হোসেন জিল্লুর রহমান
যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখি না কেন সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম অতিদারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। এখন বিশ্বব্যাপী এ বিষয়টি খুব গুরুত্ব পাচ্ছে। মূল আলোচনায় চলে এসেছে। সরকারের ৯০টি কর্মসূচির কথা আলোচনায় এসেছে। কিন্তু আমরা জানি না বিগত ৩০ বছর বাংলাদেশে কীভাবে কাজ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারতে প্রথমে সাংবিধানিক অধিকার দেওয়া হয়েছে। এখন খাদ্য পাওয়ার অধিকার বিল হচ্ছে। প্রথমে তারা ঠিক করেছে কী করতে হবে। তারপর বাস্তবায়নের দিকে গেছে। আমাদের সমস্যা তৈরি হওয়ার পর সমাধানের কথা ভাবা হয়েছে। যেমন বিধবারা একটা অংশ, তাঁদের জন্য বিধবাভাতা চালু করা হোক। অক্টোবর-নভেম্বরে কাজ থাকে না, এ জন্য একটা প্রকল্প চালু করা যাক। আমাদের কাজ হলো পরীক্ষামূলক। যা-ই করা হোক না কেন, প্রকল্প শেষে এর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ৯০টি কর্মসূচি আছে বটে কিন্তু ৯৭ শতাংশ বরাদ্দ আছে ৩০টিতে। ৩০টি কর্মসূচির ১০টির মধ্যে আছে আবার ৮০ শতাংশ বরাদ্দ। সার্বিক দারিদ্র্যমুক্তির জন্য ১০ শতাংশ কাজ হচ্ছে। ৮০ শতাংশ কাজ হচ্ছে খাদ্যসহায়তার জন্য। গত তিন-চার বছরে এটা ব্যাপক সম্প্রসারিত হয়েছে। খাদ্যসহায়তা দিয়ে মানুষ বাঁচানো যায়। কিন্তু তাকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করা যায় না।
অতিদারিদ্র্য নিরসনে এনজিওগুলোর কর্মসূচি আছে। সরকারেরও দু-একটি আছে। কিন্তু কর্মপরিকল্পনা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে না পারলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকলে এই দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হবে না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি, এটাও কিন্তু সব ক্ষেত্রে এক ধরনের নয়। যেমন বিধবা ও বয়স্কভাতা। কোনো বিধবা বা বয়স্ক ব্যক্তি যদি তাঁর নাম তালিকায় ওঠাতে চান তাহলে তাঁকে ঘুষ দিতে হবে। আবার কর্মসংস্থান প্রকল্পের তালিকায় অনেক ভুয়া নাম থাকে। কাজ করছে ৩০ জন, তালিকায় নাম আছে ৫০ জনের। এখানে ২০ জনের বেতন বেহাত হচ্ছে।
একটা সময় খাদ্যপ্রাপ্তিই ছিল বড় সমস্যা। এখন পুষ্টির সমস্যা হচ্ছে বড় সমস্যা। এবার অর্থমন্ত্রী বাজেটে বলেছেন, অভ্যন্তরীণ দুধের চাহিদার ২০ শতাংশ নিজস্ব উৎস থেকে আসে। ৫০ শতাংশের বেশি পরিবার নিয়মিত দুধ খেতে পারে না। পুষ্টির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ দুধ। দুধের অভাবে আমাদের সন্তানদের উচ্চতা বাড়ছে না। আমাদের কর্মসূচির মধ্যে পুষ্টিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
আমরা ১৯৯০ সালে একটা গবেষণা করেছিলাম, সেখানে দেখেছি দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়ে যায় অসুখজনিত কারণে। অনেক কষ্ট করে হয়তো একটু সচ্ছলতা এসেছে। কোনো একটা অসুখে সব টাকাপয়সা শেষ হয়ে গেছে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কাজ বাংলাদেশে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দিতে পারলে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারলে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মতো এটিও বাংলাদেশে অনুকরণীয় বিষয় (রোল মডেল) হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে।

আব্দুল কাইয়ুম
সরকারের দারিদ্র্য বিমোচনের ৯০টি কর্মসূচির মধ্যে ৩০টিতে বরাদ্দ ৯৭ শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে বাকি প্রকল্পগুলো থেমে আছে অথবা বন্ধ হয়েছে। তা হলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কীভাবে সম্ভব সেটি একটি বড় প্রশ্ন। এখন বলবেন বিনায়ক সেন।

বিনায়ক সেন
দারিদ্র্যের হার কমানোর ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর খুব বেশি ভূমিকা নেই। তবে এসব কর্মসূচির মাধ্যমে একটা কাজ হয়েছে, সেটা হলো দারিদ্র্যের তীব্রতা কমিয়ে আনা গেছে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কর্মসূচিগুলো অন্তত ক্ষুধা ও মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে পেরেছে। কিন্তু অধিকাংশ কর্মসূচিতেই দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার মতো কোনো মই নেই। যেমন, দুস্থ বিধবা কর্মসূচিতে মাসিক ভাতা হলো ৩০০ টাকা। এটা মাত্র এক দিনের কৃষি মজুরির সমান। এ রকম হারে ভাতা দেওয়াকে টোকেনিজম ছাড়া আর কী বলা যায়? ১৯৯০ থেকে ২০০০-এর দশক পর্যন্ত চরম দারিদ্র্য ও সহনীয় দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটেছে। কৃষি মজুরির দিকে তাকালেই বিষয়টি বোঝা যায়। ১৯৮৪ সালে খেতমজুর সমিতি ন্যূনতম তিন কেজি চাল কিনতে পারা যায়, এ রকম মজুরি পাওয়ার জন্য আন্দোলন করেছিল। আজকের এই চড়ামূল্যের বাজারেও একজন খেতমজুর তাঁর মজুরি দিয়ে প্রায় আট থেকে ১০ কেজি চাল কিনতে পারেন। তবে কৃষিমজুরি বৃদ্ধির পেছনে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ণ ও রেমিট্যান্স সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না বললেই চলে।
২০০০-এর দশকে এসে বাংলাদেশে নগরায়ণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ঢাকা শহরের ৪০ শতাংশ লোক বস্তিতে বসবাস করে। তাদের জন্য দারিদ্র্য দূরীকরণের কোনো কর্মসূচি নেই। এমনিতে সব ক্ষেত্রে চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ খুবই সীমিত। তার ওপর রয়েছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব। ২০০২-০৪ পর্বে সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কমিশনের সদস্য হিসেবে দুই বছর কাজ করেছি। এই কমিশনের প্রতিবেদন তৎকালীন সরকার গ্রহণ করেনি। কমিশনের একটা কাজ ছিল স্টাইপেন্ড স্কিমে কী দুর্নীতি হচ্ছে, সেটা দেখা। খুব আগ্রহের সঙ্গে ৩০টি স্কুলে এ কাজ করেছিলাম। সেখানে দেখলাম ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভুয়া শিক্ষার্থীর নাম রয়েছে। দুর্নীতি দূর করা না গেলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ফিরে না এলে, বরাদ্দ বাড়লেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না। সরকার সারা দেশে দরিদ্রদের কম্পিউটারাইজড তালিকা করতে চাইছে। শুধু তালিকা করে তেমন কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। কার্যকর তালিকা তৈরি করতে হলে কতগুলো পূর্বশর্ত পূরণ করা দরকার। যেমন, সবচেয়ে নিম্ন পর্যায়ের স্থানীয় সরকারকে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী করতে হবে। প্রতিবছর তথ্য হালনাগাদ করতে হবে। এ ব্যবস্থা না থাকলে শুধু এককালীন তথ্য তালিকা বা তথ্যভান্ডার দিয়ে কিছু হবে না।
পৃথিবীর অনেক দেশে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কার্যক্রম আছে। ইউরোপে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। গত এক দশকে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কাজের প্রসার ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। আমার একটি অভিযোগ হলো, এবারের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়েনি। বয়স্কভাতা আগে যা ছিল, এই বাজেটে তা-ই রাখা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা তাঁদের এলাকার বয়স্ক ব্যক্তিদের কোনো তালিকাই দিতে পারেন না। বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে কারা অপেক্ষমাণ, এ রকম কোনো তালিকাও তাঁদের কাছে নেই। চেয়ারম্যানরা বলেন, সরকার তো এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে না, তালিকা করে কী করব? সামাজিক নিরাপত্তা খাতের মাথাপিছু স্বল্প বরাদ্দের এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে সরকারি বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। বরাদ্দ বাড়াতে হলে ধনী শ্রেণীকে রিডিস্ট্রিবিউশন (পুনর্বণ্টন) ট্যাক্সের আওতায় আনতে হবে। যাঁদের সম্পদ দুই কোটি টাকার ওপরে, তাঁদের ওপর ১০ শতাংশ সারচার্জ ধরতে হবে। এই টাকা অতিদরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। এবার চার হাজার লোক সারচার্জ দিয়েছেন মাত্র ৫০ কোটি টাকা। আমার হিসাবমতে, ঢাকা শহরে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই লাখ মানুষের সারচার্জ দেওয়ার কথা। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ হবে ৫০০ কোটি টাকা। এই টাকা অতিদরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করার মাধ্যমে তাদের অবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব। পুনর্বণ্টনমূলক করব্যবস্থাকে গরিবমুখী করেই কেবল পুঁজিবাদকে মানবিক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করা যায়। দুঃখের বিষয়, আমরা বন্য পুঁজিবাদের পথে চলেছি, যেখানে দয়ামায়া নেই গরিব জনগোষ্ঠীর প্রতি। নইলে ঢাকা শহরে এখনো এত ক্ষুধার্ত, দুস্থ মানুষ ঘুরে বেড়ায়, ফুটপাতে মাথা গোঁজার চেষ্টা করে? এক লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ হলেও সেখানে তাদের জন্য একটি টাকাও বরাদ্দ করা হয় না।

আব্দুল কাইয়ুম
হোসেন জিল্লুর রহমান সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির বিভিন্ন দিক তুলে ধরলেন। এবার বলবেন মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন
নগরদরিদ্রদের বিষয়ে আমার মত হলো, নগরের দরিদ্ররা ইচ্ছা করে দরিদ্র হয়েছে। যেকোনো সময় গ্রামে শ্রমিকের মজুরি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। বিশেষ সময় যেমন ধান কাটার মৌসুমে ৪০০ টাকার ওপরে চলে যায়। অথচ তারা গ্রামে ফিরে না গিয়ে নগরের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। যদিও ঘরে ফেরা কর্মসূচি একটি বাড়ি একটি খামার সমালোচিত হচ্ছে। কিন্তু এটাই হলো সময়োপযোগী প্রকল্প। এটা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে শহরও বাঁচত, গ্রামও বাঁচত। আজ আমাদের দেশে নানা রকম চাপ আছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারের ওপর চাপ পড়ছে। আমার প্রশ্ন হলো, দেশের বিত্তবান ১০ শতাংশ মানুষের কাছে ৩৫ শতাংশ সম্পদ ও আয় রয়েছে। কেন গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে না।
দারিদ্র্য নিরসনের জন্য দরকার অংশগ্রহণ কর্মসূচি, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। শিক্ষা খাতে গত বছর বরাদ্দ ছিল ৮ দশমিক ১১ ভাগ। এবার প্রস্তাবিত হয়েছে ১১ দশমিক ৩ ভাগ। আমাদের দেশে দারিদ্র্য দূর করার দুটি পথ রয়েছে। এক. কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। দুই. কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষা চালু করা। এবং দরিদ্রদের এই শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা।
আমরা যে ৩১ শতাংশ দারিদ্র্য এবং ১৭ শতাংশ অতিদারিদ্র্যের কথা বলছি এর মধ্যে ডিজঅ্যাবিলিটি এবং অটিজম আছে। ২০০১ সালের গণনা অনুযায়ী, এ সংখ্যা ১৪ লাখ। বর্তমান গণনায় আমরা অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও এই প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বর্তমানে এদের সংখ্যা কত তার কোনো হিসাব নেই। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে ১০ শতাংশ মানুষ ডিজঅ্যাবিলিটি ও অটিজম। আমি মনে করি, গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজ সরকারের ওপর ডিজঅ্যাবল ও অটিজমের সঠিক সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করবে। তাদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
ফরাসউদ্দিন সাহেব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাঁর আলোচনায় এনেছেন, ১০ শতাংশ বিত্তবানের কাছে ৩৫ শতাংশ সম্পদ ও আয় আছে। দারিদ্র্য দূরীকরণে তাদের ওপর কোনো চাপ নেই। এবার শুনব মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছ থেকে।

মোয়াজ্জেম হোসেন
দারিদ্র্য বিমোচনে গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা আছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমরা যারা গণমাধ্যমে কাজ করি তারা ইস্যুগুলোকে সবাই একভাবে দেখি না। কেউ মনে করে বিষয়টি জরুরি। কেউ মনে করে এটার দরকার নেই। এসব কারণে সামগ্রিকভাবে বিষয়গুলো গণমাধ্যমে আসে না। ইস্যুগুলো যেভাবে আলোচনা হওয়া উচিত অনেক সময় সেভাবে আলোচনা হয় না। আমি বিশ্বাস করি না শুধু সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়ে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব। সামাজিক খাত যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যদি বরাদ্দ না বাড়ে এবং বরাদ্দকৃত অর্থ যদি দুর্নীতিমুক্তভাবে ব্যয় করার ব্যবস্থা না থাকে তাহলে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব নয়। একশ্রেণীর মানুষের জন্য হয়তো সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর প্রয়োজন আছে। তবে এই নিরাপত্তাবেষ্টনী দারিদ্র্য দূরীকরণের উপায় হতে পারে না। দারিদ্র্য দূরীকরণে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো বিমাও একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। কিন্তু দারিদ্র্য দূরীকরণে বিমাকে এখনো আমাদের দেশে কাজে লাগানো হচ্ছে না। সরকারের যে আয়-ব্যয়কাঠামো তাতে এই খাতের কলেবর কতটুকু বাড়ানো সম্ভব হবে, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। গণমাধ্যম এসব ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে পারে যদি বিষয়গুলো সেভাবে উপস্থাপন করা হয় এবং আমাদের মধ্যে যদি ভালো বোঝাপড়া থকে।

আখতার আহমেদ
আমি প্রবৃদ্ধি এবং নিরাপত্তাবেষ্টনীর বিষয়ে বলতে চাই। প্রথমত, প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে হবে। যাতে এটা পরবর্তী সময়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় যাতে দরিদ্রদের অংশগ্রহণ থাকে সে জন্য মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। মানবসম্পদের উন্নয়ন করতে হলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পুষ্টি দরকার। নিরাপত্তাবেষ্টনীকে টেকসই করতে হলে, মানবসম্পদ উন্নয়নমুখী নিরাপত্তাবেষ্টনী করতে হবে।
যারা প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না যেমন শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী; এদের জন্য আলাদা একধরনের নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করতে হবে।
আমাদের দেশে নিরাপত্তাবেষ্টনীগুলো টেকসই হয়নি। কিন্তু লাতিন আমেরিকার নিকারাগুয়া, ব্রাজিল, এলসালভাদর, মেক্সিকো ইত্যাদি দেশ সফল হয়েছে। তারা শর্ত সাপেক্ষে অর্থ ছাড় করেছে। সে দেশগুলোতে বলা হয়েছে, দিনের ৮০ শতাংশ সময় স্কুলে রাখলে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেওয়া হবে। অনুরূপভাবে নিয়মিত ক্লিনিকে গেলে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেওয়া হবে। এভাবে তারা শর্ত দিয়ে টাকা ছাড় করেছে, প্রতিটি কর্মসূচি সফলতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশেও ফুড ফর এডুকেশন নামে ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত একটি ভালো কর্মসূচি ছিল। এটা প্রাথমিক শিক্ষা খাতকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। একটা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৯০টি কর্মসূচির মধ্যে ৩০টি কর্মসূচিতে ৯৭ শতাংশ অর্থ ব্যয় হচ্ছে। অবশিষ্ট ৬০টি কর্মসূচিতে মাত্র ৩ শতাংশ অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আমার মত হচ্ছে, এই ৬০টি কর্মসূচি রাখার দরকার নেই। এগুলো কাগজে আছে, বাস্তবে নেই। কোনোটি না চলার মতো চলছে। কিছু ভালো যে কর্মসূচি আছে যেমন ভিজিডি ও ইজিপিপি। এগুলোর পরিধি বেশি না, ২ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত। অকার্যকর কর্মসূচির অর্থ এ খাতগুলোতে এনে কাজে লাগালে দরিদ্ররা বেশি উপকৃত হবে। এখন কর্মসূচিগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিয়ে অন্যদের মতো আমারও প্রশ্ন আছে।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে প্রয়োজন ভালো মূল্যায়ন। ভালো মূল্যায়নের কতগুলো পদ্ধতি রয়েছে। কোনো কর্মসূচি সমাজের ওপর প্রভাব ফেললেই সেটা ভালো নয়। লক্ষ্যটা অর্জিত হচ্ছে কি না, সেটি একটা বড় বিষয়। আমরা মাধ্যমিক পর্যায়ের নারীশিক্ষা কর্মসূচিতে দেখেছি, সেখানে দরিদ্রদের থেকে ধনীরাই বেশি সুবিধা পেয়েছে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। তাহলে অর্থ ব্যয় হলেও লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে কি না সেটা মূল্যায়নে দেখতে হবে। আবার অনেক কর্মসূচি আছে যেগুলো দুই থেকে তিন বছর পর শেষ হয়ে যায়। কোনো কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর এর আওতাধীন মানুষের অবস্থা কী তার কোনো খোঁজ নেওয়া হয় না। অর্থাৎ তারা কি আগের জায়গায় ফিরে গিয়েছে, না তাদের কিছুটা উন্নতি হয়েছে, সেটা মূল্যায়ন করতে হবে। একটা কর্মসূচিতে অতিদরিদ্রদের মূল্যায়ন করেছিলাম। সেখানে দেখেছিলাম তাদের উন্নয়ন টেকসই হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে অবশ্য দরিদ্রদের অর্থ না দিয়ে সম্পদ দেওয়া হয়েছিল। তাদের গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগিসহ বিভিন্ন সম্পদ দেওয়া হয়েছিল। সম্পদ দিলে, এগুলো পরবর্তী সময়ে আয় বৃদ্ধি করে। যেমন কারও একটা গরু থেকে বাড়তে বাড়তে তিন-চারটা গরু হলো। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য ভালো মূল্যায়ন খুবই প্রয়োজন।

আব্দুল কাইয়ুম
আখতার হোসেন সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কতকগুলো ধরন ও তাদের সুবিধা-অসুবিধা বললেন। প্রকল্প মূল্যায়নের কথাও বললেন। এবার বলবেন এ কে এম নূর-উন-নবী।

এ কে এম নূর-উন-নবী
মানুষকে কেন্দ্রীয়ভাবে দেখতে হবে, সবার ওপরে মানুষ। মানুষসহ যেকোনো ব্যাপারে কিছু করতে গেলে দরকার সঠিক তথ্যের। কিন্তু খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে দেশে কোনো ক্ষেত্রে কোনো সঠিক তথ্য নেই। আমি একটা সংস্থার পক্ষ থেকে অতিদরিদ্রদের মধ্যে পরিবারে কীভাবে বয়স্ক মানুষেরা প্রবঞ্চনা বা প্রতারণার শিকার হন, সে বিষয় একটা গবেষণা করছি। বয়সের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি হিসেবে ধরেছি। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে দেখলাম তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ত্রুটিপূর্ণ। চেহারা দেখে আন্দাজ করে খেয়ালখুশিমতো একটা বয়স লেখা হয়েছে। যে কাগজটি দেখিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিচয় বহন করা হয়, সেটি যদি ভুল থাকে তাহলে তথ্য কোথায় পাবেন?
তথ্য প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। সব সময় তথ্যকে হালনাগাদ করতে হয়। সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে জন্ম, বিবাহ ও বিদেশ গমন নিবন্ধন পদ্ধতি আছে কিন্তু কেউ কাজ করছে না। সরকারের ওপর তো আমাদের চাপ থাকবেই। ব্র্যাককে বলব, আপনারা যদি আপনাদের প্রকল্প এলাকায় একটা সার্ভিলেন্স সিস্টেম করেন তাহলে অনেক তথ্য সংরক্ষিত হবে। এ ক্ষেত্রে একটা বড় ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম আমরা পাব।
জনসংখ্যার ক্ষেত্রে তথ্যগুলো আরও গুরুত্বপূর্ণ। মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ ১৫ বছরের নিচে। জনসংখ্যার গড় আয়ু বেড়েছে। ফলে ৬০ বছরের ওপরের জনসংখ্যা বেড়েছে। আমার হিসাবমতে, ৬০ বছরের ওপরের জনসংখ্যা ৬.৫ শতাংশ, যার সংখ্যা এক কোটির ওপরে। ফলে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীকে বাড়াতে হবে। গড়ে আমাদের দেশে ১৫ দশমিক তিন বছরে মেয়েদের বিয়ে হয়। যেখানে আইনগত বয়স হচ্ছে ১৮ বছর। আমরা তো ১৮ বছরের ওপরে যেতে পারছি না, এমনকি ১৮ বছরেও যেতে পারছি না। এই মেয়েদের আবার এক বছরের মধ্যে সন্তান ধারণ করে নারীত্বের প্রমাণ দিতে হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের যাতে বিয়ে না হয়, সে ব্যাপারে ব্র্যাক কাজ করতে পারে।
পরিবার পরিকল্পনা ও অ্যাডভোকেসির জন্য প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ অনেক কম। পরিবার পরিকল্পনা এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অ্যাডভোকেসি মাত্র ২৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এমন কিছু খাত আছে যেখানে বরাদ্দের প্রয়োজন নেই। আবার এমন অনেক খাত রয়েছে, যেখানে প্রয়োজনের তুলানায় বরাদ্দ অনেক কম। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকলে এ রকম অপ্রয়োজনীয় খাতে অর্থ বরাদ্দ হতে পারত না। একটি বিরাট সুখবর হলো, এখন পর্যন্ত এক হাজার ৩০০ কোটি ডলারের বেশি বিদেশি মুদ্রা আমরা অর্জন করেছি। কিন্তু এই একই পরিমাণ জনসংখ্যা ফিলিপাইন, চায়না ও ভারতসহ অন্যান্য দেশ এর তিন গুণ বেশি বিদেশি মুদ্রা অর্জন করছে। কারণ, আমাদের শ্রমিকেরা খুবই অদক্ষ। আগামী ১০ বছর আমাদের খুব কঠিন সময় যাবে। আমরা যদি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টিসহ অন্যান্য সব বিষয়ে যথেষ্ট প্রস্তুতি গ্রহণ না করি, তাহলে দারিদ্র্যসহ নানাবিধ সমস্যা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

আনিসুল হক
আজকের আলোচনার শিরোনামের শেষ দুটি শব্দ ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি’ এ জায়গায় জোর দিতে চাই। আমার জন্ম হয়েছে নীলফামারীতে। শৈশব-কৈশোর কেটেছে রংপুর শহরে। গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ গ্রামে। কতকগুলো বিষয় নিজেরই দেখা। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে যেতাম। তখন দেখতাম, আমাদের বাড়ির মানুষেরাই তিন বেলা খেতে পেত না। কখনো কাউকে কিছু সাহায্য করতে পারতাম, কখনো পারতাম না। এখন এই অবস্থা নেই। যাদের ঘর ছিল না তাদের টিনের ঘর উঠেছে। যাদের টিনের ঘর ছিল, তাদের পাকা ঘর হয়েছে। দিন দিন মানুষ উন্নতির চাকার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। বিশেষ করে, যমুনা সেতু, পোশাকশিল্প এবং বিদেশ যাওয়ার সুযোগ মানুষকে উন্নতির ধারায় নিয়ে এসেছে। কুড়িগ্রাম অঞ্চলে দেখেছি ভুট্টার আবাদ। এর সঙ্গে হয়তো পোলট্রির সম্পর্ক আছে। সবকিছু মিলিয়ে প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটছে। যতই উন্নয়ন ঘটুক, সব দেশে সব সময় একটা শ্রেণী কোনো কোনো কারণে প্রান্তিক থেকে যায়। সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান একবার বলেছিলেন, তিনি মঙ্গা শব্দটি জানেন না। তারপর অনেক লেখালেখির পর আমরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলাম। এখন সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীতে অনেকে সাহায্য পাচ্ছে। যারা পাচ্ছে তাদের জীবনের কী পরিবর্তন আসছে, যারা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের কষ্টগুলো কী রকম, এই মানুষগুলোর কাছে গিয়ে মানবিক প্রতিবেদনগুলো এখন আমরা করি না। ভোরের কাগজ-এ থাকার সময় এই ধরনের প্রতিবেদন করতাম। অনেক সময় মনে হতে পারে এক কোটি মানুষের মধ্যে একজন মানুষের প্রতিবেদন কী প্রভাব ফেলবে। যখন একটি প্রতিবেদন হয় তখন কিন্তু ওই একজন মানুষ আর একজন মানুষ থাকেন না। তিনি হয়ে যান কোটি মানুষের প্রতিনিধি।
প্রতিনিয়ত মানুষের সুখ-দুঃখের কাহিনি গল্পের আকারে বলে যেতে হবে। তাহলে সরকার এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসবে। মনে পড়ছে অমর্ত্য সেনের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না।’ আজ আমরা গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট কাজ করছি সেটা মোটেই দাবি করা যাবে না। আমি মনে করি, সংবাদপত্রগুলো যদি সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির সফলতা-ব্যর্থতা এবং মাঠপর্যায়ে গিয়ে মানুষের ভালো থাকা-মন্দ থাকার গল্পগুলো তুলে আনে তাহলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি অনেকাংশে নিশ্চিত হয়।

আব্দুল কাইয়ুম
গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। আনিসুল হক সে কথাই বললেন। এবার বলবেন মাহবুব হোসেন।

মাহবুব হোসেন
অতিদারিদ্র্য নিরসনের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন। প্রত্যেক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু যে মাত্রায় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তাতে দারিদ্র্য দূরীকরণ কঠিন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থানসহ নানা সুযোগ সৃষ্টি করে। এখন একটি বড় প্রশ্ন হলো, কবে আমরা প্রবৃদ্ধিতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পুষ্টির প্রয়োজন। দরিদ্রদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পুষ্টির ব্যবস্থা যদি এখনো না করি তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেকে সুযোগ নিতে হয়তো তাদের আরও ২০ বছর লেগে যাবে। এ ক্ষেত্রে সরকার-এনজিও সবাই মিলে তাদের মাথার ওপর শক্ত করে ছাতা ধরতে হবে। আমাদের মোট জাতীয় আয়ের ২ দশমিক ১ বা ২ দশমিক ২ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর খাতে ব্যয় করছি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে যতটুকু বরাদ্দ দরকার সেখানে সে পরিমাণ আছে কি না। যাদের জন্য প্রয়োজন তারা পাচ্ছে কি না। বলা হচ্ছে, ৯০টি কর্মসূচির মধ্যে ৩০টিতে ৯৭ শতাংশ বরাদ্দ। এর অর্থ হচ্ছে অবশিষ্ট ৭০টিতে শুধু অফিস আছে এবং কোনো প্রকার কাজ ছাড়া কিছু মানুষের বেতন দেওয়া হচ্ছে। আমার মনে হয়, এখানে সরকারের বড় একটা অপচয় হচ্ছে। ত্রাণ হিসেবে কোনো সাহায্য না দিয়ে এগুলোকে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি বা শর্ত সাপেক্ষে সাহায্য দিতে হবে। তাহলে একদিকে দেশের অবকাঠামোর উন্নয়ন হবে, কর্মসংস্থানও তৈরি হবে।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে আমার মত হলো, একটি পৃথক সংস্থা গঠন করা, যারা প্রতিটি কর্মসূচির সব দিক মূল্যায়ন করবে। এখানে কয়েকজন ব্র্যাকের কিছু কাজের কথা বলেছেন। আমরা কিন্তু ইতিমধ্যে কিছু শুরু করেছি। আমরা অতিদরিদ্রদের দুই বছরের কর্মসূচিতে সম্পদ সাহায্য দিই। সম্পদ কীভাবে ব্যবহার করতে হবে তার প্রশিক্ষণ দিই। প্রতি সপ্তাহে আমাদের লোক তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে। দুই বছরের মধ্যে অতিদরিদ্ররা যাতে টেকসই উন্নয়নের ধারায় ফিরে আসতে পারে সে লক্ষ্যে কাজ করছি। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যে কারণে এসব কাজের পরিধি প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। মূল কথা হলো, সরকারকে প্রতিটি কাজের উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা সরকারকে সহযোগিতা করব।

রাশেদা কে চৌধূরী
অনেক বিষয় আলোচনা হয়েছে। বেশ কিছু মতামত, দিকনির্দেশনা এসেছে। এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হবে। কয়েকজন সরকারের সঙ্গে ব্র্যাকের সহযোগিতামূলক কাজের প্রসঙ্গ তুলেছেন। এটি একটি বিশেষ উদ্যোগ হতে পারে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে সরকারের পরিকল্পনা ও দক্ষতার অভাব আছে। সে ক্ষেত্রে ব্র্যাক যদি সহযোগিতা করে তাহলে তা দারিদ্র্য নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

আব্দুল কাইয়ুুম
সবাই মূল্যবান আলোচনা করেছেন। আজকের আলোচনা থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

No comments

Powered by Blogger.