বামপন্থিরা কি সামলাতে পারবে? by এম জে আকবর

পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়তি নির্ধারিত বিজয়ের মতো কখনও এমন রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষার মতো পূর্বগত পরিণামের কথা জানা ছিল না। ওই বেপরোয়া দল ও জনমত যাচাইকারীরা এই বিষয়টি ধরতেই পারেনি। বিশেষজ্ঞরা জানার অনেক আগেই মানুষ তা জেনে গিয়েছিল।


বাংলায় একমাত্র সিপিআইএম নেতারাই অন্ধ হয়ে ছিলেন। পার্টির যুদ্ধংদেহী প্রধান বিমান বসু অবজ্ঞার সুরে যা বলেছিলেন তার অর্থ দাঁড়ায়_ এসব 'কনট্রাক্ট মিডিয়া' নির্বাচনী ফল প্রকাশ পাওয়ার পর থেকেই আগের মতো বামদের বিরুদ্ধে জাবর কাটতে থাকবে। এটা আসলে কোনো মার্কসবাদীর রুচিশীল কথাবার্তা নয়। এর মাধ্যমে তিনি যে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছেন তা স্পষ্ট হয়। মনে রাখতে হবে যে, পরাজয় বিপজ্জনক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীরূপে আবির্ভূত হতে পারে। বিস্ময়করভাবে তিন দশক আগে সিপিআইএমও সমানভাবে তাদের আসন্ন ঐতিহাসিক বিজয় সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। তারা মোরারজি দেশাইর জনতা পার্টির সঙ্গে জোটে ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার পর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল এবং তারা রাজ্য বিধানসভার ২৯৪টি আসনের মধ্যে ১২০টি আসন পেয়ে জুনিয়র অংশীদারে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু বোকার মতো মোরারজি দেশাইরা তাদের এই জুনিয়র ভূমিকা পালনেও বাদ সেধেছিল। তারপরের ইতিহাস তো সবার জানা।
৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার সাফল্য কমিউনিস্ট কাঠামো ও চিন্তার ফল্টলাইনকে ঢেকে রাখে। এখানে জনগণের চেয়ে অগ্রাধিকার হলো পার্টির। জনগণ হলো পার্টির ইচ্ছা পূরণের একটা হাতিয়ার মাত্র। পুরস্কার ও শাস্তি এখানে পার্টির উপহার। বাংলার বহুত্ববাদী সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাদের শাসনের এই তরিকা অনুভূত হয়। জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতে হোক আর জালিয়াতি বলেই হোক যারা দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সাহায্য করতে পারে, তাদের ভাগ্যেই জুটে সুযোগ-সুবিধা। যারা তা পারে না তাদের ওপর নেমে আসে পুলিশ-পার্টি পার্টনারশিপের মাধ্যমে স্টিমরোলার। চাকরি দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল না। একদিকে সরকার, অন্যদিকে ক্ষমতা কেন্দ্রের ব্যুরোক্র্যাসির দাপটে প্রবৃদ্ধি আটকে গিয়েছিল। তাই 'তাদের' ও 'আমাদের' অভিহিত এই বাংলায় তাদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। নিঃস্ব অবস্থায় 'তারা' অব্যাহতভাবেই কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করতে থাকে। বাংলা যখন অব্যাহতভাবে ডুবতে থাকে তখনও পার্টি ভেসে থাকে।
মমতার বিজয়ের প্রধান কারণ হলো, বামপন্থিদের প্রতি জনগণের ব্যাপক বিরাগ। তবে ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং এরপর অনুষ্ঠিত পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিএম-এর নামিদামি ক্যাডারদের মধ্যে ফাটল ধরেছিল। সেটাও তাদের ধকল দিয়েছিল। এদের কেউ কেউ দল ছেড়ে মমতার দলে চলে গিয়েছিল। অন্যরা নির্বাচন-পরবর্তী নিজের অবস্থান নিয়ে বার্গেনিংয়ে ব্যস্ত ছিল। আসলে পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন এই বিষয়টি অনেক আগেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল।
বস্তুত এই দ্বিতীয়বার বাংলার ভোটাররা পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিল। তারা প্রথম সিপিআইএম-এর অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের জন্য ভোট দিল। তখন তাদের আশা ছিল নতুন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কমিউনিস্ট-ইজমের ক্ষয়িষ্ণু বাঁধনটা ছুটিয়ে দেবেন। যখন তিনি তা করতে ব্যর্থ হলেন তখন জনতার ক্রোধটা তার ওপর বেশি গিয়ে পড়ল। এখন মমতার প্রতি প্রত্যাশা জনগণের আরও অনেক বেশি। তিনি যদি ব্যর্থ হন তাহলে তার অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে তিনি নিজেও সেটা জানেন। আমরা সবাই জানি যে, তার সাহস ও সহিষ্ণুতা গুণ রয়েছে। তবে সুশাসনের যে চ্যালেঞ্জ তার সামনে রয়েছে সেটাকে অবজ্ঞা করা যাবে না।
এই নির্বাচনে দুর্নীতি স্থায়ী রূপ নিয়েছে। কেবল দিলি্লই এ ধরনের প্রবণতাকে সমর্থন করতে পারে। কারণ তারা তামিলনাড়ূর ভোটারদের দুর্নীতিগ্রস্ত সাব্যস্ত করে সেখানকার নির্বাচনে দুর্নীতি কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না বলেছিলেন। তাই দুর্নীতি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই এমনটা মনে করেছিলেন তারা। অথচ কেরালার মুখ্যমন্ত্রী অচ্যুতানন্দন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ করেই জনগণের মন জয় করেছিলেন। ভোটাররা রাজনৈতিক দুর্নীতির জন্য বামফ্রন্টকে শাস্তি দিয়েছে।
বামদের পশ্চিমবঙ্গে পরাজয় কি তাদের পুনরুত্থানের পক্ষে কাজ দেবে? তবে এজন্য সিপিআইএমকে তাদের অতীতকে মুছে ফেলার বিষয়টি অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে। তারা যদি মুক্তমন নিয়ে তাকায় তাহলে তারা সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ পেয়ে যাবে। আর তা না হলে ক্ষমতায় ফেরার জন্য তাদের আরও এক দশক অপেক্ষা করতে হতে পারে।

এম জে আকবর : ভারতীয় সাংবাদিক
দুটি লেখাই ইন্ডিয়া টুডে ম্যাগাজিন থেকে ভাষান্তর করেছেন সুভাষ সাহা
 

No comments

Powered by Blogger.