কারা আওয়ামী লীগের শত্রু কারা বন্ধু by সুভাষ সিংহ রায়

ঐশ্বর্যের খ্যাতি এবং দারিদ্র্যের ইতিহাস_আওয়ামী লীগের কর্মীদের এই দুই প্রাচীন ইতিহাস। গত কয়েক বছরে কিন্তু এ ছবি কিছুটা বদলেছে। দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব। সরকার গঠনের পরে নানা সময় কর্মীদের সম্পর্কে সংবাদপত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ।


বিএনপির কর্মীদের মতো বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষীদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়। এ চিত্র অতিরঞ্জিত নয়, এ কুখ্যাতি তাদের পাওনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের আদি কর্মীদের কখনোই বিচ্ছিন্নতাবাদের চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলায় দেখা যায় না। আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর সংখ্যা অগণিত অর্থাৎ গুনে শেষ করা যাবে না। সত্যি সত্যি বাংলাদেশের এমন কোনো পরিবার নেই, যেখানে আওয়ামী লীগের কর্মী নেই। এই দলের কর্মী 'গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক' বুকে-পিঠে লিখে জীবন্ত পোস্টার হতে জানে। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে সব সময় জীবনের জয়গান গেয়েছে। বোধ করি, আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যদের কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা কোনো দিন ছিল না। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগেও আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যদের একটি তালিকা নেই। এটা খুবই বিস্ময়কর বিষয় বটে। প্রায় এক বছর আগে দলের প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহ অভিযানের কথা শোনা গিয়েছিল। জেলার নেতারা ঢাকায় সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে 'সদস্য সংগ্রহের' বই নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই পর্যন্তই; আর এগোয়নি। ব্যাপারটা এমন, এই কাজটাও শেখ হাসিনাকে বসে থেকে করাতে হবে। যারা বিগত নির্বাচনে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল তাদের একটি বিরাট অংশ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। এই প্রজন্মের ভোটাররা মনে করেছিলেন, শেখ হাসিনার আন্দোলনের কারণে তারা ভোটার হতে পেরেছেন। এটা আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর একটা বিরাট সাফল্য। দলের জন্য সাফল্য তো বটেই। কিন্তু তার পরও আওয়ামী লীগ তাদের এখনো ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেনি। দুই বছর তো আর কম সময় নয়। ছয় মাসের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ ডাটা বের করা সম্ভব।
এই সরকার দায়িত্বে আসার পর যেসব বিষয় নিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছে, তার জন্য আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা দায়ী নন। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের 'হাইব্রিড' সদস্যরা অপকর্মগুলো করে। দলের একটা পূর্ণাঙ্গ সদস্য তালিকা থাকলে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করা যেত। দলের দুঃসময়ে যাদের খবর ছিল না, তাদের অনেকেই দলের ভেতরে জায়গা করে নিয়েছে। এখন সারা দেশে দলের কর্মীদের ভেতরে হতাশা ভর করছে। একনিষ্ঠ কর্মীরা কোথাও কোনো সুবিধা করতে পারছেন না। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অবস্থাও তথৈবচ। বিএনপি-জামায়াত সরকার সংগত কারণেই আমলাতন্ত্রের ভেতরে প্রগতিবাদী অংশকে থাকতে দেয়নি। কিন্তু ঘাপটি মেরে থাকা আগের সরকারের বেনিফিশিয়ারিরা আমলাতন্ত্রের ভেতরে কলকাঠি নাড়ছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কোনোভাবেই এদের দ্বারা উপকৃত হবে না_এটাই স্বাভাবিক। একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে কার্যকরী করতে হলে দক্ষ ও সৎ আদর্শিক মানুষ দরকার। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর স্বাধীনতার সপক্ষের আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্টিমরোলার চালানো হয়েছিল। যাদের সঙ্গে সামান্যতম আওয়ামী লীগ বা সমমনা রাজনীতির সম্পর্ক ছিল, তাদের বিদায় করা হয়েছিল। মাঝে এরশাদের সময় অন্তত পাবলিক সার্ভিস কমিশনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হয়েছিল। এই কারণে প্রগতিশীল ঘরানার মানুষ মেধার কারণে আমলাতন্ত্রের ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। বিসিএসে সেই সময় মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ না হলে এখন সরকার চালানোই মুশকিল হয়ে যেত। আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের দুঃখের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। বেশ কয়েকটি নির্বাচনী এলাকায় সংসদ সদস্যরা দলনির্ভর না হয়ে আত্মীয়নির্ভর হয়ে গেছেন। দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের সে ধরনের সংসদ সদস্যদের অনেকেই নবাগত; কেউ কেউ অন্য দলের সদস্য ছিলেন। তাদের আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা আপন করে নিলেও তিনি নেতা-কর্মীদের আপন করে নিতে পারেননি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা আগের দলের নেতা-কর্মীদের এখনো প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছেন। এ ধরনের গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে আওয়ামী লীগের ক্ষতি ক্রমেই স্ফীত হচ্ছে।
খুলনার একটি নির্বাচনী এলাকায় ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপির একজন নেতাকে এমপি মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁকে নির্বাচিত করার জন্য যা যা করার তা-ই করেছিলেন। কিন্তু পাঁচ বছরের সরকারি সুযোগ-সুবিধা যা ভোগ করার নিজে করেছিলেন এবং বিএনপির নেতাদের একটা অংশের ভাগ দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রকৃত কর্মীরা তাঁর চোখের বিষ ছিলেন। যথারীতি সেই এমপি ২০০১ সালের নির্বাচনে আবার বিএনপির মনোনয়ন পান এবং এমপি হন। মাঝখান থেকে আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতা-কর্মী মৌসুমি নেতার শ্যেনদৃষ্টিতে পড়েন এবং ব্যাপকভাবে নির্যাতিত হন। এই জগৎ-সংসারে কোনো কিছুই এখন মার্কেটিং-ম্যানেজমেন্টের বাইরে নয়। কোনো সংগঠনের কাঠামো কতটা শক্তিশালী তার বিশ্লেষণ করা হয় ঝডঙঞ ধহধষুংরং দিয়ে। (ঝ= ঝঃৎবহমঃয ; ড= ডবধশহবংং; ঙ=ঙঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃু; ঞ=ঞযৎবধঃ) আওয়ামী লীগের ঝঃৎবহমঃয হচ্ছে, তার বিশাল নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী। সারা দুনিয়ার কোনো রাজনৈতিক সংগঠনে এ রকম নিবেদিত কর্মী-সমর্থক নেই। বঙ্গবন্ধুর নামটাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভুবনে একটি বড় ঝঃৎবহমঃয (এই নাম শুনলেই মানুষের প্রতি প্রেম জাগে, চোখে আসে দরিদ্র মানুষের জন্য ভালোবাসার জল); এই সংগঠনের লাখ লাখ কর্মী বলতে গেলে জমিদার থেকে নিঃস্ব হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের ডবধশহবংং হচ্ছে প্রায় সময় নিবেদিতপ্রাণ শেষ বিচারে অভুক্ত থাকে। ঙঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃু অনেক।
এই সংগঠনের এখনো কর্মীবাহিনী আছে, যার মাধ্যমে যেকোনো ধরনের পরিবর্তন সংঘটিত করা সম্ভব। এ জন্য বড় ধরনের মহাপরিকল্পনা দরকার। সেটা নানা কারণে হচ্ছে না। একটি হলো পরিকল্পনা পর্যায়ে দক্ষ, সৎ ও আদর্শিক মানুষের অভাব। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই সময়ে সক্ষমতা ও আনুগত্যের সমন্বিত মানুষের ভীষণ আকাল। ঞযৎবধঃ হচ্ছে এই সংগঠনকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ক্রমাগত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এ দেশে কেউ আওয়ামী লীগের সহযোগিতা করে বিখ্যাত হয়েছেন। হয়তো যাঁরা বিরোধিতা করেছেন তাঁদের ওপর পাদপ্রদীপের আলো বেশি করে পড়েছে। আজ যাঁরা আওয়ামী লীগবিরোধী নেতা হিসেবে পরিচিত, তাঁদের অনেকেই এই অবস্থানগত কারণে সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। এ কারণে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীর ধারণা, অন্য দল করে আসলে দলে বোধ হয় একটু বেশি গুরুত্ব পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগের নিবেদিত কর্মীদের ব্যবসা হয় না, চাকরি হয় না। ঠিকাদারি কাজে বিএনপির নেতা-কর্মীদের প্রাধান্য সর্বত্র। অভিযোগ খুব পুষ্ট যে, প্রশাসনে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আমলারা এত ছদ্মবেশে প্রভাব বিস্তার করে আছে যে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ এখানে প্রায় উপেক্ষিত। ওপরে ঞযৎবধঃ-এর যে কথা বলেছিলাম, এটাও দলের জন্য একটা বড় ঞযৎবধঃ বটে। আওয়ামী লীগ যদি সব সময় নিষ্কাম কর্মী চায়, তাহলে সংগঠন ধরে রাখা কঠিন হবে। এই মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে নিষ্কাম কর্মীরা ম্রিয়মাণ হয়ে যান এবং সমাজে অপাঙক্তেয় হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের বোঝা উচিত, আওয়ামী লীগ রামকৃষ্ণ মিশনও নয় কিংবা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম নয়। চাণক্যের একটা শ্লোক আছে, 'ন হংস প্রেতবনে রমন্তে'। অর্থাৎ মৃতের বনে হংস কখনো খেলা করে না। হংস পদ্মবনে বিচরণ করে। কিন্তু পদ্মবন যদি নষ্ট হয়ে যায় অথবা হংসকে যদি শ্মশান ক্ষেত্রে ছেড়ে দেওয়া হয়, হংস কখনো সেখানে খেলা করে না। স্থান ত্যাগ করে সে অন্যত্র উড়ে যায়।
লেখক : ফার্মাসিস্ট ও রাজনীতিক
svuassingho@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.