সাক্ষাৎকারে এফবিসিসিআই সভাপতি-হরতালের ক্ষতির হিসাব কষা হচ্ছে

হরতালে অর্থনীতির কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, এর হিসাব কষছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষস্থানীয় সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। শিল্পোৎপাদন, পরিবহন, বেচাকেনা বন্ধ থাকার ক্ষতির পাশাপাশি আতঙ্ক, ভাঙচুর ও নেতিবাচক ভাবমূর্তির আর্থিক মূল্য কত- এর একটি ধারণাপত্র তৈরি করে


পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে জানানো হবে। হরতালসহ সংঘাতময় রাজনৈতিক কর্মসূচির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দেশের অর্থনীতিকে রক্ষার জন্য প্রতিবাদ জানানোর বিকল্প পথ খোঁজার আবেদন জানাবে ব্যবসায়ীদের এ শীর্ষস্থানীয় সংগঠন।
গত সোমবার কালের কণ্ঠের উপ-সম্পাদক টিটু দত্ত গুপ্ত ও বাণিজ্য সম্পাদক মাসুদ রুমীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ এ তথ্য জানান। আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি ও সরকারের ব্যাংক ঋণ কমানোর পাশাপাশি ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করার পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। বেশি দামে শিল্প-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, এটি একটি বিকল্প প্রস্তাব। যাদের সাধ্য আছে, তারা এ প্রস্তাবে সাড়া দিতে পারে।
হরতালে কেবল ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানাই বন্ধ থাকে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে, স্বাস্থ্যসেবাসহ সাধারণ মানুষের অন্য সব সেবা প্রাপ্তিও বিঘি্নত হয়। সরকারপক্ষ, ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকে হরতালের ভয়াবহ ক্ষতির কথা উচ্চারিত হলেও বহুল ব্যবহৃত রাজনৈতিক এ হাতিয়ারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি কত- এর গ্রহণযোগ্য কোনো হিসাব কেউ করেনি। আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় হরতাল যখন ব্যাপকতা লাভ করতে শুরু করে, তখন ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকে হরতালের ক্ষতির একটি মৌখিক হিসাব দেওয়া হতো, যা তৎকালীন প্রধান দুই বিরোধী দলের পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হতো। ১৯৯১ সালে নির্বাচিত সরকারের আমল শুরুর পর থেকে হরতালের ব্যবহার আরো বেড়ে যায়। এক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৯১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত মোট ৮২৭ দিন হরতাল পালিত হয়। অন্যদিকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ভাষা ও স্বাধিকার আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যে হরতাল হয়েছিল মাত্র ছয় দিন।
২০০৫ সালের মার্চে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছিল, তখন ইউএনডিপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হরতালের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির ৩ থেকে ৪ শতাংশ। হরতালের সামাজিক ও আর্থিক ক্ষতি বন্ধ করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর কাতারে এসে দাঁড়াতে পারত বলে মন্তব্য করেন ইউএনডিপির ঢাকা অফিসের তৎকালীন প্রধান জর্গেন লিজনার। এটি ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কোনো সরকারি বা বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হরতালের সার্বিক ক্ষতি নিয়ে কোনো সমীক্ষা করেনি। এফবিসিসিআইয়ের চলমান সমীক্ষা শেষ হলে এটিই হবে হরতালের অর্থনৈতিক ক্ষতির সর্বশেষ ধারণাপত্র।
এ কে আজাদ বলেন, 'আমরা এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে জরিপ করেছি- হরতাল অর্থনীতির কী পরিমাণ ক্ষতি করছে। এগুলো আমরা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে শিগগির দেখাব। আমরা চাই দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ থাকুক।' তিনি বলেন, 'হরতালের বিকল্প রোডমার্চ, অনশন, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি নিয়ে বিরোধী দল এগিয়ে আসতে পারে। হরতাল দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়- এটা আমরা বারবার বলছি; বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহ করে। কাজেই আমরা চাই হরতালের মতো বিধ্বংসী কর্মসূচি থেকে রাজনৈতিক দলগুলো বেরিয়ে আসুক। আমরা হরতালের ক্ষতিকর দিক নিয়ে জনমত গড়ে তুলব। সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে আমরা সংলাপ করব।'
আগামী অর্থবছরে বাস্তবায়নযোগ্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে এ কে আজাদ বলেন, 'প্রতিবছর সরকার বড় এডিপি নেয়, ঘাটতি মেটানোর জন্য ব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ নেয়, বছর শেষে দেখা যায় অর্ধেকও বাস্তবায়িত হয় না। অর্থবছরের শেষ দুই মাসে বরাদ্দের অর্থ খরচের হিড়িক পড়ে। এতে কেবল অর্থেরই অপচয় হয়, কাজের মান ভালো হয় না। তাই আমরা বলেছি, এডিপি ঠিক যতটুকু বাস্তবায়ন করা যায়, এর আকার ততটুকুই রাখার জন্য, যাতে ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ না নিতে হয়।'
ব্যক্তিপর্যায়ে করমুক্ত আয়সীমা দুই লাখ ২০ হাজার অথবা দুই লাখ ৩০ হাজার টাকায় নির্ধারণ করার প্রস্তাব দিয়েছে এফবিসিসিআই। হার না বাড়িয়ে করের জাল সম্প্রসারণ করার পরামর্শও দেন এএফবিসিসিআইয়ের সভাপতি। এ ছাড়াও তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ঋণ অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ভর্তুকি দিতে গিয়ে সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে বেসরকারি খাত ঋণ পাচ্ছে না। একদিকে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, অন্যদিকে সুদের হারও বেড়ে যাচ্ছে। নতুন বছরের বাজেটে সরকারকে অবশ্যই ভর্তুকি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার হারও কমাতে হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোর লোকসান কমিয়ে আনার তাগিদ দিয়ে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি বলেন, এ ক্ষেত্রে সরকারি করপোরেশন বা শিল্প-কারখানাগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া এসব কারখানা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় পরিচালনা করা যেতে পারে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে, লোকসান কমে আসবে।
চলতি অর্থবছরের পিপিপিতে তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও কেবল একটি ফ্লাইওভার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ কে আজাদ মনে করেন, এই বরাদ্দ আরো বাড়িয়ে চট্টগ্রাম বন্দর ও রেলপথের উন্নয়নে পিপিপির ওপর জোর দেওয়া উচিত।
ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোর দাবি জানিয়ে এ কে আজাদ বলেন, ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিলে বিনিয়োগ কমে যায়। বিদেশি বিনিয়োগ এমনিতেই কমে গেছে। সুদের উচ্চ হারের কারণে দেশি বিনিয়োগও কম। বিনিয়োগ উৎসাহিত করার জন্য তিনি মৌলিক কাঁচামাল আমদানির শুল্ক কমানোর দাবি জানান। বিদ্যমান কর অবকাশ সুবিধা আরো পাঁচ বছর বহাল রাখারও প্রস্তাব দেন তিনি।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য স্পেশাল ইকোনমিক জোন করার কথা চলতি অর্থবছরের বাজেটেও বলা আছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও সাত বিভাগে সাতটি এসইজেড করার ঘোষণা দিয়েছেন। সরকারের এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন চেয়েছেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি।
বিদ্যুৎ সমস্যা কমাতে স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগের অংশ হিসেবে রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের জন্য সরকারকে চলতি অর্থবছরে অন্তত আট হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে উল্লেখ করে এ কে আজাদ বলেন, 'এতে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট চাপ তৈরি হয়েছে। আমরা মনে করি, ব্যয়ের এ বোঝা কমাতে আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে যাওয়া উচিত। প্রথমে আমদানি দিয়ে শুরু করলেও বড়পুকুরিয়াসহ যেসব স্থানীয় উৎস থেকে কয়লা সংগ্রহের সুযোগ আছে, সেগুলো দ্রুত উত্তোলনের ব্যবস্থা করা দরকার। শুধু তেলের ভর্তুকিই যদি কমানো যায়, তাহলে অর্থনীতি বড় ধরনের চাপ থেকে মুক্ত হবে। তখন অবকাঠামো উন্নয়ন ও সামাজিক খাতে সরকার আরো অর্থ ব্যয় করতে পারবে, যার সুফল পাবে দেশের জনগণ ও সামগ্রিক অর্থনীতি।'
দেশে যখন সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ দরকার তখন আইএমএফ সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর চাপ তৈরি করছে- ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের এমন পর্যবেক্ষণের বিষয়ে এ কে আজাদ বলেন, 'আইএমএফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তাঁরা আসলে চান আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি একটি সুষম পদ্ধতিতে চলুক। আমরাও তা-ই চাই। তাঁরা জ্বালানি ভর্তুকি প্রত্যাহারের কথা বলেছেন, আমরাও তা-ই মনে করি। তা না হলে সরকারের ব্যাংক ঋণ কমবে না, সুদের হার ও মূল্যস্ফীতি কমবে না, বিনিয়োগের উপযোগী পরিবেশও তৈরি হবে না।'
জ্বালানি ভর্তুকি তুলে নিলে বিদ্যুৎ ও পণ্য উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাবে, যার প্রভাব ভোক্তাপর্যায়ে পড়লেও সরকারের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি। তাঁর মতে, ভর্তুকির চক্র থেকে সরকারকে বের হয়ে আসতে হবে। বারবার জ্বালানির দাম বাড়িয়ে মানুষের কষ্ট প্রলম্বিত করার চেয়ে একবারেই এ সমস্যার সমাধান করা ভালো।
সরকার আবাসিক ও বাণিজ্যিক- উভয় খাতেই ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ করছে। বেশি দাম দিলে শিল্প-কারখানায় অব্যাহতভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ পাওয়া যাবে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা থেকে সম্প্রতি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই প্রস্তাবকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি। তিনি বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের ঘাটতির মধ্যে এটি একটি বিকল্প প্রস্তাব। যাদের সাধ্য আছে বেশি দামে কিনে জ্বালানির প্রয়োজন মেটানোর একটা পথ তাদের জন্য খোলা থাকল।
ভারত জ্বালানি তেল আমদানি বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বাংলাদেশেও বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেল আমদানির অনুমতি দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন এ কে আজাদ। তেল আমদানির খরচ কমাতে পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন বলেও মনে করেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি। এ জন্য পরিশোধন খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করার পরামর্শ দেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.