জাহাজ ভাঙার ইতিবৃত্ত by ইকবাল হোসাইন চৌধুরী

সেদিন ২৬ ডিসেম্বর, ২০০৯। আচমকা মৃত্যু এসে হানা দেয় সীতাকুণ্ডের মাদাম বিবির হাটে। প্রচন্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে রহিম স্টীল নামের জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ড। ঘটনাস্থলেই মারা যান চার শ্রমিক। পরিসংখ্যান বলছে ফি বছরেই দেশের ৮০টি শিপইয়ার্ডে ঘটে এমন ছোট-বড় মৃত্যুর ঘটনা। প্রশ্নবিদ্ধ জাহাজ ভাঙাশিল্পের ভেতর-বাইরের কথা নিয়ে এবারের মূল রচনা।


সদর দরজায় লাল কালিতে বড় করে লেখা—আপনার পরিচয় দিন। দেখে আমাদের চট্টগ্রামের প্রতিবেদক প্রণব বলের সাবধানবাণী কানে বাজে, ‘মাদামবিবির হাট যাচ্ছেন শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের ভেতরে, কিন্তু আপনাকে ঢুকতে দেবে না।’ পরিচয় প্রদান মানেই সবকিছু ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। রহিম স্টিল নামের জাহাজ ভাঙার উঠোনের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা দুজন দোনোমনা করি। সঙ্গে ক্যামেরা নেই, বন্ধু উজ্জ্বলের পকেটে আছে সাইবার শট মোবাইল ফোন। সেটাই ভরসা। খুব অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে রহিম স্টিলের সদর দরজায় পা রাখি। শ্বাসরুদ্ধকর কয়েকটা মুহূর্ত কাটে। আদতে হয়তো ভয়ের কিছুই ছিল না। নিরাপদেই আমরা সদর দরজার বাধা পেরিয়ে যাই আর রহিম স্টিল শিপব্রেকিং ইয়ার্ড তার সব দৃশ্যমালা আর শব্দ নিয়ে পুরোদস্তুর জীবন্ত হয়ে ওঠে। বিষাক্ত ধোঁয়া আর ধুলো মিলেমিশে ভারী হয়ে আছে বাতাস। কুঁজো হয়ে থাকা মানুষগুলোর পিঠে বিশাল ও ভারী লোহার পাত। সেটাকে ট্রাকে ওঠানোর লড়াই চলছে। তাদের সম্মিলিত ‘হেইয়া হেই, হেইয়া হেই, হেইয়া হেই’ শব্দটা কেমন একটা জান্তব আর্তনাদের মতো কানে এসে ধাক্কা দেয়। সেটা অভাবনীয় ওজনের চাপে মানুষগুলো অর্ধেক ভাঁজ হয়ে আছে তাই, না কি পাশেই প্রচণ্ড কর্কশ শব্দে জাহাজের বাতিল শরীরে বৈদ্যুতিক করাত চলছে বলে—ঠিক ঠাহর করা মুশকিল। বাতিল লোহালক্কড়ের স্তূপ পেরিয়ে আমরা ধুলোময় একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াই। সামনে কাদাময় সৈকতজুড়ে বিছিয়ে আছে ব্যবচ্ছেদ হওয়ার অপেক্ষায় দুটি প্রায় পাহাড় সমান উঁচু জলযান। ফাঁক দিয়ে খুব কায়দা করে তাকালেই শুধু চোখে পড়ে দূরের কুিসত সমুদ্র। কাদাঘোলা বিতিকিচ্ছি সাগরের জল নয়, বরং দূরের দেখায় পিঁপড়ার মতো আরেক দল মানুষ মাঝখান থেকে মনোযোগ ছিনিয়ে নেয়। ওদের কাঁধে লম্বা ধাতব রশি। হাঁটু সমান কাদায় পা ডুবিয়ে মানুষগুলো বুঝি চুপচাপ হতদরিদ্র জীবনের বোঝা টানে। উজ্জ্বল পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী টিনের বেড়া দেওয়া টয়লেটের ভেতর গিয়ে পটাপট কয়েকটি ছবি তোলে। এরপর কোথায় যেন টং টং করে ঘণ্টি বাজে। জাহাজ ভাঙার উঠোনে বিকেলে বিরতির সংকেত। শ্রমিকদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলার এই তো মওকা! আমরা তড়িঘড়ি বেরোনোর পথ খুঁজি।

লোহাখোর
কীভাবে খবর পেলেন এখানে কাজ মেলে?
গোল্ডেন স্টিল এলয় এবং চিটাগং শিপব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিংয়ের মাঝখানের সরু গলি দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন দলছুট মানুষটা। পরনে কাদামাখা লুঙ্গি। রাবারের চপ্পল পায়ে। ময়লা জমতে জমতে পরনের ফুলহাতা শার্টটি আসল রং খুইয়েছে কবে! উত্তর দেওয়ার আগে ফ্যাকাশে আর ধুলোমলিন গায়ের চামড়া চুলকে নিয়ে জাহাজ ভাঙার শ্রমিক লোকটি একটু থামেন।
‘শালা-সম্বন্ধীরা আছে তারাই বলল। দেশে মাঠে কাজ করতাম। শেষে এইখানে আসলাম। লোহা টানার কাম ত। বেশিদিন করা যায় না। কষ্ট বেশি। বুঝলেন বাবা? খুব কষ্ট। আমি চলে যাব। থাকব না বেশিদিন। একটাও বেটা নাই। ছয়টা বেটি। বেটিদের বিয়ে-শাদি আছে...।’ বগুড়ার বাসিন্দা আরজু নামের মাঝবয়সী মানুষটা আপন মনে বকতে বকতেই পাশের চায়ের দোকানে ঢোকেন। তারপর দুটি পরোটা আর এক কাপ চায়ের কথা বলে ঝিম মেরে বসেন এক কোণে।
ক্লান্ত ভঙ্গিতে মুখভর্তি বনরুটি চিবোচ্ছিল বাবর। একই বেঞ্চে পাশে বসা মিন্টু মিয়া এবং আরও অনেকগুলো মলিন ক্লান্ত মুখ।
‘আমরা এইখানে প্রায় সবাই বগুড়ার লোক। মারা গেছে যারা সেইখানেও বগুড়ার লোক বেশি।’ ফোকলা দাঁত দেখিয়ে মন্টু মিয়া কেন যেন হাসেন। ‘কেউ তিরিশ দিন থাকে। কেউ এক মাস। লোহা টানার কাম ত বেশি দিন করা যায় না। শরীর নষ্ট হয়া যায়। দিনে ৩০০ টাকা অবশ্য পাওয়া যায়।’ সঙ্গে যোগ করে কিশোর বাবর।
ভয় লাগে না?
‘নাহ্। এই রকম ত প্রায় হয়। এই রকম বহুত মানুষ মারা যায়। উপর থেকে লোহা পইড়া মইরা যায়। পা ভাইঙ্গা যায়। পা কাটা যায়। মাথা ফাইটা যায়। এইগুলা কাজ মনে করেন বিশ্বাস নেই। জীবন হাতের তাইল্লাত নিয়া ফিল্ডের মইধ্যে যাইতে হয়।’ আশ্চর্য নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বাবর আর মন্টু মিয়া বলে আর খুব বুঝদারের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে পাশের দুজন।
মারা গেছে যারা তাদের চিনতেন?
‘ওরা তো উড়ে গেছে। পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। ওদের কোনো কিছু তো পাওয়া যায় নায়। ভিতরে তেলের টাংকি আছিল। পরশু আবার এইদিকে আহত অইছে কয়জন। আমরা আবার দেশে চইল্লে যাব।’ মানুষগুলো যেন নিজেরাই নিজেদের প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করে।
সেদিনের রহিম স্টিল মিলের দুর্ঘটনার বিবরণ মেলে পাশের বয়োবৃদ্ধ মুদি দোকানি আমিনুল হকের কথায়—‘চাইর-পাঁচদিন আগে ঘটছে ঘটনা। সকাল নয়টা-দশটার দিকে। আওয়াজ চাইর-পাঁচ মাইল দূরে গেছে। ফাটল ধরছে এইখানকার কয়টা বিল্ডিংয়ে। কত সাম্বাদিক, কত মন্ত্রী-এমপি আসছিল। আমার চোখের সামনে দিয়া লাশ নিয়া গ্যাছে...’
মাদামবিবির হাট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আরেকবার দূর থেকে ফিরে তাকাই রহিম স্টিলের দিকে। ভেতরে প্রতিদিনকার মতো হাঁকডাক চলছে। মৃত্যুর গন্ধ নেই কোথাও। অথচ সপ্তাদুয়েকও হয়নি মৃত্যু এসে হানা দিয়েছিল এখানে।

জাহাজ ভাঙার ইতিবৃত্ত
বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙাশিল্পের যাত্রা শুরু হয় মূলত ১৯৬০ সালে। সেই সময়ে ঝড়ের কবলে পড়ে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ‘এমভি আল পাইন’ নামের একটি জাহাজ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের উপকূলবর্তী এলাকায় আটকে পড়ে। কোনোভাবেই এটিকে আবার সমুদ্রে ভাসানো সম্ভব হচ্ছিল না। মূলত ওই জাহাজটিকে সৈকতে টেনে এনে খণ্ডিত করার মাধ্যমে শুরু হলেও বাণিজ্যিকভাবে জাহাজ ভাঙা শুরু হয় স্বাধীনতার পর। সত্তরের দশকেই বাণিজ্যিক ব্যাংকের সহায়তায় কেটে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে জাহাজ আমদানি শুরু হয়। আশির দশকের শেষের দিকে এ অঞ্চলের জাহাজ ভাঙাশিল্পের সংখ্যা ৬০ থেকে ৮০টিতে উন্নীত হয়।

জাহাজ ভাঙার বিপদ
পরিবেশগত ঝুঁকিসহ নানা কারণে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ধীরে ধীরে জাহাজভাঙা শিল্প থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকে। বিষাক্ত জাহাজ সত্কার নিয়ে আপত্তি ওঠে বাংলাদেশেও। পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) ২০০৩ সালে পরিবেশদূষণের দায়ে জাহাজভাঙার ইয়ার্ডগুলোর বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে। এর পর শ্রমিকদের যথাযথ অধিকার আদায় ও বিষাক্ত পণ্যবাহী জাহাজের প্রবেশ বন্ধের জন্য দায়ের হয় আরও তিনটি মামলা। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া জাহাজ ভাঙার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন আদালত।
বাংলাদেশে এই জাহাজভাঙার শিল্প টিকিয়ে রাখার পক্ষে অন্যতম বড় যুক্তি ছিল, এ শিল্প দেশের প্রয়োজনীয় লোহার একটি বড় অংশ জোগান দেয়। ইপসার সহযোগিতায় গ্রিনপিস ও এফআইডিএইচের তৈরি একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ‘দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ জোগান দেয় বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্প।’ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও বহুবার প্রকাশিত হয়েছে এই সরকারি হিসাব। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, ২০০৮ সালের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের নিজেদের দেওয়া একটি বিজ্ঞাপনেই এই ৮০ শতাংশ লোহা সরবরাহের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ওই বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে—‘...বিভিন্ন লৌহজাত কাঁচামাল বিদেশ থেকে বন্দর ও স্থলবন্দরের মাধ্যমে আমদানি হয়ে আসছে...পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, শিপ ব্রেকিং খাত দেশের চাহিদার মাত্র ২৫-৩০ শতাংশের জোগানদাতা।’

মৃত্যুর গন্ধ
কোনো দৈববলে যেন শ্বেতবর্ণের হয়ে গেছে আগাগোড়া বাঙালি মানুষটা। দু চোখ বোজা। হঠাত্ দেখলে বুকে ধাক্কার মতো লাগে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছেন তিনি। সঙ্গী ডাক্তার শাহাদাত তুহিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফাইলপত্র ঘেঁটে দেখে জানান, রোগীর নাম লুত্ফুর রহমান। তাঁর শরীরের ২৫ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছে সেদিন রহিম স্টিলে সংঘটিত বিস্ফোরণের হলকায়। কয়েকটা শয্যা সামনে গিয়ে দেখা পাই সাদ্দামের। ঝলসে গেছে পুরো মুখ। ভয়াবহভাবে পুড়ে যাওয়া পা দুটিও ফুলে ঢোল। ছেলের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন মা ঝরনা খাতুন। দর্শনার্থী দেখে মাথায় ঘোমটা টেনে সরে যান। পাশেই সাদ্দামের বাবা মোহাম্মদ খোকা। পাশের বিছানার লুত্ফুর তার খালু। সেদিনের বিস্ফোরণে মারা গেছে তার এক মামাও। কাঁধের তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে খোকা জানান, তিনি নিজেও ‘কাটার’-এর কাজ করেন রহিম স্টিলের পাশের আরেক শিপইয়ার্ডে। সাদ্দাম লেখাপড়া করেছে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত। বগুড়ার গোঁসাইবাড়ী গ্রাম থেকে বাপের দেখাদেখি কিশোর সাদ্দামও গিয়েছিল মাদামবিবির হাট রহিম স্টিল মিলে। সেটা গত রোজার ঈদের সময়। কাজও করেছিল মাসখানেক। এবার দ্বিতীয় দফায় সে গিয়েছিল মাসখানেক আগে। জীবন্মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ পেরিয়ে এসে আপাতত আশঙ্কামুক্ত সাদ্দাম বলতে শুরু করে ভয়াবহ সেই দিনের কাহিনী।
মাদামবিবির হাটের ভাড়া বাসা থেকে সে দিনও সকাল সকাল যথানিয়মে জাহাজে গিয়েছিল সাদ্দাম। ৪২ হাজার টনের বিশাল ট্যাংকার জাহাজটিতে ওঠার সময় একটিবারের জন্যও মনে হয়নি এভাবে ওঁেপতে ছিল বিপদ।
কাজ করতে করতেই আচমকা ঘটে বিস্ফোরণ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ধাক্কায় নিচে ছিটকে পড়ে সাদ্দাম। ততক্ষণে দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করেছে বাতিল জাহাজটা। সাদ্দাম বুঝতেই পারেনি, কখন স্রেফ নেই হয়ে গেছে সঙ্গী কাটার আর ফোরম্যান। ঠিক ওই সময়টাতেই পাশের শিপইয়ার্ডে কাজ করছিলেন বাবা খোকা। পড়িমরি করে তিনি ছুটে আসেন রহিম স্টিলে। পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া শরীরের মাঝে উদভ্রান্তের মতো তিনি খুঁজতে থাকেন ছেলেকে। বহু ছোটাছুটির পর তিনি খুঁজে পান প্রায় ঝলসে যাওয়া ছেলেকে। তারও বহুক্ষণ পর পিতা-পুত্রকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছোটে একটি অ্যাম্বুলেন্স।
বার্ন ইউনিটে ভর্তি আরেক শ্রমিক নজরুলকে দেখে ফিরছি। ঘুরে সাদ্দামের বিছানার দিকে আরেকবার তাকাই। তার পুড়ে যাওয়া সাদা মুখের মাঝ থেকে চোখ দুটি বুঝি কিছু বলতে চায়। মা ঝরনা খাতুন ঘোমটা টেনে এক কোণে বসে আছেন আগের মতো। মহিলা কি কাঁদছেন? জানা হয়না। কিশোর সাদ্দামের আকুতি ভরা চাহনি মাথায় নিয়ে হাসপাতাল থেকে একরকম পালিয়ে বাঁচি।

No comments

Powered by Blogger.