বিচারের বাণী-বাংলাদেশের আদি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী

কথারম্ভ ১ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশের আদি সংবিধানের ক্ষমতা’ শিরোনামে এই পাতায় আমার লেখা ছাপা হয়েছে। লেখাটিতে বাংলাদেশের আদি সংবিধানের ক্ষমতার সূত্রাবলি আলোচনাক্রমে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল এবং সেগুলোর ভিত্তিতে এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা গিয়েছিল যে বাংলাদেশের আদি সংবিধানের ক্ষমতা একক এবং সে চিন্ময় অজর অমর অক্ষয় অব্যয়।


অতঃপর সিদ্ধান্তটির পিছু পিছু লেখাটিতে এই দাবি হাজির হয়েছিল, আদি সংবিধান থেকে সব কটি বেআইনি পরিবর্তন, সংশোধন করা নয়, বাদ দিয়ে সংবিধানকে আদি মহিমায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ইতিহাসে সচেতন ব্যক্তির মানসে বাংলাদেশের আদি সংবিধান পাঠ শেষে সহজেই ধরা পড়বে বিদ্রোহী-সংগ্রামী জনগণের অস্তিত্ব ও তাঁদের আকাঙ্ক্ষাগুলো এবং সেগুলোই বিকশিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে গৃহীত সংবিধানে। তাই আদি সংবিধানের বৈশিষ্ট্যত্রয়ের ভিত্তিতে ওই একই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যায়, বাংলাদেশের আদি সংবিধান একক এবং সে চিন্ময় অজর অমর অক্ষয় অব্যয়। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আসুন, বৈশিষ্ট্য তিনটির খোঁজ করি। কাজটি শেষে আমি নিশ্চিত, আপনি ওই একই দাবি আবার করবেন—সংবিধানকে আদি মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

সমাজতন্ত্রের নকশা
সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি যে একই স্বর্ণমুদ্রার দুই পিঠ, কিংবা তারা একে-অপরের সম্পূরক—এই সর্বজনীন সত্যটিই উচ্চারিত হয়েছিল সংবিধানের আদি ১০ অনুচ্ছেদ: ‘সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি। মানুষের ওপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।’ ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ শিরোনামে সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে অন্তর্ভুক্ত ১৪ থেকে ২০ অনুচ্ছেদগুলোতে দুটি কার্যক্রম লক্ষ করা যায়। যার প্রথম ধাপ হচ্ছে জনসেবক সমাজ গড়া এবং দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ। প্রথম ধাপের কার্যক্রম ১৫, ১৭ ও ১৮ অনুচ্ছেদগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে। এদের নির্গলিতার্থ এই: রাষ্ট্র (১) জীবনধারণের প্রাথমিক উপকরণের, যথা-(ক) খাদ্য, (খ) পরিচ্ছদ, (গ) বাসস্থান এবং (ঘ) চিকিত্সার অধিকার দেবে; (২) কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার দেবে; (৩) বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার দেবে; (৪) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার দেবে; (৫) সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে এবং (৬) জনস্বাস্থ্যের ও জননৈতিকতার উন্নতি সাধন করবে।
সংবিধানে সমাজতন্ত্রের যে নকশা দেওয়া আছে, সেটা এই: শ্রম সব মানবিক বস্তুর উত্স বিধায়, জীবনপ্রক্রিয়ায় কায়িক শ্রমের প্রাধান্য থাকা আবশ্যক। কিন্তু বুর্জোয়া শ্রেণী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শ্রমভিত্তিক যে সামাজিক স্তর সেখানে অর্থনৈতিক শোষণ ও সামাজিক অবমাননা উভয়ই সমভাবে খুঁটা গাড়ে। সুতরাং সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য জরুরি ওই শোষণ ও অবমাননা থেকে মুক্তিলাভ (অনুচ্ছেদ-১৪)। এই উদ্দেশ্যে প্রথম পদক্ষেপ হবে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা এবং সব নাগরিকের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা (অনুচ্ছেদ-১৯)। এই উদ্দেশ্যে মালিকানার ব্যবস্থা হবে এইরূপ: (ক) জনগণের পক্ষের রাষ্ট্রের মালিকানা, (খ) সমবায়ী মালিকানা এবং (গ) আইনে নির্দিষ্ট ব্যক্তির মালিকানা (অনুচ্ছেদ-১৩)। অতঃপর গ্রামীণ উন্নয়ন যার চূড়ান্ত রূপ হবে কৃষিবিপ্লব (অনুচ্ছেদ-১৬) এবং যার ফলস্বরূপ কর্ম হবে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার ও সম্মানের বিষয় এবং কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করার সুযোগ পাবেন না (অনুচ্ছেদ-২০)।

গণতন্ত্রের নকশা
বাংলাদেশের সংবিধানের উল্লিখিত সমাজতন্ত্রে উত্তরণে যে প্রাথমিক কার্যক্রম ও তারপর চূড়ান্ত কার্যক্রম, সেগুলোর বাস্তবায়ন করা সম্ভব একমাত্র স্বাধীন ব্যক্তিমানুষের সমন্বয়ে গঠিত ব্যক্তিসমষ্টির মাধ্যমে। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রে সে রকম ব্যক্তিসমষ্টি গঠনে কোনো ব্যবস্থা নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রে একজন নাগরিকের সর্বশেষ সর্বোচ্চ অধিকার হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর এলাকার ভোটাধিকার। প্রকৃত গণতন্ত্র কী তার খসড়া দেওয়া হয়েছে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের ১ দফায়: ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটির প্রথম অংশ একটি বিমূর্ত ধারণা এবং দ্বিতীয় অংশ ইঙ্গিত দেয়, স্বাধীনতাকে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় পেতে হবে এবং এই অর্থেই স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধা জনগণের আকাঙ্ক্ষায় একটি বিমূর্ত স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ছিল না, তাঁদের আকাঙ্ক্ষায় ছিল একটি বাস্তব স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। যার নকশা সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদে দেওয়া আছে। নকশাটি এই: বাংলাদেশের প্রতিটি প্রশাসনিক ইউনিট (সেগুলোর সংখ্যা কতটি হবে জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়ন দ্বারা নির্দিষ্ট করবে) এলাকায় স্থানীয় সরকার থাকবে। তাদের দায়িত্বে অন্তর্ভুক্ত থাকবে (ক) প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কাজ, (খ) জনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং (গ) অর্থনৈতিক উন্নয়নসম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। তাদের ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত থাকবে স্থানীয় প্রয়োজনে কর আরোপ করা, বাজেট প্রস্তুত করা ও নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণ করা। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে উচ্চারিত হয়েছে এই মূলনীতি যে প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। এই মূলনীতির পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, প্রতিটি এলাকায় জনকর্তৃত্বের সরকার বা স্থানীয় প্রজাতন্ত্ররূপী স্থানীয় শাসন ছাড়া স্বাধীনতা একটি অর্থহীন বিমূর্ত ধারণা।

ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা
বাংলাদেশের সংবিধানের আদি ১২ অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি এই: ‘ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাঁহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।’ ১৯৩৮ সালে উর্দু ভাষায় প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রধান মাওলানা হুসেন আহমদ মাদানী লিখেছিলেন, ‘একটি জাতি গঠনে ধর্ম অপরিহার্য উপাদান নয়। কারণ, কোরআনের সব জায়গায় মুসলমানদের একই মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে, কখনো একই কওমের অন্তর্ভুক্ত বলা হয়নি। আরবি ভাষায়, বিশেষ করে কোরআনে, মিল্লাত শব্দটি আইন ও ধর্ম অর্থে এবং কওম জাতি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। শব্দ দুটির মধ্যে রয়েছে দুনিয়ার ব্যবধান। জাতিকে যদি তুলনা করা যায় জমিনের সঙ্গে, তাহলে মিল্লাত হচ্ছে আসমানের মতো।’ ইসলামের নবীর নেতৃত্বে প্রণীত ‘মদিনার সংবিধান’-এর একটি অনুচ্ছেদে লেখা আছে, মুসলমান আর ইহুদি নাগরিকগণ একই ‘কওম’ বা জাতির অন্তর্ভুক্ত।

অনাসৃষ্টি কাজ
সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদে ‘সমাজতন্ত্র’ ব্যাপক অর্থে উল্লেখ করা হয়েছিল। একজন স্বৈরশাসক কর্তৃক প্রতিস্থাপিত অনুচ্ছেদে ‘সমাজতন্ত্র’কে সংকীর্ণ ও নির্দিষ্ট করা হয়েছে: ‘সমাজতন্ত্র অর্থাত্ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার।’ উদ্ধৃত সংবিধানের আদি ১০ অনুচ্ছেদটিও ওই স্বৈরশাসক বিলুপ্ত করে ‘জাতীয় জীবনে মহিলাদের অংশগ্রহণ’ এই পার্শ্ব-শিরোনামে এক সম্বন্ধহীন নতুন অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপিত করেন এবং উদ্ধৃত সংবিধানের আদি ১২ অনুচ্ছেদটি বিলুপ্ত করেন। এসব অনাসৃষ্টির ধারাবাহিকতায় সংবিধানের অন্য কতিপয় অনুচ্ছেদ কাটাকুটি করেন। ফলে বাংলাদেশের আদি সংবিধানের ওই বৈশিষ্ট্য দুটির দুঃখজনক অপমৃত্যু ঘটে। আর একটি দুঃখ হচ্ছে, সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ দুটি অক্ষত ও বহাল থাকা সত্ত্বেও আজতক সেটা উপেক্ষিত থেকে গেছে।

শেষ কথা
বাংলাদেশের সংবিধানের আদি বৈশিষ্ট্যগুলোর সম্মিলিত চরিত্র একটি শব্দ দ্বারা অনায়াসে উপলব্ধি করা যায়। সে শব্দটি হচ্ছে ‘স্বয়ম্ভু’ অর্থাত্ আপনাআপনি জন্ম নেওয়া। কেননা, কোনো বাইরের শক্তি নয়, দেশজাত আকাঙ্ক্ষাই এটার জন্ম দিয়েছে। আর তার সঙ্গে যুক্ত ছিল মুক্তিযোদ্ধা জনগণের দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, যার তুলনীয় কবির উক্তি: ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ কিংবা ‘এই দেশেতে জন্ম আমার, যেন এ দেশেতেই মরি’ কিংবা ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়...।’
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট।

No comments

Powered by Blogger.