হরতাল বন্ধের আইন চান ব্যবসায়ীরা

অনির্বাচিত সরকারের সময়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা এখনো পুরনো হয়নি। এরই মধ্যে আবারও তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অবস্থানে অনড় থাকলেও ভীত ব্যবসায়ীরা। গণমাধ্যমের কাছে এই ভীতির কথা সরাসরি স্বীকারও করছেন তাঁরা।


পাশাপাশি সংঘাতময় পরিস্থিতি রুখতে তৎপর হয়েছেন। দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে কার্যপ্রণালী, যা অনুসরণ করে হরতাল বন্ধের আবেদন নিয়ে তাঁরা যাবেন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার কাছে।
গত বুধবার হোটেল ওয়েস্টিনে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতিদের বৈঠকের পর গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হয় সংগঠনটির জরুরি বোর্ড সভা। সেখানে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে বৈঠক করেন ব্যবসায়ী নেতারা। বোর্ড সভায় অনেকে হরতালের বিষয়টি নিয়ে আদালতে যাওয়ার কথা বলেছেন, অনেকে মৌন মিছিলের কথা বলেছেন, অনেকে বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।
সভা শেষে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, তাঁরা সব দলের অংশগ্রহণে হরতাল বন্ধে আইন চান। অনির্বাচিত সরকার চান না। আবার বিদেশিদের হস্তক্ষেপও চান না। তাঁরা চান রাজনৈতিক দলের নেতারা দেশের অর্থনীতির স্বার্থে হরতাল চিরতরে বন্ধ করে দিন। নির্বাচন প্রশ্নে কোনো একটি ফর্মুলায় মতৈক্যে আসুন।
এ কে আজাদ বলেন, 'বর্তমানে দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা তিন কোটি। প্রতিবছর ২০ লাখ লোক কর্মবাজারে প্রবেশ করছে। তাই দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও জান-মালের নিরাপত্তার স্বার্থে হরতালের মতো সহিংস কর্মসূচি থেকে সব রাজনৈতিক দলকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা মনে করি, আমাদের মতো একটি দরিদ্র দেশে এভাবে হরতাল চলতে পারে না।' এ কে আজাদ আরো বলেন, 'দেশ যেভাবে পিছিয়ে পড়ছে, যেভাবে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, যেভাবে বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত হচ্ছেন, তাতে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ আসবে না। যখন দেশীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবেন না, তখন বিদেশি বিনিয়োগও আসবে না। ফলে বাংলাদেশ আরো শত বছর পিছিয়ে যাবে। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা দেশপ্রেমিক ও প্রগতিশীল। তাঁরা যেহেতু দেশকে ভালোবাসেন, সেহেতু দেশের অকল্যাণ হয় এমন কর্মসূচি তাঁরা দেবেন না বলে আমি মনে করি।'
জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী কাতসুয়া ওকাদা, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় একই সময় বাংলাদেশ সফর করবেন। তাঁদের কাছে ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক সহিংসতার বিষয়ে কিছু বলবেন কি না জানতে চাইলে এ কে আজাদ বলেন, 'দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। আমরা আমাদের সমস্যা সমাধান করব। বরং অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করতে এলে আমরা বিরোধিতা করব। কারণ এটি আমাদের আত্মমর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়।'
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদেরও ভূমিকা রাখা উচিত বলে উল্লেখ করে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, 'ব্যবসায়ীরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে নয়। এ বিষয়ে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছি। তবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে আমাদের ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়। আমরা সেটা নেব। ইতিমধ্যে একটি ফর্মুলার কথা শুনেছি, যেখানে সরকার ও বিরোধী দলের আটজন করে সংসদ সদস্য নিয়ে সরকার গঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অনির্বাচিত কারো কাছে ক্ষমতা দেব না। বিরোধী দল যদি সংসদে গিয়ে অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে তাদের প্রস্তাব অথবা অবস্থান তুলে ধরে তাহলে সমঝোতা হবে বলে আমার বিশ্বাস।'
দুই নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে ব্যবসায়ীরা কোনো চাপ প্রয়োগ করবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা চাপ প্রয়োগ করতে পারি না। আমরা আমাদের অবস্থা তাঁদের সামনে তুলে ধরব। আমরা ব্যবসা চালাতে পারছি না। দোকানপাট খুলতে পারছি না। হরতালের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন। সব কিছুর উৎস সাধারণ জনগণ। হরতালের কারণে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেউ হরতাল পছন্দ করে না। আমরা বিভিন্ন পেশার লোক যারা ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচিত করব, তারা ঐক্যবদ্ধ হলে আমার বিশ্বাস রাজনীতিবিদরা আমাদের কথা শুনবেন।'
এ কে আজাদ বলেন, 'সাবেক সভাপতিদের বৈঠকের আগেও আমরা এক দফা বসেছিলাম। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতিরা আমাকে ডেকেছিলেন। সবাই উদ্বিগ্ন। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। চার বছরের ব্যবধানে বাজেটের আকার দ্বিগুণ হয়েছে। রাজস্ব আদায় দ্বিগুণ হয়েছে। রপ্তানিতে গড়ে ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। পাঁচ বছরে এটা ৫০ বিলিয়ন ডলার হবে। বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আসতে চাইছেন।'
এ কে আজাদ আরো বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধিদল জাপানে গিয়েছিল। আমরা জাপানি ব্যবসায়ীদের এ দেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছিলাম। পাশাপাশি বাংলাদেশি পণ্য জাপানে নেওয়ার কথা বলেছিলাম। এর ফলোআপ হিসেবেই দুটি জাপানি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসেছিল বিনিয়োগ সম্ভাবনা দেখার জন্য। জাপান শুধু চীন থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। কিন্তু চীনে শ্রমের দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে জাপান চায় চীনের পাশাপাশি আরেকটি দেশে বিনিয়োগ করতে, যেখান থেকে তারা পণ্য আমদানি করবে।'
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, এ জন্যই জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছেন। এরই মধ্যে চীনের রাষ্ট্রদূত দুবার এফবিসিসিআইয়ের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি দুবারই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কথা আমাকে স্মরণ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে এরকম চলতে থাকলে জাপানি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আসবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বাংলাদেশের বিকল্প হিসেবে তারা মিয়ানমারকে নিয়ে ভাবছে।

No comments

Powered by Blogger.