জাবি ভিসি’র পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনশনে শিক্ষকরাও

জাকারিয়া পলাশ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে: ভিসি অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের পদত্যাগের দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশনে যোগ দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষকরাও। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে সশরীরে ক্যাম্পাসে এসে ভিসি’র পদত্যাগ দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের এমপি কবরী সারোয়ার নিজেও। অপরদিকে নানা অভিযোগ সত্ত্বেও পদত্যাগ না করে ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন ভিসি। অভিযোগ রয়েছে তিনি নিজ গ্রুপের শিক্ষকদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করেছেন। ভিসির পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনকারীরা আমরণ অনশন শুরু করেছেন গত মঙ্গলবার থেকে। ভিসির বাসার সামনে পৃথক দু’টি মঞ্চে মঙ্গলবার সকালে আমরণ অনশন শুরু করেন ৪ সংস্কৃতিকর্মী। গতকাল তাদের সঙ্গে যুক্ত হন ২ শিক্ষক। অনশনকারীরা হলেন নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোমা মুমতাজ, বাংলা বিভাগের শিক্ষক শামীমা সুলতানা, রাসেল রানা (বাংলা বিভাগ ৩৮তম ব্যাচ), জোবায়ের হোসেন (সরকার ও রাজনীতি ৪০), সাদিয়া জাফরিন (ফার্মেসি ৩৯) ও আতিয়া ফেরদৌস চৈতী (অর্থনীতি ৩৮)। এদিকে আন্দোলন ঠেকাতে মাঠে থাকা ভিসিলীগ ক্যাডারদের চাঙ্গা রাখতে চলছে নগদ টাকা বিতরণের মহড়া। আন্দোলনকারীদের দমন করতে গ্রেপ্তার, হামলা, ক্লাস-পরীক্ষায় দেখে নেয়ার হুমকি অব্যাহত রয়েছে। আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছেন সুশীল সমাজ। ভিসির আস্থাভাজন শিক্ষকরাও পরিত্যাগ করছেন তার সঙ্গ। ফলে দিন দিন একা হয়ে পড়ছেন শরীফ এনামুল কবির। পদত্যাগের প্রশ্নে এখন দায় চাপাচ্ছেন প্রেসিডেন্টের কাঁধে। গত ১লা এপ্রিল সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, কয়েকজন শিক্ষকের দাবির মুখে নয়, শিক্ষার্থীরা চাইলে পদত্যাগ করবো। শিক্ষার্থীদের অনশনের মুখে গতকাল বললেন, মহামান্য আচার্য চাইলে পদত্যাগ করবো। তার এমন বক্তব্যের জবাবে সংস্কৃতিকর্মী কামাল উদ্দিন রিমন বলেন, এরপর হয়তো ভিসি বলবেন, কোন মানুষ নয়, আল্লাহ চাইলে আমি পদত্যাগ করবো। ওদিকে আমরণ অনশনকারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষক সাবেক প্রো-ভিসি ও মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য অধ্যাপক তাজুল ইসলাম, নিউ এইজ-এর সম্পাদক নুরুল কবির, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সভাপতি হালিমা হোসেন, অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, অভিনেত্রী তারানা হালিম, বন্যা মির্জা, কণ্ঠশিল্পী কৃষ্ণকলি, লেখক সাইদিয়া গুলরুখ, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, মোশরেফা মিশু, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক, নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, বারিস্টার সারা হোসেন, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সাপ্তাহিক একতা সম্পাদক কে এম রাশেদা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ সাবেক শিক্ষক ও কলাম লেখক রেহনুমা আহমেদসহ বিভিন্ন সাহিত্যিক, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। মোবাইল ফোনে সংহতি জানান অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শম্পা রেজা, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সেওতি সবুর, বাংলার পাঠশালার আহমেদ জাবেদ রনি ও উদীচী’র সংগীতা ইসলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক জোট গতকাল নিজেদের ক্যাম্পাসে একটি মৌন মিছিল করে জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছে। গতকাল বিকালে ভিসির বাসার সামনে এসে আন্দোলনকারী এবং ভিসিপন্থি উভয় শিক্ষকদের সঙ্গে কখা বলেন কবরী সারোয়ার। একপর্যায়ে তিনি ভিসিপন্থিদের উদ্দেশ্যে ভিসিকে পদত্যাগ করার অনুরোধ করার দাবি জানান। এসময় ভিসিপন্থি শিক্ষক অধ্যাপক আমীর হোসেন কবরী সারোয়ারকে বলেন, বিএনপি তো প্রধানমন্ত্রীকেও পদত্যাগ করতে বলে। বিএনপি’র কথায় যদি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ না করেন তবে তাদের কথায় ভিসি পদত্যাগ করবেন কেন? এ প্রশ্ন শুনে কবরী সারোয়ার বলেন, আপনারা (ভিসিপন্থিরা) আওয়ামী লীগ করেন না। আওয়ামী লীগ করলে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে এত বড় কথা বলতে পারতেন না। আমি আজই এ বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করবো। এ সময় ভিসিপন্থি শিক্ষকরা চুপ হয়ে যান। এরপর ক্যম্পাস ত্যাগ করেন কবরী সারোয়ার। এর আগে সকাল আটটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাসির উদ্দিন অনশনরত সংস্কৃতি-কর্মীদের দেখতে আসেন। তিনি সেখানে উপস্থিত কর্তব্যরত চিকিৎসকদের সঙ্গে অনশনকারীদের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক শাকিলা শারমিন বলেন, না খেয়ে শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলেও ভিসি বাইরে না এসে পদ আঁকড়ে বাসার ভেতর  বসে আছেন। অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান বলেন, সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ কয়েকদিন আগেই নেয়া উচিত ছিল। এখন আর সময় নেই। এখন শিক্ষার্থীরা তাকে গুণ্ডা, সন্ত্রাসী বলছে। এটা খুবই লজ্জাজনক। তার পদত্যাগ করা উচিত। তিনি এখনও বসে থেকে ভিসি পদটির অসম্মান করছেন। এ পদকে করছেন কলঙ্কিত। নিউ এইজ সম্পাদক নুরুল কবির বলেন, অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আমরণ অনশনকে স্বাগত জানাই। এটা একটি যৌক্তিক আন্দোলন। সূত্র জানায়, ভিসিবিরোধী আন্দোলন দমানোর জন্য এতদিন ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর সুকল্যাণ কুণ্ডুর মাধ্যমে কর্মী প্রতি এক থেকে দুই হাজার টাকা বিতরণ করা হতো। গত সোমবার থেকে এ টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সিনিয়র কর্মীদের ২ হাজার, অন্যদের এক হাজার থেকে ৫শ’ করে নগদ টাকা দেয়া হচ্ছে। এ টাকা ভাগাভাগি নিয়ে মনোমালিন্য দেখা দিয়েছে। কোন কোন ছাত্রলীগ কর্মী টাকার ভাগ যথাযথ না পাওয়ায় মিছিল-সমাবেশ থেকে বিরত রয়েছেন। আন্দোলন বেগবান করতে ক্যাম্পাসে এসে ভিসির সঙ্গে মিটিং করছেন বহিরাগত সরকার আজগর আলী। তার নির্দেশে শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার ট্রান্সপোর্ট চত্বরে তিন শিক্ষার্থীকে হুমকি দেয়া হয়। বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন সঙ্কটে পড়বে বলে শাসিয়েছেন ভিসিপন্থি শিক্ষকরা। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, এরা ছাত্রলীগের কোন সাংগঠনিক নির্দেশনা মোতাবেক কোন কাজ করেন না। এদিকে ক্যাম্পাসে ভিসির আস্থাভাজন শিক্ষকরা গত রোববার থেকে ভিসির নানা অপকর্মের সমালোচনা করে বিবৃতি প্রকাশ করেছেন। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক পৃথ্বিলা নাজনীন, সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাজেদ আশরাফ করিম, অধ্যাপক হানিফ আলী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সভাপতি সহযোগী অধ্যাপক কেএম মহিউদ্দীন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ও নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম দুর্জয় বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রগতিশীল শিক্ষক। আমাদের মধ্যে কিছু নীতিবিবর্জিত অনুপ্রবেশকারী যোগ দিয়েছেন। এ কারণে আমাদের আদর্শ নষ্ট হয়েছে। এর ফল পুরো ক্যাম্পাস এমনকি গোটা দেশকে বহন করতে হচ্ছে। দলীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগ। আমরা এসবের প্রতিবাদ জানাচ্ছি। একই কারণে ভিসিপন্থি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবদুলাহেল কাফী, আইআইটির সহযোগী অধ্যাপক ফজলুল করিম পাটোয়ারীসহ ইতিহাস বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক ভিসির গ্রুপ পরিত্যাগ করছেন বলে জানা গেছে। একজন সহকারী প্রক্টর পদত্যাগপত্র প্রস্তুত করে রেখেছেন বলে ক্যাম্পাসে গুজব রয়েছে। সমস্যা সমাধানের জন্য গত মঙ্গলবার ক্যাম্পাসে আসেন সংসদ সদস্য ও সিনেট সদস্য তারানা হালিম। তিনি উভয় পক্ষের শিক্ষকদের সঙ্গে এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। তিনি আন্দোলনরত শিক্ষকদের কাছে বিষয়টি সমাধানের জন্য ১৫ দিনের সময় চান। কিন্তু আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সাফ জানিয়ে দেন, আলোচনার জন্য ৪ মাস সময় দিয়েছিলাম। ভিসি এতদিন টালবাহানা শুরু করেছেন। এখন আর আলোচনার কোন সুযোগ নেই। ভিসির পতনই সব সমস্যার সমাধান করতে পারে। তারানা হালিম বলেন, আমি সরকারের পক্ষ থেকে নয় সিনেট সদস্য হিসেবে নিজের দায়বদ্ধতা থেকে ক্যাম্পাসে এসেছি। আমি উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছি। বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে দেবো। গতকাল বেলা ১২টার দিকে দুই সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর একটি বিক্ষোভ মিছিল ক্যাম্পাসের প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে। এসময় ‘পদত্যাগ’ ‘পদত্যাগ’ স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। দুপুর ১টার দিকে সংজ্ঞা হারান অনশনকারী শিক্ষার্থী রাসেল রানা। তাকে এম্বুলেন্সযোগে সাভারে গণস্বাস্থ্যনগর হাসপাতালে পাঠানো হয়। জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের কর্মী রাসেল বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। মঙ্গলবার অনশন শুরুর আগে শপথ বাক্য পাঠ করেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক ঘটে যাওয়া অন্যায় অপকর্ম-অনিয়ম-দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মদতদাতা ভিসির পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত অনশন চলবে। অন্যান্য দিনের মতো গতকালও ভিসিপন্থি ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত শেখ শরীফ উদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান লিটনে নেতৃত্বে ভিসি ভবনের সামনে মহড়া দিতে দেখা গেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। গতকাল সন্ধ্যায় আন্দলনরত শিক্ষকরা এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন ভিসি তার গ্রুপের শিক্ষকদের নাম জালিয়াতি করেছেন। তারা জানান, ৩০শে এপ্রিল ভিসিপন্থি শিক্ষকদের স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পায়। এতে প্রেসিডেন্টের কাছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়। ওই তালিকায় শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানোর জন্য একই শিক্ষকের একাধিক স্বাক্ষর দেয়া হয়, বিদেশে অবস্থানকারী শিক্ষকদের অন্য কোন সময়ের স্বাক্ষর এই সময়ে চালিয়ে দেয়া হয়। স্বাক্ষর দেননি এমন শিক্ষকের নামও তালিকাবদ্ধ করা হয়। দর্শন বিভাগের সৈয়দ নিজার আলম, বাংলা বিভাগের খালেদ হোসাইন, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের কেএম মহিউদ্দীন, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের আবদুল মান্নান চৌধুরী কোন স্বাক্ষর না দিলেও তাদের স্বাক্ষর দেখানো হয়েছে। এভাবে প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষকের নামের স্বাক্ষর জালিয়াতি করা হয়েছে। গণিত বিভাগের মো. ওসমান গণি বিদেশে অবস্থান করলেও তার স্বাক্ষর দেখানো হয়েছে। অর্থনীতি বিভাগের জাহাঙ্গীর আলম, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শেখ মনজুরুল হক, দর্শন বিভাগের সৈয়দ নিজার আলমের স্বাক্ষর দু’বার করে দেখিয়ে সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। শেষোক্ত দু’জনের দু’বার উল্লিখিত নামের স্বাক্ষর ভিন্ন রকম দেখা গেছে। এ ঘটনাকে শিক্ষকদের সঙ্গে প্রতারণা ও জোচ্চুরি বলে অভিযোগ করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষক মানস চৌধুরী।

No comments

Powered by Blogger.