চলতি পথে-তীব্র বেদনা অক্ষত থাকে অন্তরে by দীপংকর চন্দ

বাটাজোর বাজার থেকে হাঁটাপথে একটু এগোলেই শীর্ণ একটি খালের দেখা মেলে। আড়ম্বরহীন একটি সেতু সেই খালের ওপর। ছোট্ট সেই সেতুটি পার হলাম আমরা। বরিশাল সদর অভিমুখী পথের বাঁ পাশে বাটাজোর অশ্বিনীকুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়।


নামেই বোঝা যায়, এই বিদ্যালয়টি আধুনিক বরিশালের প্রাণপুরুষ মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের স্মৃতিতে স্থাপিত। পথের মায়া কাটিয়ে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রবেশ করি আমরা। ইতস্তত ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি অশ্বিনীকুমার দত্তের কথা।
অশ্বিনীকুমার দত্তের পৈতৃক বাড়ি গৌরনদী উপজেলার বাটাজোরে। তাঁর বাবা ব্রজমোহন দত্ত যখন পটুয়াখালীতে কর্মরত ছিলেন, তখনই অর্থাত্ ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি পটুয়াখালীর লাউকাঠি চৌকিতে জন্মগ্রহণ করেন অশ্বিনীকুমার দত্ত। পেশাগত কারণে বিভিন্ন স্থানে বাবার বদলির সুবাদে পটুয়াখালী, বিষ্ণুপুর, রংপুরের বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করলেও অশ্বিনীকুমার দত্ত ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা থেকে অতিক্রম করেন মাধ্যমিক শিক্ষার গণ্ডি। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাস করেন এফএ। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণনগর কলেজে বিএ পড়ার সময় নথুল্লাবাদের মীর বহর পরিবারের কায়স্থ-কন্যা সরলা বালাকে বিয়ে করেন তিনি। ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ এবং ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে বিএল পাস করেন অশ্বিনীকুমার দত্ত।
শিক্ষা গ্রহণের পর স্বাভাবিকভাবেই চাকরি করবেন অশ্বিনী; কিন্তু বাদ সাধলেন তাঁর বাবা ব্রজমোহন দত্ত। তিনি অশ্বিনীকে ইংরেজদের গোলামি না করার নির্দেশ দিলেন। বাবার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন অশ্বিনীকুমার দত্ত। তিনি শাসকগোষ্ঠীর গোলামির প্রলোভন উপেক্ষা করে ওকালতি শুরু করলেন। কলকাতার উন্নত জীবনের হাতছানি এড়িয়ে ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে অশ্বিনীকুমার দত্ত পেশাগত জীবন শুরু করলেন বরিশাল জজকোর্টে। সত্ ও ন্যায়বান উকিল হিসেবে অচিরেই খ্যাতি অর্জন করলেন তিনি, সেই সঙ্গে শুরু করলেন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন যুগপত্ভাবে। সামাজিক আন্দোলনের অত্যাবশ্যকীয় অংশ হিসেবে ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বরিশাল শহরে তিনি তাঁর বাবার নামে বিএম স্কুল স্থাপন করলেন। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে একটি বালিকা বিদ্যালয় এবং ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করলেন বিএম কলেজ। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের কল্যাণ কামনায় তিনি গঠন করেন জনসমিতি, বাখেরগঞ্জ হিতৈষিণী সভা, নেত্রী সংঘসহ বেশ কিছু পথনির্দেশক সংগঠন। এসব কাজে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি পেশাগত জীবন সম্পর্কে পুনরায় ভাবলেন অশ্বিনী। ওকালতিতে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় বলে আইন পেশা পরিত্যাগ করলেন তিনি। এবার ব্যক্তিমানুষ হিসেবে সম্পূর্ণ স্বাধীন অশ্বিনী জোরালোভাবে রাজনীতিতে মনোনিবেশ করলেন। ১৯০৩ সালে বঙ্গ-ব্যবচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র করলেন লর্ড কার্জন। বিভাগপূর্ব বাংলাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। অশ্বিনীকুমার দত্তের নেতৃত্বে বরিশালেও শুরু হলো আন্দোলন। ১৯০৪ সালে বঙ্গ-ব্যবচ্ছেদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তিনি তা পাঠালেন ইংরেজ সরকারের কাছে। কিন্তু সরকার নির্বিকার! সুতরাং আন্দোলন ভিন্ন পথে পরিচালনার প্রয়োজন দেখা দিল। ১৯০৫ সালের শুরু থেকেই মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভ, সমাবেশে উত্তাল হলো বরিশাল। আন্দোলনের তীব্রতা অতিক্রম করল ইংরেজ সরকারের সহনশীলতার মাত্রা। ১৯০৮ সালে গ্রেপ্তার করা হলো অশ্বিনীকুমার দত্তকে। রেঙ্গুন ও আগ্রায় তাঁকে অন্তরীণ রাখা হলো দুই বছর। বন্দিদশা থেকে ১৯১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তি লাভ করলেও স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ল অশ্বিনীকুমার দত্তের। চিকিত্সার জন্য কলকাতায় গেলেন তিনি। ১৯২৩ সালের ৭ নভেম্বর চিকিত্সাধীন অবস্থায় মৃত্যুর কাছে সমর্পিত হলো বরিশালের প্রাণপুরুষ মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের মহাপ্রাণ।
বাটাজোর অশ্বিনীকুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দক্ষিণে বিশাল মাঠ। সেই মাঠের এক কোণে অশ্বিনী মঞ্চ। বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক কৃষ্ণকান্ত হাওলাদার জানালেন, এই মঞ্চকে কেন্দ্র করে ১৯৯৭ সালে বরিশাল ব্রজমোহন থিয়েটারের উদ্যোগে বাটাজোরে আয়োজন করা হয় অশ্বিনী মেলার। বিরামহীন না হলেও বেশ কয়েক বছর আয়োজিত হওয়ার পর হঠাত্ বন্ধ হয়ে যায় সর্বস্তরে আলোড়ন সৃষ্টি করা এই মেলা! কিন্তু কেন? মেলা বন্ধ হওয়ার কারণ জানতে চাই আমরা। প্রত্যুত্তরে কেন জানি নীরবতাকেই শ্রেয় মনে করেন কৃষ্ণকান্ত হাওলাদার। সুতরাং বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে অন্যদিকে হাঁটি আমরা। বাটাজোর বাজার থেকে চন্দ্রহার বাজারের দিকে যেতে যেতে অশ্বিনীকুমার দত্তের পৈতৃক বাড়িটির খোঁজ করি। কিন্তু পাওয়া যায় না সেই বাড়ির খোঁজ। কেন? এ প্রশ্নের উত্তরও খুঁজি আমরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার কয়েকজন আমাদের জানান, বাড়িটি এখন আর নেই! ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আইনবহির্ভূত, অবৈধ পন্থায়। অশ্বিনী দত্তের পৈতৃক জায়গা-জমিও বিলীন হয়ে গেছে প্রভাবশালী মহলের করাল গ্রাসে! কিন্তু কী পরিচয় এই প্রভাবশালী মহলের? পুনরায় প্রশ্ন করি নম্রস্বরে। কিন্তু প্রত্যুত্তরে এবারও নীরবতাকেই শ্রেয় মনে করেন এলাকার মানুষ। সুতরাং বাধ্য হয়েই ফেরার পথ ধরি আমরা। অশ্বিনী দত্তের পৈতৃক বাড়িটি দেখতে না পাওয়ার তীব্র বেদনা আমাদের অন্তরে অক্ষতই থাকে!

No comments

Powered by Blogger.