ভূমিকম্প-হাইতি থেকে ঢাকা: বিপর্যয়ের ঘণ্টা বাজছে by ফারুক ওয়াসিফ

মাছের মায়ের নাকি পুত্রশোক নেই। মাছ প্রসব করে হাজারে হাজারে ডিম, তার মধ্যে কোনটি মরল আর কোনটি ফুটল তার হিসাব কে রাখে? এই পৃথিবীর সন্তানসংখ্যা ৬০০ কোটি, তার মধ্যে দুই-তিন লাখ মানবসন্তান যদি এক লহমায় মরেও যায়, মা পৃথিবী কি তাতে কাঁদে? আসলে পৃথিবীর মা-বাপ নেই,


থাকলে হাইতিতে এক ভূমিকম্পেই দুই লাখেরও বেশি মানুষ এভাবে মরতে পারত না, আহত ও মানবেতর অবস্থায় কাতরাত না আরও ৩০ লাখ মানুষ। প্রতিটি মৃত্যুই মানবতার মৃত্যু।
যুদ্ধ, মহামারিসহ প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিপর্যয়গুলো চিরকালই দরিদ্রপ্রেমী। হাইতির মতো দরিদ্র ও অনুন্নত দেশ যেকোনো বিপর্যয়ের সহজ শিকার হতে বাধ্য। যে সাত মাত্রার ভূমিকম্পে হাইতির রাজধানী ধূলিতে মিশে গিছে, সেই মাত্রার ভূমিকম্পে নিউইয়র্ক বা সানফ্রানসিসকো এভাবে ধসে যেত না। আজ হাইতিতে যা দেখছি তা হাইতির দীর্ঘ বিদেশি শোষণ, দুর্নীতি ও অপশাসনের ফল। আমেরিকা হাইতিকে ‘ক্যারিবিয়ার তাইওয়ান’ বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু হাইতি কেবল বিশ্বের দরিদ্রতম দেশই নয়, এক অকার্যকর রাষ্ট্রের আদর্শ মডেল। মার্কিন মডেলের উন্নয়ন দেশটিকে আরও দরিদ্র করে ফেলে। লাখ লাখ কৃষক গ্রামাঞ্চল থেকে জমি হারিয়ে ভিড় জমায় রাজধানীতে—আমাদের ঢাকার মতোই। বস্তি বাড়তে থাকে, বাড়ির ওপর বাড়ি উঠতে থাকে। তারপর ২০ সেকেন্ডের এক ভূমিকম্পে তাসের ঘরের মতো মাটিতে লুটায়। তার নিচে পড়ে থাকে লাখ লাখ মানুষ। মানুষের জীবন একটাই, সেই জীবন এভাবে অকাতরে ভয়াবহভাবে শেষ হয়ে যাওয়ার থেকে বড় হতাশা আর কী আছে?
হাইতি এক দুর্ভাগা দেশ। স্পেনীয় অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাসের এই দ্বীপদেশে পা ফেলার দিন থেকেই হাইতির দুর্ভাগ্যের শুরু। প্রথমে স্পেনীয়, পরে ফরাসিরা দেশটিকে উপনিবেশ বানায়। সোনাসহ এখানকার খনিজ সম্পদ পাচার হয়ে যায় ইউরোপে। ইউরোপীয়দের নিয়ে আসা রোগ ও মহামারিতে মৃত্যু হয় অজস্র মানুষের। দখলদারদের বর্বরতায় হাইতি প্রায় জনশূন্য হতে বসে। আফ্রিকা থেকে প্রায় আট লাখ মানুষ ধরে এনে দাস বানিয়ে খাটানো হয় খামারে ও খনিতে। হাইতিবাসী মাথা নত করেনি। বারবার বিদ্রোহ করেছে তারা। অবশেষে ফরাসি বিপ্লবের সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৮০৪ সালে হাইতি স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তাহলেও ১৯৪৭ পর্যন্ত হাইতিকে দাসদের মূল্য বাবদ বাজেটের ৮০ শতাংশই পরিশোধ করতে হয়। হাইতিই একমাত্র দেশ, যেখানে প্রথম কোনো দাসবিদ্রোহ জয়ী হয় এবং স্বাধীনতা আসে। এ কারণে হাইতির বিপ্লব ফরাসি বিপ্লবের মতোই গুরুত্ববহ। হাইতি লাতিন আমেরিকার প্রথম স্বাধীন দেশ এবং পশ্চিম গোলার্ধে আমেরিকার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও, গোড়া থেকেই হাইতি মার্কিন আগ্রাসনের শিকার হয়ে এসেছে।
১৯১১ সালে হাইতির একমাত্র কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সরকারি কোষাগার এবং ১৯১৬ সালে ঋণের অজুহাতে গোটা দেশটিই দখল করে নেয় আমেরিকা। ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত এই নৃশংস দখলদারি কায়েম থাকে। দখলাধীন ইরাকের কায়দায় মেরিন সেনারা দেশটিতে পুতুল সরকার ও মার্কিনপসন্দ সংবিধান প্রতিষ্ঠা করে। ওই সংবিধানে হাইতির ভূমি বিদেশিদের মালিকানায় দেওয়ার বিধান রাখা হয়। কিন্তু হাইতির সংসদ এটা পাস করতে রাজি না হওয়ায় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। অধিকাংশ হাইতিয়ানকে প্রায় দাসত্বের মধ্যে কাজ করতে হয় মার্কিন মালিকানার চিনি ও কফির খামারগুলোতে। কৃষি উত্পাদন থেকে সরিয়ে তাদের নিয়ে আসা হয় রপ্তানিমুখী অর্থনীতিতে। এভাবে মার্কিন রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসনে হাইতি নিঃশেষ হয়ে যায়।
হাইতির জনগণ যতবার বিদ্রোহ করেছে, ততবারই মার্কিন মদদপুষ্ট সেনা অভ্যুত্থান কিংবা সরাসরি মার্কিন সেনা দিয়ে তা দমন করা হয়। বারবার উচ্ছেদ করা হয় নির্বাচিত সরকারকে। ১৯৫৭—১৯৮৭ পর্যন্ত চলে স্বৈরশাসন। ১৯৮৭ সালের গণ-আন্দোলনে তার পতন ঘটে। এরপর থেকে একবার সামরিক শাসন, তারপর তিন-চার মাসের নির্বাচিত সরকার—এভাবেই চলছে হাইতি। ১৯৯০-এর পর প্রতিটি নির্বাচনে জনপ্রিয় লাভালাস আন্দোলন জয়ী হলেও সরকার চালাতে দেওয়া হয়নি। শেষ নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট অ্যারিস্টিডকে মার্কিন মদদে উচ্ছেদ করে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট প্রেভালও দেশ শাসন করছেন ফরমানবলে। হাইতি আমাদের শেখায়, যে সরকার শান্তিকালে জনগণের ভালো করে না, দুর্যোগের সময় সেই সরকার জনগণকে বাঁচাতে পারে না।
এ রকম বিপন্ন দেশ যেমন নিজে থেকে দুর্যোগ মোকাবিলায় অক্ষম থাকে, তেমনি বাইরের সাহায্য নিতে গিয়ে অপরের স্বার্থের কাছে বলিও হয়। এখন হাইতির বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ করছে মার্কিন সেনারা, বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের নামে রাজপথেও তারা। হাইতির পথে রওনা হয়েছে ১০ হাজার সদস্যের সামরিক বাহিনী। কেবল ত্রাণই তাদের উদ্দেশ্য নয়। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রভাবশালী চিন্তাশালা ও লবি হেরিটেজ ফাউন্ডেশন বলছে, ‘এই ভূমিকম্পে একই সঙ্গে মানবিক ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তাগত প্রায়োগিকতা রয়েছে।’ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মানবিক সাহায্য ও উন্নয়নের নামে এভাবেই বড় রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তাগত স্বার্থের কাছে বিশ্বের অনেক দেশই অসহায়। মার্কিন গণমাধ্যম এই চিত্র আড়াল করে হাইতির জনসংখ্যাকেই এই দুর্যোগের জন্য দায়ী করছে। তাদের প্রতি আমাদের কেবল কবি মিল্টনের এই কথাটিই বলবার রয়েছে, ‘যারা জনগণের চোখ উপড়ে নিয়েছে, তারাই আজ তাদের অন্ধত্বের জন্য দোষারোপ করছে।’

দুই.
তার পরও ঢাকায় বসে, ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে থাকা পৌনে দুই কোটির বেশি জনসংখ্যার এই মহানগরে হাইতির জন্য সমবেদনার পাশাপাশি নিজেদের জীবন নিয়ে আতঙ্ক ঠেকাতে পারি না। এ দেশে শেষ বড় আকারে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটি ঘটে ১৮৯৭ সালে। ঢাকার বেশির ভাগ ভবন সে সময় ধসে পড়ে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয় ১৯৩৪ ও ১৯৫০ সালে। আর গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসেই ছয় মাত্রার ওপরে দুটি ভূমিকম্প হয়েছে দেশে। জাতিসংঘের ১৯৯৯ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, তেহরানের পর ঢাকাই সবচেয়ে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা নগর।
ঢাকার অবস্থান ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার মধ্যে। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ঢাকার সাড়ে তিন লাখ ভবনের দুই লাখকেই ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে। প্রকৌশলীদের মাধ্যমে নির্মিত ভবনগুলোর ৬০ শতাংশও ঝুঁকির বাইরে নয়। ঢাকার বসুন্ধরা ও বনশ্রী আবাসিক এলাকা সবচেয়ে নাজুক বলেছে সিডিএমপির এক প্রতিবেদন। এ কথা সর্বজনবিদিত যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়ে। অল্প জায়গায় বেশি ভবনের ভারে ঢাকার মাটি দেবে যাচ্ছে, অতিমাত্রায় পানি তুলতে থাকায় পাতালস্তরে শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে ভূমিকম্পের বড় চারটি উত্স: মেঘালয় ৮ মাত্রার, ত্রিপুরা ৭ মাত্রার, সার-ডাউফি ৭ দশমিক ৩ মাত্রার এবং বগুড়া ৭ মাত্রার। সম্প্রতি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে সক্রিয় ফাটল পাওয়া গেছে। বিশেষত ঢাকার কাছে মধুপুর অঞ্চলটি বেশি বিপজ্জনক। ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের নাজুকতা আর সরকারি অবহেলা ও দুর্যোগ মোকাবিলার সামর্থ্যহীনতার জন্য ঢাকা এখন সব দিক থেকেই এক বিপন্ন নগর।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার বেশির ভাগ ভবনই ভূমিকম্পসহ প্রযুক্তিতে নির্মিত নয়। ঢাকার ৫৩ শতাংশ ভবন দুর্বল অবকাঠামোর ওপর স্থাপিত, ৪১ শতাংশ ভবনের ভরকেন্দ্র নড়বড়ে, ৩৪ শতাংশ ভবনের থাম ও কলাম দুর্বল। জাতিসংঘের আইএসডিআর নামক সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ঢাকার বৃহত্ কংক্রিট নির্মিত ভবনের ২৬ শতাংশের বেলাতেই প্রকৌশলগত বিধিমালা অনুসরিত হয়নি। অন্য একটি গবেষণায় বলা হয়, ৯০ শতাংশ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ (ডেইলি স্টার, ১৩ আগস্ট, ২০০৯) যে হারে ও যে গতিতে বিল-নদী-জলাশয় ভরাট করে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, হাউজিং, আবাসন ইত্যাদি হচ্ছে, তাতে বিপন্ন ঢাকা আরও বিপন্নই হচ্ছে। আবাসন সংস্থাগুলো ভবন তুলেই খালাস। ১০-২০ বছর পর এগুলোর কী হবে, কিংবা এগুলো ভূমিকম্প সহ্য করতে পারবে কি না, সেই বিবেচনা তাদের আছে বলে মনে করার কারণ নেই। সরকারি উদ্যোগে নির্মিত ভবনগুলোতে দুর্নীতির ও নির্মাণে ফাঁকিঝুঁকি তুলনাহীন। খোদ যমুনা সেতুতেই ফাটল ধরেছে, সেখানে ঢাকা শহরের ইমারতগুলো তো কোন ছার!
ভাবতেও ভয় হয়, ৭ কি ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ঘিঞ্জি ভবন ও তার মধ্যে বাস করা কোটি কোটি মানুষের কী হবে? এমনকি এ রকম ভূমিকম্পের পর যারা বেঁচে থাকবে, তাদের উদ্ধার করা ও বাঁচানো হয়ে পড়বে কঠিন। সরু সরু রাস্তা আটকে যাবে, উদ্ধার করার মতো লোকবল-যন্ত্রপাতি মিলবে না। যখন সবাই-ই বিপন্ন হবে, তখন কে কাকে বাঁচাবে?
সেটা যদি হয়, তখন মৃতের সংখ্যা গুনতে হবে লাখের হিসাবে। সমাজের মতোই প্রকৃতির দুর্যোগও সবচেয়ে দুর্বলদেরই আঘাত হানে। অভিজ্ঞতা বলে, কোটি কোটি দরিদ্র মানুষই হবে তার সহজ শিকার। আমাদের এই সুখের আশা, একবারের জন্য পাওয়া মানবজীবন, সব এমনই তুচ্ছ হয়ে আছে আমাদের সরকারগুলোর জিম্মাদারিতে। সমস্যা ও বিপন্নতার পাহাড়ে বসে আশার ছলনায় ভোলানো আর কত? বড় রদবদলের জন্য বড় উদ্যোগ চাই, মামুলি খুটখাট দিয়ে ঢাকাকে বাঁচানো আর কাঠি দিয়ে পাহাড় নড়ানোর চিন্তা সমান কথা। কোটি মানুষের জীবন নিয়ে উদাসীনতা তাই অপরাধ।
ইংরেজ কবি জন ডানের বহু পুরাতন সেই হুঁশিয়ারি তাই আবারও জানাই, ‘যেকোনো মৃত্যু আমারো মৃত্যু। আমি মানবতার অংশ, তাই ঘণ্টা কার জন্য বাজে জানতে কাউকে পাঠিও না; জেনো, ঘণ্টা তোমার জন্যই বাজে। হাইতির মৃত্যু তাই খুব দূরে নয়, মৃত্যুপুরীর পাগলা ঘণ্টা ঢাকা শহর থেকেও শোনা যায়।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.