পল্লী বিদ্যুতের মূল্যহার নির্ধারণে গণশুনানি by ড. এম শামসুল আলম

পল্লী বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাব এখন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) বিবেচনাধীন। ২৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য গণশুনানিতে এ প্রস্তাব যাচাই-বাছাই হবে। গত ১৬ এপ্রিল সারা দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা তৃণমূল পর্যায়ে সমীক্ষা চালাতে বিভিন্ন শ্রেণীর গ্রাহকের আঙ্গিনায় গিয়েছিলাম।


কী ধরনের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির মধ্যে তাঁরা আছেন এবং কিভাবে বিদ্যুৎ সংকট তাঁরা মোকাবিলা করছেন, তা নিজ চোখে দেখে এবং ভুক্তভোগীদের মুখের কথা শুনে অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি। এ সময় দেখা হয়েছে, জানা হয়েছে বিভিন্ন শ্রেণীর গ্রাহকসহ নূ্যনতম বিলদাতা আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের পরিস্থিতি। তাঁদের মাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ ব্যবহারের সীমা যথাক্রমে ২০ শডয এবং ১৫ শডয। এ সীমার মধ্যে যত কমই তাঁরা বিদ্যুৎ খরচ করুন না কেন, আবাসিক গ্রাহক বিদ্যুতের জন্য বিল দেবেন ৬৫ টাকা। সেই সঙ্গে সার্ভিস চার্জ ছয়, ডিমান্ড চার্জ আট, ভ্যাট পাঁচ ও মিটার ভাড়া ১০ টাকা। মোট ৯৪ টাকা। মাসিক বিলে দেখা যায়, বেশির ভাগ গ্রাহকই মাসে পাঁচ থেকে ১০ এককের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করেননি। সাক্ষাতে এসব গ্রাহক বলেছেন, দিনে তাঁরা বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন না। সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ পান না। কুপি জ্বালিয়ে রাতে নামাজ আদায় করেন। এসব গ্রাহকের বাড়িতে দুই-তিনটি বাতি, কোনো কোনো বাড়িতে এক-দুটি ফ্যান আছে। এসব বাড়িতে এখনো এনার্জি বাল্ব পেঁৗছায়নি। যেসব বাড়িতে টিভি চলে, তাঁদের বিদ্যুৎ খরচের পরিমাণ ৫০ এককের নিচে নয়। সেই সঙ্গে ফ্রিজ আছে এমন গ্রাহকের বিদ্যুৎ খরচ ১৫৫-১৭০ একক। সকালে, দুপুরে, বিকেলে আমি যখনই যে বাড়িতে গিয়েছি, সেখানেই দেখেছি, হয় বিদ্যুৎ নেই, না হয় আমার চোখের সামনেই বিদ্যুৎ চলে গেছে অথবা ফিরে এসেছে। বিদ্যুতের এমন আসা-যাওয়া আমি এর আগে কখনো দেখিনি। এ পরিস্থিতি নিজ চোখে না দেখলে আমার পক্ষে তা কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। বেশির ভাগ বাড়িতে আমি মহিলাদের মুখোমুখি হই। বিদ্যুতের এ বিপর্যয়ে তাঁরা প্রায় সবাই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ, কারণ বিদ্যুতের অভাবে তাঁদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতে পারে না। 'নাহিদ টেলিফোন' একটি ক্ষুদ্র দোকান। এ দোকানে রয়েছে একটি ফ্যান ও দুটি এনার্জি বাল্ব। গত মার্চ মাসে বিল দিয়েছে বিদ্যুতের জন্য নূ্যনতম চার্জ ৯৫ টাকা। সেই সঙ্গে দিয়েছে সার্ভিস চার্জ ছয়, ডিমান্ড চার্জ ২২, ভ্যাট সাত ও মিটার ভাড়া ১০ টাকা। মোট ১৪০ টাকা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নূ্যনতম বিলদাতা আবাসিক ও বাণিজ্যিক বেশির ভাগ গ্রাহকের মাসে পাঁচ অথবা ১০ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচের বিপরীতে এই নূ্যনতম বিল প্রদান করে থাকে। এই দোকানমালিক অভিযোগ করেছেন, মিটার কেনা সত্ত্বেও তাঁকে প্রতি মাসে বিলের সঙ্গে মিটার ভাড়া দিতে হচ্ছে।
দেখলাম, অজপাড়াগাঁয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় দুটি চালাঘরে মুরগির খামার গড়ে উঠেছে। তাতে বৃদ্ধ মা, বউ ও বাসুদেব চন্দ্র নিজে দিন-রাত শ্রম দেন। আমি যখন তাঁদের বাড়ির আঙ্গিনায় পেঁৗছাই, তখন বেলা পড়ে এসেছে। দেখি, বৃদ্ধ মা মুরগির জন্য খাবার তৈরি করছেন। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনই আমার সামনে এসে দাঁড়ান। 'মুরগিতে কেমন লাভ হয়'_আমার এ প্রশ্নে মহিলার মুখে মলিন হাসি ফুটে ওঠে। জবাবে বলেন, 'আমরা খেটে খাই...।' 'বিদ্যুৎ কেমন পান?' এ প্রশ্নের জবাবে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, 'বিদ্যুৎ থাকলে একটু ফ্যানের বাতাস দিতে পারতাম, তাহলে কী আর আমার দুটি মুরগির বাচ্চা গরমে মারা যেত!' তিনি আরো জানান, বাল্ব জ্বেলে তাপ দিতে না পারায় শীতেও মুরগির বাচ্চা এমনিভাবে মারা যায়। মহিলার এসব কথা শুনে বার্ড ফ্লুতে তাঁর কেমন ক্ষতি হয়েছে, তা জানার মতো সাহস তখন আর আমার ছিল না। এই যদি অবস্থা হয়, গরম ও শীতে যদি ঠিকমতো বিদ্যুৎ না মেলে, তাহলে এসব খামার টিকে থাকবে কী করে? তখন আমি অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে, বার্ড ফ্লুর মতো মড়ক এবং অতি শীত-অতি গরমের মতো অবস্থা মোকাবিলা করে এসব মুরগির খামার এখনো টিকে আছে কিভাবে! তাই মুরগির মাংস ও ডিম তুলনামূলক কম দামে এখনো পাওয়া যায় এসব গ্রামীণ ক্ষুদ্র খামারের কারণে। এ বিষয়টি আগে কখনো এভাবে খেয়াল হয়নি।
গ্রামের মধ্য দিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের রাস্তা। তার দুই ধারে বাজার বসেছে। পল্লী বিদ্যুতের কারণে সেসব বাজার শহরে পরিণত হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে নানামুখী নাগরিক সুবিধাদি। ফলে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় ব্যবসা-বাণিজ্য ও কলকারখানা। এমন একটি বাজার বা উপজেলা সদরে যখন হাজির হই, তখন তাপদাহ দুপুর। গরমে মুখমণ্ডল জ্বলে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় একটি ছোট ওয়ার্কশপের সামনে গিয়ে দাঁড়াই এবং তার মালিকের মুখোমুখি হই। এত গরমেও পাখা চালু ছিল না। ওয়ার্কশপের কাজও চলছিল না। পরিবেশ এমন ছিল যে বিদ্যুৎ আছে কি নেই, তা জানার সাহস হয়নি। প্রশ্নোত্তরে জানা যায়, তাঁকে দিনে দুই থেকে পাঁচ ঘণ্টা অনির্ধারিত লোডশেডিং মোকাবিলা করতে হয়। তা ছাড়া বিদ্যুতের আসা-যাওয়া অনিয়ন্ত্রিত ও অনিশ্চিত। এ অবস্থায় তিনি বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ১০ কেভিএ ডিজেল জেনারেটর কিনেছেন। দিনে গড়ে খরচ হয় ১০ লিটার ডিজেল। বিদ্যুতের এ অবস্থার কারণে ছোটখাটো কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। ওয়েল্ডিংয়ের কাজ আর করেন না। বিদ্যুৎ বিলে দেখা যায়, বিদ্যুৎ খরচ হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে ১১৫ একক, মার্চ মাসে ১৪০ একক। অন্যান্য চার্জ বাদে শুধু বিদ্যুৎ বিল হয়েছে এই দুই মাসে যথাক্রমে ৫৩২ এবং ৬৮০ টাকা। এ বিলগুলো তখনো পরিশোধ করা হয়নি।
অটো ব্রিক মিলের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি দেখলাম। গত ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখে দিনে মিলটি চলেছে আট ঘণ্টা। তার মধ্যে বিদ্যুতের অভাবে ডিজেল জেনারেটর চালাতে হয়েছে এক ঘণ্টা ১৮ মিনিট। গত ১১ এপ্রিল সেখানে ডিজেল জেনারেটর চলেছে দুই ঘণ্টা ১৭ মিনিট। ওই মিলে ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৭২ হাজার ইট তৈরি হয়। বিদ্যুতের অভাবে জেনারেটর চালাতে ঘণ্টায় ব্যয় হয় ৪০ লিটার ডিজেল। প্রতি ইটে খরচ হয় ডিজেলের জন্য ০.২৭ টাকা এবং বিদ্যুতের জন্য ০.১৫ টাকা। গত মার্চ মাসে শুধু বিদ্যুতের জন্য এ মিল বিল দিয়েছে এক লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৪ টাকা। এখানে স্থায়ী জনবল ১০ জন এবং কর্মভিত্তিক শ্রমিক ১০০ জন।
লোকালয় ছেড়ে কাঁচা-পাকা রাস্তা পেরিয়ে বন-জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে কৃষি ব্যাংকের অর্থায়নে জনবসতি বিরল পাহাড়ি পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর এক মুরগির হ্যাচারির গেটে যখন উপস্থিত হলাম, তখন বিকেল। অবয়ব দেখে এ প্রতিষ্ঠানকে ফার্ম বলতে মন চায়নি। এখানকার বেশির ভাগ কার্যক্রমই যান্ত্রিক ও স্বয়ংক্রিয়। সে জন্য অনেক আধুনিক স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি সেখানে রয়েছে। তা ব্যবহারে বিরতিহীন প্রচুর বিদ্যুৎ দরকার। আরইবি তার এ গ্রাহককে বিরতিহীন বিদ্যুৎ দিতে পারেনি। চাহিদা ৩৫০ থেকে ৪০০ কিলোওয়াট। চার ইউনিটে এরও বেশি পরিমাণ তাদের ক্যাপটিভ ডিজেল বিদ্যুৎ রয়েছে। এ খামারে সপ্তাহে দুই লাখ মুরগির বাচ্চা ফোটানো হয়। এ মুরগি পালন ও বাজারজাত তৃণমূল পর্যায়ে গড়ে ওঠা ছোট ছোট খামারের ওপর নির্ভরশীল। ডিলারের মাধ্যমে এসব হ্যাচারি থেকে ওইসব খামার মুরগির বাচ্চা পায়। টেকসই বাজার গড়ে না ওঠায় হ্যাচারি ও খামারে আর্থিক বিনিয়োগ নিরাপত্তা এখনো নিশ্চিত নয়। এ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিরতিহীন বিদ্যুৎ সরবরাহ অপরিহার্য।
সমীক্ষা শেষে যখন গ্রামের রাস্তা দিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরছিলাম, তখন চারদিকে সাঁঝ নেমে আসে। আঁধার নামিয়ে পশ্চিমের আকাশ থেকে সূর্য বিদায় নিচ্ছে। পুবের আকাশে একই সঙ্গে গাছগাছালির মাথার ওপরে উদ্ভাসিত চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। বিদ্যুতে না হলেও সে চাঁদের আলোয় পেছনে ফেলে আসা গ্রাম ও গ্রামগুলো কিছুক্ষণের মধ্যে আলোকিত হবে। আর সারা দিন এসব গ্রামের মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে যা জেনে ও বুঝে এলাম, তা আগামী ২৭ এপ্রিল পল্লী বিদ্যুতের মূল্যহার নির্ধারণে অনুষ্ঠিতব্য গণশুনানিতে উপস্থাপিত হবে এবং মূল্যহার নির্ধারণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাতে শুধু আর্থিক ঘাটতি নয়, বিদ্যুৎ ঘাটতিরও উপশম হবে এবং এ চাঁদের আলোর মতোই ভবিষ্যতে বিদ্যুতের আলোয় রাতে এসব গ্রাম ও গ্রামবাসী আলোকিত হবে। আমার আজকের এই শ্রম সার্থক হবে। আমার এমন সব ভাবনা আমাকে এমনই আবেশিত ও অভিভূত করে যে আমি কখন এবং কতক্ষণে গন্তব্যে পেঁৗছে গেছি, তা টেরও পাইনি। দিনের আলোয় দেখে আসা বিদ্যুৎবঞ্চিত মানুষগুলো স্মৃতির জানালায় মনের আলোয় দেখতে দেখতে ভাবতে থাকি, অচিরেই এসব মানুষের হাসিমুখগুলো রাতে স্মৃতির জানালায় নয়, পল্লী বিদ্যুতের আলোয় তাঁদের আঙ্গিনায়
দেখা যাবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

No comments

Powered by Blogger.