পেশাজীবীদের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ভূমিকা চাই-রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরুক

গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান ও প্রথম শর্ত সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ন্যূনতম কর্মসম্পর্ক গড়ে তোলা, দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া। গত দুই দশকে আমাদের গণতান্ত্রিক শাসনের অভিজ্ঞতায় যার প্রবল অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায়। পুরোনো বৃত্ত থেকে কোনো পক্ষের বেরিয়ে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।


আমরা লক্ষ করেছি, ক্ষমতায় থাকতে যে রাজনৈতিক শক্তিকে হরতাল-অবরোধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে দেখা গেছে, বিরোধী দলে গিয়ে তারাই হরতাল-অবরোধকে লক্ষ হাসিলের একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে। আবার বিরোধী দলে থাকতে যে রাজনৈতিক শক্তিকে সরকারি দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখেছি, ক্ষমতায় গিয়ে তারাও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না।
গণতন্ত্রের নামে সরকার ও বিরোধী দলের এই অগণতান্ত্রিক ও জবরদস্তির রাজনীতি দেশকে মহা সংকট ও সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বর্তমানে দেশে যে রাজনীতি চলছে, তাকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক ও সুস্থ বলা যায় না। সুস্থ রাজনীতি হলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খোঁজা। কিন্তু কোনো পক্ষই এ ব্যাপারে আন্তরিক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। সংঘাতের রাজনীতি যে কেবল অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে তা-ই নয়, জনজীবনেও নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ। এ ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হলেও সরকার বা বিরোধী দল তা বিন্দুমাত্র আমলে নিচ্ছে না। তারা মাঠে গণতন্ত্র রক্ষার পক্ষে বুলন্দ আওয়াজ তুললেও আচার-আচরণে তার প্রতিফলন ঘটছে সামান্যই।
প্রশ্ন হলো, পরিস্থিতি উত্তরণের উপায় কী? বিরোধী দলের ‘আরও কঠোর কর্মসূচি’ কিংবা সরকারের একগুঁয়েমি জনজীবনে আরও দুর্ভোগ বাড়াবে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে করে তুলবে অনিশ্চিত। এই অবস্থায় সরকার ও বিরোধী দলের কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণই প্রত্যাশিত। সরকারের এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না, যাতে বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি ব্যাহত হয়। আদালতসহ রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানকে নিজের মতো চলতে দিতে হবে। সেখানে সরকারের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। আবার বিরোধী দলেরও উচিত হবে না আইনি ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করে রাজপথে সবকিছু ফয়সালা করতে ধনুর্ভঙ্গ পণ করা।
দুঃখজনক হলো, এ ধরনের রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে রাজনীতির বাইরে যে সমাজশক্তি কার্যকর অবদান রাখতে পারত, সেই নাগরিক সমাজ ও পেশাজীবীদের ভূমিকাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। সব গণতান্ত্রিক দেশেই নাগরিক সমাজ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়ে থাকে, সরকার বা বিরোধী দল—কারও পক্ষভুক্ত হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা তার বিপরীত চিত্রই প্রত্যক্ষ করি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে আদালত অঙ্গন পর্যন্ত সেই বিভক্তির রেখা স্পষ্ট। আমরা এই বিভক্তির যেমন অবসান চাই, তেমনি চাই নাগরিক সমাজ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে সংকট মোচনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

No comments

Powered by Blogger.