সিলেটে মামলায় পর্যুদস্ত বিএনপি পালিয়ে বেড়াচ্ছে ১২ হাজার কর্মী

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে: মাঠে সোনালি ফসল জ্বলজ্বল করছে। কাটার মানুষ নেই। ধান পেকে বৃষ্টিতে পচতে শুরু করেছে। এরপরও কিছুই করার যো নেই। মহিলারা যা পারছেন সংগ্রহ করছেন। তবে বেশির ভাগ ধানই চোখের  সামনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য সিলেটের বিশ্বনাথের। ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে প্রায় ৮ গ্রাম পুরুষশূন্য। সবাই এলাকাছাড়া। মাঠে সোনালি ফসল পড়ে থাকলেও তারা বাড়ি ফিরতে পারছে না। কাটার মানুষ নেই। শুধু বিশ্বনাথই নয় সিলেটের বিএনপি এখন মামলায় পুরোপুরি পর্যুদস্ত। নেতারা কে কোথায় আছেন, কে কোথায় থাকছেন তার কোন ঠিকানা নেই। নেতারা একজন জানেন না আরেক জনের খবর। হাতের মোবাইল ফোন বন্ধ। ভিন্ন নম্বরে তারা যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এরপরও কেউ কারও মোবাইল ফোন রিসিভ করছেন না। নেতারা জানিয়েছেন, এখন ধরা পড়লেই থানায় নিয়ে অকথ্য নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পরে আধমরা অবস্থায় জামিন অযোগ্য মামলায় আদালতে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। একাধিক মামলায় তালিকাভুক্ত আসামি হিসেবে হাত-পায়ে লাগানো হচ্ছে ‘ডাণ্ডাবেড়ি’। ১৮ই এপ্রিল ঢাকা থেকে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পরপরই সিলেট হয়ে ওঠে বিস্ফোরণোন্মুখ। সিলেটের বিএনপির নেতাকর্মী এবং এম ইলিয়াস আলীর নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষ রাস্তায় রাস্তায় এবং গ্রামে গ্রামে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জ্বালাও-পোড়াও করে তারা। তাদের একটাই দাবি, ‘ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দিন।’ কিন্তু ইলিয়াস আলী ফিরে না আসায় তাদের ক্ষোভ আরও বাড়তে থাকলে। বাসা, বাড়ি, রাস্তাঘাট সবখানেই চলে ব্যাপক ধরপাকড়। শুরু হয় মামলা এই অবস্থায় ২৩শে এপ্রিল বিশ্বনাথে পুলিশ ও জনতার মুখোমুখি সংঘর্ষে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের ৩ কর্মী নিহত হন। আহত হয় পুলিশসহ শতাধিক। এর আগের দিন সিলেটের রশিদপুর এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ পর্যন্ত সিলেটের বিভিন্ন থানায় প্রায় ১২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির কর্মীরা। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় ১২ হাজার জনকে। এর মধ্যে ৫০০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানান তারা। জেলা ও সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রায় ২০০ জনকে আটক করেছে বলে দাবি বিএনপি নেতাদের। যাদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তাদের ওই সব মামলার মধ্যে কয়েকটিতে আসামি করে আদালতে চালান দেয়া হচ্ছে। এর ফলে এই মুহূর্তে জামিন নিতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ছেন বিএনপির নেতারা। একাধিক মামলায় আসামি করায় একাধিকবার তাদের জামিন নিতে হচ্ছে। ২৩শে এপ্রিলের ঘটনার পর সিলেটের বিশ্বনাথে হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, অ্যাসল্ট, অস্ত্র ছিনতাইসহ একাধিক ঘটনায় তিনটি মামলা করা হয়েছে। এই তিনটি মামলাই প্রায় ৮ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। তালিকাভুক্ত আসামিদের মধ্যে ৫৮ জনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়েছেন সিলেটের পুলিশ সুপার সাখাওয়াত হোসেন। তিনি জানান, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে কেবল তাদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অযথা কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। তিনি জানান, বিশ্বনাথ থানায় হত্যা মামলায় ১২০ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদিকে, সিলেটে এম ইলিয়াস আলীর ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত বিএনপি নেতাদের ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সিলেট নগরী এবং বিশ্বনাথ থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ২৪শে এপ্রিল সিলেট নগরীর মধুবন মার্কেটের ভেতর থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ রাজনৈতিক নেতা ও সিলেট জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মোজাহিদ আলী, বিশ্বনাথ থানা বিএনপির সভাপতি জালাল উদ্দিন চেয়ারম্যান, মাস্টার রইস উদ্দিন, বিএনপির সিনিয়র নেতা আবুল কালাম কছির, আবুল কালাম ধলা মিয়া চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার করেছে। ২৩শে এপ্রিল বিশ্বনাথ বিস্ফোরণের হোতা আখ্যায়িত করে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে এবং তাদের হত্যাসহ ৩ থেকে ৪টি মামলায় আসামি করা হয় এবং গতকালও সিলেটের আদালতে জালাল উদ্দিন চেয়ারম্যান, ধলা মিয়া চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকজনকে হাতে পায়ে ‘ডাণ্ডাবেড়ি’ বেঁধে আদালতে আনা হয়। সিলেট জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আলী আহমদ গতকাল জানিয়েছেন, বিএনপির কর্মীদের দমন করতে মাঠে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের নামিয়েছে। আর পুলিশ দিয়ে বিএনপি’র কর্মীদের ধরপাকড় চালাচ্ছে। তিনি জানান, এটা কোন গণতান্ত্রিক আচরণ নয়। তিনি পুলিশকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। সিলেটের বিশ্বনাথের জানাইয়া, রামধানা, কামালপুর, শেখের গাঁও, শেখ কামালপুর, শিমুলতলা, বন্ধুয়া, অলঙ্কারীসহ ৮ গ্রাম এখন পুরুষশূন্য। ২৩শে এপ্রিল ঘটনার পর পর বিশ্বনাথ সদর থেকে যে যে অবস্থায় ছিলেন তারা সে অবস্থায় পালিয়ে যান। এ কারণে মাঠে পাকা ধান রয়েছে কিন্তু কাটার মানুষ নেই। জানাইয়া, রামধানা গ্রামের মহিলারা জানান, গ্রামে গ্রামে পাকা ধান পড়ে আছে। আমরা কিছুটা সংগ্রহের চেষ্টা করছি। কিন্তু অবিরাম বৃষ্টির কারণে ধান এখন মাঠে পচতে শুরু করেছে। তারা বলেন, বাড়ির পুরুষ মানুষ এমনিতেই পলাতক। আপাতত সাহায্যের জন্য আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে পুরুষ কাউকে এনেও রাখা যাচ্ছে না। কারণ পুলিশি অভিযান এখনও অব্যাহত আছে। রাতে পুলিশ বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছে। বহু বাড়ির লজিং মাস্টার ও কাজের মানুষ এখন জেলে। সিলেটের পুলিশ সুপার সাখাওয়াত হোসেনও গতকাল জানিয়েছেন, আসামি ধরতে এখনও পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অপরদিকে, বিশ্বনাথ সদরে এখনও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। রাতে র‌্যাব সদস্যরা সেখানে টহল দিচ্ছে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে জনমানবশূন্য বিশ্বনাথের রামধানা বিশ্বনাথ (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, এই বুঝি পুলিশ এলো। রাতে অভিযান চালাবে র‌্যাব ও পুলিশ। ধরে নিয়ে বেধড়ক পেটাবে। কম করে হলেও ৩-৪টি মামলায় জেলে ঢুকিয়ে দেবে। এমন খবর আর আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে বিশ্বনাথ উপজেলার ইলিয়াস আলীর নিজ গ্রাম রামধানাসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের সাধারণ মানুষের। অনেকেই গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রতিদিন শ’ শ’ মানুষ খবরাখবর জানতে ভিড় করতো তার বাড়িতে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মানুষের আসা-যাওয়া ছিল লক্ষ্যণীয়। কিন্তু গত ২৩শে এপ্রিল বিশ্বনাথে বিএনপি, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষের পর থেকে মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। রামধানা, কামালপুর, শেখেরগাঁও, টেককামালপুর, শিমুলতলা, টুকেরকান্দি, রাজনগর, পোদনাপুর, অলঙ্কারী, বন্দুয়া,  নোয়াগাঁওসহ আশপাশের ১০-১২টি গ্রামে নেমে এসেছে ভুতুড়ে পরিবেশ। গভীর রাত পর্যন্ত প্রাণচাঞ্চল্যের এ গ্রামগুলোতে নেমে এসেছে নীরবতা। স্থবির হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জীবনযাপন। এ অবস্থায় পুরুষবিহীন পরিবারগুলো পড়েছে বিপাকে। ঘরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না থাকায় তাদের পরিবারগুলোকে খেয়ে না খেয়ে এখন দিন কাটাতে হচ্ছে। বিশেষ করে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। বৈশাখ মাস হওয়ায় জমিতে পাকা ধান বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গিয়ে নষ্ট হচ্ছে। অথচ গ্রেপ্তার আতঙ্কে কৃষকরা ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কাজের লোক গ্রেপ্তারের ভয়ে এ গ্রামগুলোতে আসতে চাইছে না। বিশ্বনাথে ২৩শে এপ্রিলের সংঘর্ষের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাগুলোতে বিএনপি-জামায়াতের দেড় শতাধিক নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করা হলেও অজ্ঞাত রাখা হয় প্রায়  ১৩ হাজার। মামলা দায়েরের পর পুলিশ বিভিন্ন নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে বেশ ক’জনকে আটক করেছে। আটককৃতদের মধ্যে রয়েছে লজিং মাস্টার, কাজের লোক, নতুন জামাইসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা আত্মীয়-স্বজনরাও। এ খবর আস্তে আস্তে এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে এসব গ্রামে এখন আত্মীয়-স্বজনরা বেড়াতে আসা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। কেউ এলেও সূর্য ডোবার আগেই মান-সম্মানের ভয়ে চলে যান। পুলিশের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। অনেকেই বলেছেন, সেই দিনের সংঘর্ষে সবাই কি জড়িত? কোন স্বাধীন দেশে পুলিশের এমন আচরণ মেনে নেয়া যায় না। ঘটনা ঘটিয়েছে শতাধিক মানুষ। আর আসামি করা হয়েছে ১৩ হাজার। যারা জড়িত তাদের নামে মামলা হোক এবং গ্রেপ্তার করা হোক তাতে এলাকার মানুষের সমস্যা নেই। সাধারণ মানুষকে হয়রানি থেকে যেন রেহাই দেয়া হয়। বর্তমানে সন্ধ্যা হলেই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে শিশুদের নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে রাত কাটাতে হয় নারীদের। এত কিছুর পরও ইলিয়াস আলীকে যে কোন মূল্যে ফিরে পেতে চান রামধানাসহ উপজেলার মানুষ। তারা ইলিয়াস আলী যে কোন সময় ফিরে আসবেন- এই আশায় বুক বেঁধে পথ চেয়ে আছেন।গত ১৭ই এপ্রিল রাতে ঢাকার বনানী থেকে এম. ইলিয়াস আলী ড্রাইভার আনসারসহ নিখোঁজ হন। এরপর থেকে তার জন্মস্থান বিশ্বনাথসহ দেশের মানুষ আন্দোলনে নামে। গত ২২শে এপ্রিল  আওয়ামী লীগ ঘোষণা দেয় ২৩ তারিখ বিএনপি উপজেলা সদরে আসতে পারবে না। কিন্তু বিএনপি’র লোকজন উপজেলায় এলে পুলিশ-আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র সংঘর্ষ হয়। এতে দুই ছাত্রদল-যুবদলনেতাসহ তিন জন নিহত হন।

No comments

Powered by Blogger.