একদিকে মসজিদ, অন্যদিকে সেনাছাউনি-পাকিস্তান by হাসান ফেরদৌস

প্রথম কিস্তি পাকিস্তানের রাজনীতিতে সে দেশের সেনা গোয়েন্দা দপ্তরের প্রভাব কমানোর লক্ষ্যে মার্কিন হস্তক্ষেপের অনুরোধ করে একটি চিঠি লেখার অভিযোগে হুসেইন হাক্কানি বড় ধরনের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন। একই অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে তাঁর চাকরিটিও খুইয়েছেন।


যাঁরা তাঁর বিপক্ষে, ২০০৫ সালে লেখা তাঁর একটি বইতে তাঁরা বিস্তর উপাদান পেয়ে গেছেন। একে তো সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তার ওপর আজকের পাকিস্তানের সব অপকর্মের শুরু সেই জিন্নাহর আমল থেকে, এমন কথাও বলে ফেলেছেন সে বইতে। ফলে তোপের মুখে পড়েছেন একসময়ের জামায়াতপন্থী এই আপাত উদারনৈতিক লেখক-সাংবাদিক।
হুসেইন হাক্কানি অবশ্য সে বই পাকিস্তান: বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি (কার্নেগি এনডাউমেন্ট, নিউইয়র্ক ২০০৫) প্রকাশিত হওয়ার আগে থেকেই বিতর্কিত। ভদ্রলোক একসময় জামায়াতে ইসলামীর প্রধান মওলানা মওদুদির ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন, পরে অবশ্য সেনা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে ভিন্ন ক্যাম্পে চলে আসেন। তাঁর কলমের জোর টের পেয়ে বেনজির ভুট্টো থেকে নওয়াজ শরিফ (এবং পরবর্তীকালে আসিফ আলী জারদারি) তাঁকে উপদেষ্টা হিসেবে নিজেদের ছাতার তলায় টেনে নেন। জেনারেল মোশাররফের ক্ষমতা দখলের পর তিনিও দেশ ছেড়েছিলেন। সে সময় কার্নেগি এনডাউমেন্টের ফেলো ও বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক হিসেবে বেশ কয়েক বছর আমেরিকায় কাটান হাক্কানি। পাকিস্তান: বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি সে সময়ের লেখা।
এ বইতে হাক্কানি খুব নতুন কিছু যে বলে ফেলেছেন, তা মোটেই নয়। সমসাময়িক তাঁর স্বদেশি আরও অনেকেই যেমন, হাসান আব্বাস, ফারজানা শেখ, আহমেদ রশিদ ও আয়েশা সিদ্দিকা—এ নিয়ে মিঠে-কড়া বিস্তর লিখেছেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে কীভাবে ধর্ম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘লেজিটিমাইজিং এজেন্ট’ হয়ে ওঠে এবং তাকে ব্যবহার করে কীভাবে সেনাবাহিনী দেশের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ‘এস্টাবিলাইজিং এজেন্ট’-এ পরিণত হয়, এ বই বস্তুত তারই বিশদ বিবরণ।
অঙ্কটা খুব সোজা। ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়, ভাষাগত ও নৃতাত্ত্বিকভাবে বিভক্ত এ দেশের মানুষকে এক রাখে এমন একমাত্র প্রতীক ছিল ধর্ম—ইসলাম। বাঙালি, পাঞ্জাবি, বালুচ বা সিন্ধি, এরা প্রত্যেকে আলাদা জাতি। এদের একত্র করার জন্য দরকার ছিল যেকোনো এক বা একাধিক প্রতীক, যার প্রতি এরা প্রত্যেকে সমানভাবে অনুগত। খুঁজে পেতে দেখা গেল, ওই এক ইসলাম ধর্ম ছাড়া আর কোনো কিছুতেই তাদের মধ্যে মিল নেই। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ থেকে জেনারেল মোশাররফ, প্রত্যেকেই ওই এক ধর্মকে ছাতা বানিয়ে পাকিস্তান নামক দেশটাকে এক রাখার চেষ্টা করেছেন।
ইসলাম যদি এই রাষ্ট্রের প্রধান খুঁটি হয়, তো ভারতবিরোধিতা তার ১ নম্বর খুঁটি। প্রথম খুঁটিকে পোক্ত করার জন্যই প্রয়োজন পড়েছে দ্বিতীয় খুঁটির। যে যত ভারতবিরোধী (অর্থাৎ হিন্দুবিরোধী), মুসলমান হিসেবে তার ক্রেডেনশিয়াল তত পাক্কা হয়—এ যুক্তি মাথায় রেখে পাকিস্তানের সব রাজনীতিক কে কার চেয়ে অধিক ভারতবিরোধী, সে প্রতিযোগিতা চালিয়ে গেছেন। ইসলাম বিপন্ন, এ স্লোগান পাকিস্তানি রাজনীতিকেরা আগাগোড়াই বলে এসেছেন। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ভারত, সে যেকোনো সময় আক্রমণে প্রস্তুত। অতএব, ইসলামকে বাঁচাতে হলে ভারতকে রুখতে হবে। দেশের ভেতর যে এ যুক্তির বিরোধিতা করবে, তার কপালে তকমা জুটবে ভারতপন্থী—অতএব, সে ইসলামবিরোধী এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরোধী, এ সিলমোহর। গোড়ার দিকে পাকিস্তানি রাজনীতিকেরা ধরে নিয়েছিলেন, এ ফর্মুলায় তাঁদের পক্ষে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা কঠিন হবে না। কিন্তু সমস্যা হলো, ‘বহির্গত হুমকি’ যদি রাজনৈতিক পাশা খেলার প্রধান ঘুঁটি হয়, তাহলে যাঁরা সে হুমকি মোকাবিলায় জানবাজি রাখছেন, সেই সেনাকর্তারা রাজা-উজির না হয়ে রাজা-উজির হবেন কিনা অর্ধশিক্ষিক-অশিক্ষিত রাজনীতিক? পোপের চেয়ে অধিক ধার্মিক হওয়ার চেষ্টা করলে তাতে কল্কে পাওয়া সহজ নয়। শেষমেশ যে সেনাকর্তারা মখমলের কুরসিখানা দখল করে বসেন তার পেছনে নিজেদের সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা তো ছিলই, তার সঙ্গে ছিল জাতীয় রাজনীতিকদের অদক্ষতা ও আপসকামিতা। এ ব্যাপারে যে দুজনকে হাক্কানি বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন তাঁরা হলেন লিয়াকত আলী খান ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। ১৯৪৯ সালে লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে পাকিস্তান আইন পরিষদে যে তথাকথিত ‘অবজেক্টিভ রেজ্যুলেশন’ গৃহীত হয় আর যার ফলে পাকিস্তানে ইসলাম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আসন গেড়ে বসে তার পেছনে এ দুজনের বড় ভূমিকা ছিল। এ ধারা অনুসারে এ কথা স্বীকৃত হয়, ইসলামবিরোধী এমন কোনো আইন পাকিস্তানে গ্রহণযোগ্য হবে না। হুসেইন হাক্কানি ঠিকই বলেছেন, পাকিস্তানের ইসলামিকরণের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল এই অবজেক্টিভ রেজ্যুলেশনের। এ ধারার মাধ্যমে কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক তা নির্ধারণের দায়দায়িত্ব পাইকারি দরে ছেড়ে দেওয়া হয় অনির্বাচিত এমন একদল লোকের হাতে, যাঁদের গ্রহণযোগ্যতার প্রধান চিহ্ন ছিল কার দাড়ি কতটা দীর্ঘ।
পাকিস্তানের আজকের হালের পেছনে যে তৃতীয় কারণ হাক্কানি উল্লেখ করেছেন তা হলো, জন্মের গোড়া থেকে পশ্চিমা জোটের ঝুল পকেটে আশ্রয়। পশ্চিমা শক্তি মানে মুখ্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। একদিকে পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন, অন্যদিকে নিকট প্রাচ্যে সদ্য গজিয়ে ওঠা গণচীন—এই দুই কমিউনিস্ট রাষ্ট্রকে কাবু করতে পাকিস্তানকে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকেই নিয়ে ফেলে ওয়াশিংটন। স্বাধীনতার পরপর প্রথম কয়েক বছর কিঞ্চিত দোদুল্যমান থাকলেও এ কথা বুঝতে মার্কিন প্রশাসনের বেশি সময় লাগেনি যে ভারতের তথাকথিত জোট নিরপেক্ষ অবস্থানের পাশে পাকিস্তানই হবে তাদের তুরুপের তাস। জনগণকে যদি তাদের পছন্দমতো সরকার গঠন করতে দেওয়া হয়, তার ফল সব সময় মার্কিন স্বার্থের পক্ষে না-ও যেতে পারে। অতএব সিদ্ধান্ত হলো, পাকিস্তানে মানুষের চোখে ধুলা দেওয়ার জন্য গণতন্ত্রের কথা মুখে বলা হবে বটে কিন্তু সব চেষ্টা হবে প্রকৃত গণতন্ত্র যাতে আসন গেড়ে না বসতে পারে। আর এ কাজটা সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারেন সেনাকর্তারা।
এতে পোয়াবারো হলো সেনাকর্তাদের। একদিকে তাঁরা মুখে ফেনা তুলে ফেললেন এ কথা বোঝাতে যে অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজ বেসামরিক রাজনীতিকদের কাজ নয় ভারতকে রোখা ও ইসলাম বাঁচানো। অন্যদিকে ওয়াশিংটনের কাছে তাঁরা নিজেদের হাজির করলেন সবচেয়ে অনুগত ও নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে। কাজটা শুরু করেছিলেন জিন্নাহ। এক বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য চেয়ে ধরনা দিয়েছিলেন কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারেননি মুখ্যত আমেরিকার অনাগ্রহের কারণে। ওয়াশিংটনের কর্তাদের ধারণা ছিল, এ দেশ টিকবে না। সে হিসাব অবশ্য বদলে যায় ক্ষমতায় সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশের পর। মার্কিনিদের কাছে ইস্কান্দার মির্জা থেকে আইয়ুব খান, তারপর জিয়াউল হক এবং সবশেষে পারভেজ মোশাররফ—প্রত্যেকেই নিজেদের পাকিস্তানের একমাত্র ত্রাতা হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই হাতিয়ার মাথায় টুপি, মুখে ভারতজুজু।

No comments

Powered by Blogger.