আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৭৪)-'দ্য নেকেড ট্রুথ' by আলী যাকেরআলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৭৪)-'দ্য নেকেড ট্রুথ' by আলী যাকের

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানগুলো ধারণ করা হতো বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটি দোতলা বাড়িতে। প্রথম দিন রিপোর্ট করার সঙ্গে সঙ্গেই কবিরভাই আমাকে আমার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। খবর পাঠ করবেন তিনি স্বয়ং। আমার দায়িত্ব হবে সংবাদ ভাষ্য তৈরি করে পাঠ করা।


যুদ্ধ প্রতিবেদক হিসেবে বিভিন্ন সেক্টরের যুদ্ধের প্রতিবেদন তৈরি করে তা রেকর্ড করা এবং সপ্তাহে দুই দিন রেডিও পাকিস্তানের 'হোল ট্রুথ'-এর জবাবে 'দ্য নেকেড ট্রুথ' বা 'নগ্ন সত্য' রচনা করে তা প্রচার করা। এই কাজগুলোর জন্য বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ওপর আমাকে নির্ভর করতে হতো। 'নগ্ন সত্য' অনুষ্ঠানের জন্য রেডিও পাকিস্তানের তাবত মিথ্যা প্রচারই ছিল বড় উৎস। যুদ্ধ প্রতিবেদন সরাসরি আসত সেক্টরগুলো থেকে। কিছু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় প্রাপ্ত। আবার কিছু হৃদয়গ্রাহী অনুষ্ঠান তৈরি হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে সেক্টর অথবা সাব-সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে ধারণকৃত সাক্ষাৎকার থেকে। সংবাদভাষ্য তৈরি হতো বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সরবরাহ করা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং সাময়িকীর ওপর নির্ভর করে। যুদ্ধ প্রতিবেদন সংগ্রহে আমাকে অনেকবার বিভিন্ন সেক্টরে যেতে হয়েছে। একবার ৮ নম্বর সেক্টর প্রধান মেজর মঞ্জুরকে ইন্টারভিউ করেছিলাম। সে স্মৃতি আজও অম্লান আমার হৃদয়ে।
ওদিকে মাহমুদুর রহমান ওরফে বেনুরা কলকাতায় ১৪৪ লেনিন সরণিতে একটি মুক্তিযুদ্ধ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড গড়ে তোলে। ওই বাড়িতে মহড়া হতো স্কোয়াডের। তারপর সদলবলে শরণার্থী শিবির, বা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবিরে পরিবেশন করা হতো দেশাত্মবোধক সব সংগীত। মাঝেমধ্যে ওদের সংগীত পরিবেশনায় আমি ধারাভাষ্যও পাঠ করেছি।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সিদ্ধার্থ শংকর রায় তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁকে দূর থেকে দেখেছি এক কি দু্ইবার। পোশাক-আশাকে অত্যন্ত রুচিশীল সৌম্যদর্শন ব্যক্তি। তবে কাছ থেকে দেখতে পেয়েছি মার্কসিস্ট নেতা জ্যোতি বসু, হরেকৃষ্ণ কোঙারকে এবং অবাক হয়েছি তাঁদের আত্মপ্রত্যয় দেখে। তাঁদের সামগ্রিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ, দূরদৃষ্টি, বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাঁদের সংবেদনশীল মনোভাব আমাকে চমৎকৃত করেছে। এ ছাড়া ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারাও উদারভাবে এগিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায়। আমার আজও মনে পড়ে, কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অবিসংবাদিত নেতা মনি সিংহের অনলবর্ষী বক্তৃতা, 'জীবনের যেই দিন থেকে এই লোহিত পতাকার ছত্রছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছি, সেইদিন থেকে এর প্রতি পূর্ণ বশ্যতার সূচনা হয়েছে আমার জীবনে। এবং আমার মৃত্যু দিন পর্যন্ত এর কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না।'
বেতারের রেকর্ডিং শেষে একদিন হেঁটে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ বালীগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে একটা চায়ের দোকান দেখে চা-তেষ্টায় ঢুকে পড়ি সেখানে। দোকানটা এক পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের। কলকাতায় তাঁদের সম্বোধন করা হয় সর্দারজি বলে। তাঁদের চা বিখ্যাত। যেমন আমার এক বন্ধু একবার আমায় বলেছিল, 'সর্দারজিদের চা? ইট্‌স মোর দ্যান টি। ইট্‌স আ ফুড।' সত্যিই তা-ই। চুলার ওপরে হালকা আঁচে অনেকক্ষণ ধরে ঘন দুধের মধ্যে রান্না হতে থাকে চা। তারপর বিস্তর চিনি মেশানো হয়। ওই চা যখন পরিবেশিত হয়, তখন তা আর পানীয় থাকে না, হয়ে যায় খাদ্য। এই খাদ্যে প্রথম চুমুক দেওয়ার পর কে যেন আমাকে পেছন থেকে স্পর্শ করে। পেছন ফিরে তাকাই। আবছা আলো-আঁধারিতে ঠিক চিনতে পারছিলাম না। 'চিনতে পারলি না?' এবার কণ্ঠস্বরে চিনে ফেলি। আমার বাল্যকালের বন্ধু কাজল। ১৯৬৪ পর্যন্ত ঢাকায় ছিল ওরা, গেণ্ডারিয়ায়। খুব ভালো ক্রিকেট খেলত। অসাধারণ স্পিনার। লেগব্রেক, গুগলি, ফ্লিপার। আমি ছিলাম আমার দলের ওপেনিং ব্যাটসম্যান। নেট প্র্যাকটিস কিংবা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে কাজলের সঙ্গে যেন আমার একটা অঘোষিত যুদ্ধ চলত। সেই কাজলরা ১৯৬৪-র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর চলে আসে কলকাতায়। অথচ কাজলের বাবা, শ্রী শরৎ গুপ্ত, পাড়ার সব অনুষ্ঠানের যিনি ছিলেন মধ্যমণি, বলতেন, 'আমার পৈতৃক ভিটা ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। আমি আমার শেষ জীবনটা এখানেই কাটাতে চাই।' সেই শরৎবাবু চলে গেলেন পরিবার-পরিজন সুদ্ধ! আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমরা একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি করেছিলাম পাড়ায় দাঙ্গা ঠেকাতে। অস্ত্র হিসেবে সবার হাতে থাকত বাঁশের লাঠি। কেবল আমার হাতে আমার বাবার দোনলা বন্দুক। কাজলদের চলে যাওয়ার খবরটা কানে আসামাত্র ছুটে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, 'কাকাবাবু, আপনারা চলে যাবেন না। আমরা যেমন করে হয় এই দাঙ্গা ঠেকাব।' শরৎবাবু জবাবে মৃদু হেসে বলেছিলেন, 'বাবা, বন্দুক দিয়া এই সমস্যা সমাধান করন যায় না। পরস্পর বিশ্বাস যখন শেষ হইয়া যায়, তখন আর কিছুই করনের থাকে না।' হঠাৎ এই মুহূর্তে মনে পড়ল, সৈয়দ শামসুল হকের লেখা 'নুরলদীনের সারাজীবন' নাটকে মূল চরিত্রের একটি সংলাপ, 'মাঝির অন্তর যদি ভাঙ্গি যায়, নৌকা তার টুকরা হয়া নদী জলে ভাসে।'
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.