চারদিক-রেমা ফুলের কারবার by আকমল হোসেন

উঁচু-নিচু পাহাড়ি টিলা। কোথাও টিলার ওপর ঘরবাড়ি। কোথাও টিলার ঢালু বেয়ে ঘর। নানা জাতের গাছপালা। এসবের মধ্যে বনজ জাতের গাছ বেশি। তবে মাঝেমধ্যে ফলের গাছও আছে। এর মধ্যে কাঁঠালের গাছই বেশি চোখে পড়ে। কাঁঠালগাছে মুছি ধরেছে।


ছোট ছোট কাঁঠালের মুছি দেখে বোঝার উপায় নেই যে এগুলোই আর কিছুদিন পরে একেকটি দানাদার বিশাল ফলের আকার নেবে।
এই টিলাভূমি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়নে পড়েছে। জায়গাটি সরকারি। কিন্তু অনেকেই বহু বছর ধরে এখানে বসবাস করছেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা লোকজন এরই মধ্যে নিজেদের একটি সমাজ গড়ে তুলেছেন। এঁরা কেউ নদীভাঙনে নিঃস্ব হওয়া মানুষ। কেউ ভাগ্যের ফেরে সবহারানোর দলে। কেউ আছেন দেশভাগের বলি। ঘুরতে ঘুরতে একদিন এই টিলাভূমি তাঁদের আশ্রয় হয়েছে। এখানে এসে ঠাঁই গেড়েছেন। সেই টিলাভূমির চড়াই-উতরাইয়ের পথ পেরিয়ে চৈত্র মাসের এক পড়ন্তবেলায় মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও লেখক মো. আবদুল খালিক এবং লেখক-গবেষক আহমদ সিরাজসহ আমরা হাঁটতে থাকি। মাঝেমধ্যে কোথাও কোনো গাছের আগডালে বসে কোকিল ডাকে। এটা তার ডাকার মৌসুম। দু-একটা অচেনা পাখি এ-ডাল থেকে ও-ডালে লাফায়, উড়ে বেড়ায়। এভাবে একটি স্থানে এসে যখন পৌঁছাই, কিছুটা চমকেই উঠি—মানুষের নীরবে বেঁচে থাকার, টিকে থাকার নানামুখী কাজ দেখে। কীভাবে নিজেরাই বাঁচার জন্য পথ খুঁজে নিয়েছেন। তুচ্ছ বুনো উদ্ভিদের ফুলও জীবিকার উপায় হয়ে গেছে। তাদের উৎপাদিত এই পণ্যটি অচেনা নয়। ঘরের মেঝের ধুলো-ময়লা সাফ করতে এই ফুলটি সবার পছন্দের। কিন্তু তা কোথায় কীভাবে তৈরি হয়। তারপর দু-তিন হাত ঘুরে ঘুরে শহর ও গ্রামের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। তা হয়তো অনেকেই জানে না। এ এক নতুন আবিষ্কার—যা টিলাভূমির বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই।
জায়গাটি পূর্ব বাগমারা। টিলাভূমির কোমর ছুঁয়ে বাড়ি—কিছুটা সমতলের মতো। দেখা গেল, বেশ কিছু বাড়ির উঠোনে ঝাড়ু তৈরি করছেন লোকজন। রেমা ফুলের ঝাড়ু। আবার নারকেল শলার ঝাড়ুও আছে। স্থানীয় লোকজন জানালেন, এই রেমা ফুল তাঁরা লাউয়াছড়া, ভানুগাছ, শ্রীমঙ্গল ও সাতগাঁওয়ের বন থেকে সংগ্রহ করে থাকেন। তবে এসব বন থেকে রেমা ফুল সংগ্রহ করতে বন বিভাগকে টাকা দিতে হয়। এলাকা ও ফুলের অবস্থা বুঝে টাকার অঙ্ক চার-পাঁচ হাজার। তবে এ অঞ্চলের রেমা ফুলের মান খুব বেশি ভালো নয়। উন্নত জাতের রেমা ফুল তাঁরা চট্টগ্রাম থেকে কিনে আনেন। বেশ কিছু ঘরের ভেতরে রেমা ফুল মজুদ রাখতে দেখা গেছে। সারা বছরের জন্য রেমা ফুল সংগ্রহে রাখতে হয়। কারণ, তা সব সময় পাওয়া যায় না। আর নারকেলের শলা আনা হয় বরিশাল থেকে। মো. ইয়াছিন মিয়া (৬৫) বলেন, ‘আমি সিলেটে বরিশালের লোকজনের কাছে এই ঝাড়ু তৈরির কাজ ও ব্যবসাটা শিখেছি। প্রতিদিনই ঝাড়ু বিক্রি হয়। খুচরা বিক্রেতারা সকালে এসে নিয়ে যায়। এরা গ্রামেরই লোক। বিক্রি করে এসে টাকা দিয়ে যায়।’ ইয়াছিন মিয়ার মূল বাড়ি কুমিল্লা। পাকিস্তান আমলে এখানে এসে বসতি গড়েছেন। এখন নিজের কেনা জমিতে বসবাস করছেন।
স্থানীয় লোকজন জানান, রেমা ফুল ও শলার ঝাড়ু তৈরি এবং বিক্রির সঙ্গে এই গ্রামের প্রায় ২০০ মানুষ জড়িত। মহিলারাই বেশি বাঁধেন রেমা ফুলের ঝাড়ু। মান ভেদে ৫০ পয়সা ও এক টাকা করে ঝাড়ুপ্রতি মজুরি পান। এই কাজের সঙ্গে আমেনা বেগম, মাহমুদা বেগম, শামছুন্নাহার, ফাতেমা বেগমসহ আরও অনেকেই জড়িত। নারকেল শলার ঝাড়ু তৈরিতে একইভাবে ৫০ পয়সা, ১ টাকা ও দেড় টাকা করে মজুরি। শলার ঝাড়ু তৈরি করতে করতে জিনু মিয়া (৫৫) বলেন, ‘আমি কৃষিখেতের পাশাপাশি এই কাজ করি। প্রতিদিন শ দেড়েক ঝাড়ু তৈরি করা যায়।’ সঙ্গে বনগাঁও আহমদ ইকবাল মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ওসমান গনি (১৪) কাজ করছে। সে বলে, ‘স্কুল থেকে আসার পর যখন সময় পাই ঝাড়ু তৈরির কাজ করি।’ পাইকারিভাবে শলার ঝাড়ু ১০, ১৮ ও ২৫ টাকা করে বিক্রি হয়ে থাকে। আর রেমা ফুলের ঝাড়ু বিক্রি হয়ে থাকে ১৫, ২০, ২৫ ও ৪০ টাকা করে। এই নিভৃত গ্রাম থেকে এই ঝাড়ু ছড়িয়ে পড়ে মৌলভীবাজার, কুলাউড়া, শ্রীমঙ্গল, বিয়ানীবাজার, সিলেটসহ ছোট-বড় অনেক শহরে।
জানা গেল, যাঁরা এই ব্যবসা করেন, তাঁদের অনেকেই বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) ক্ষুদ্রঋণের জালে আটকে আছেন। লাভের গুড় পিঁপড়ে খাওয়ার মতো তাঁদের মুনাফারও অনেকটাই এই ঋণচক্রে চলে যায়। কাজটি হয়তো ছোট, ঠিক চোখে পড়ার মতো নয়। কিন্তু ফুলের ছোঁয়ায় ঝকঝকে চকচকে হয় যে ঘর, সেই ফুলের ঝাড়ুর কারিগরেরা এই দেশেরই নাগরিক। বড় শিল্প নিয়ে হইচই হয়, হোক— পাশাপাশি এই ছোট ছোট প্রচেষ্টাগুলো সরকারি সহযোগিতা পেলে মানুষের স্বস্তির জায়গাটা বাড়ে।
আকমল হোসেন
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

No comments

Powered by Blogger.