বাংলাদেশ-ভারত-প্রণব মুখার্জির প্রতিশ্রুতি by মাহবুবুর রহমান

ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি আগামীকাল ৫ মে বাংলাদেশ সফরে আসছেন। তিনি আগেও বেশ কয়েকবার এসেছেন, কখনো প্রতিরক্ষামন্ত্রী, কখনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কখনো বা অর্থমন্ত্রী হিসেবে। ২০০৭ সালে আইলার কঠিন ছোবলে যখন বাংলাদেশের গোটা উপকূলীয় অঞ্চল তছনছ হয়ে গিয়েছিল, প্রাকৃতিক সেই মহাদুর্যোগে লাখো লাখো


মানুষ যখন গৃহহারা, স্বজনহারা, অসহায়—তখন সান্ত্বনা, সহানুভূতি ও সাহায্যের বার্তা নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন এই ভারতীয় নেতা। ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিল। মিত্র বাহিনী হয়ে আমাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। রণাঙ্গনে একসঙ্গে রক্ত ঝরিয়েছিল, একসঙ্গে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছিল। ভারতের মিত্র রূপকে আমি শ্রদ্ধা জানাই, হূদয়ে পোষণ করি।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, যখন সীমান্তে এই মিত্র দেশের বাহিনীর হাতে প্রায় প্রতিদিনই তারা নির্যাতিত হয়, গুলিবিদ্ধ ও হত্যার শিকার হয়। সীমান্তে অস্থিরতা ও উত্তেজনা চলছে। সিটমহলগুলোর লাখ লাখ মানুষ সেই ’৪৭-এর ভারত বিভক্তির পর থেকে ঠিকানাহীন, পরিচয়হীন, ভবিষ্যৎহীন অবস্থায় পড়ে আছে। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি আজও বাস্তবায়ন হয়নি। সিটমহলগুলো হস্তান্তর হয়নি। আমরা চুক্তির অব্যবহিত পরই বেরুবাড়ির সার্বভৌমত্ব ভারতের হাতে তুলে দিই, চুক্তি বাস্তবায়িত করি। আজ প্রায় চার দশকেও আঙ্গরপোতা-দহগ্রামের সংযোগের তিনবিঘার এক চিলতে জমির সার্বভৌমত্ব বাংলাদেশ পায়নি। সিটমহল অধিবাসীদের জীবন দীর্ঘ সময় ধরে মানবেতর। না আছে তাদের দেশ, না পরিচয়, না নাগরিকত্ব, না ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত চরম মানবীয় সম্যায় জর্জরিত ১১১টি সিটমহলের ভাগ্য আজও ভারত সরকারের সিদ্ধান্তহীনতায় ও দীর্ঘসূত্রতায় ঝুলে আছে। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ অতিবাহিত সমস্যার সমাধানে ভারত নির্লিপ্ত, উদাসীন। সমস্যাটি অত্যন্ত গুরুতর, নিদারুণ বেদনাদায়ক ও অমানবিক। নদীমাতৃক বাংলাদেশ। নদী আমাদের জীবন, আমাদের জীবিকা, আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি। আমাদের জীবন ধারণ, আমাদের সবকিছুই নদীকে ঘিরে। প্রতিবেশী ভারত উজানে বাঁধ দিয়ে নদীবিধৌত বাংলাদেশের সব নদীর পানি প্রত্যাহার করেছে, নদী সব শুকিয়ে গেছে, তারা স্রোতহারা মৃত বালুরাশি মাত্র। টিপাইয়ে বরাকের টুঁটি টিপে ধরা হচ্ছে। আন্তনদী সংযোগ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ স্তব্ধ হতে যাচ্ছে।
ভারতীয় কূটনৈতিকদের মধ্যে যুক্তিবাদী যে কয়েকজন আছেন তাঁদের একজন আমি মনে করি জে এন দীক্ষিত। তিনি তাঁর বই লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড-এ লিখেছেন, ভারত সরকারের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের পূর্বশর্ত নিশ্চয়ই হতে হবে তিস্তাসহ সব নদীর ন্যায্য পানি বণ্টন, অপদখলীয় ভূমি, সিটমহল, সীমান্ত হত্যা বন্ধ ও অন্য সব অমীমাংসিত সমস্যার ন্যায়ভিত্তিক সমাধান। তিনি আরও বলেছেন, এভাবে দেওয়া-নেওয়ার বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্কের সৃষ্টি হলেই কেবল ভারতের ট্রানজিট সুবিধা পাওয়ার প্রশ্ন আসতে পারে। দেবে আর নেবে, মিলাবে-মিলিবে—এর মধ্যেই বন্ধুত্বের পরিচয়, সৌভ্রাতৃত্বের ও সৎ প্রতিবেশীর বিকাশ।
ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বাঙালি, বাংলাভাষী মানুষ। ভারতের একজন অত্যন্ত অভিজ্ঞ, দক্ষ ও প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ। ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে বাঙালি যে কতিপয় রাজনীতিক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা ও সর্বজনীনতা অর্জন করেছিলেন, নিশ্চিতভাবে তিনি তাঁদের অন্যতম। অন্য দুজনের মধ্যে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস ও জ্যোতি বসুর নাম শ্রদ্ধাভরে উল্লেখ করছি। প্রণব মুখার্জি আসন্ন সফরকে বাংলাদেশের মানুষ গভীরভাবে মূল্যায়িত করতে চায়, গুরুত্ব দিতে চায়। তাঁর কাছে অনেক প্রত্যাশা রাখতে চায়।
আমার মনে পড়ছে, আমি অষ্টম সংসদে সাংসদ হিসেবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তখন সভাপতি ছিলাম। দিল্লিতে এক সরকারি সফরে আমন্ত্রিত হই। প্রণব মুখার্জি তখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে মন্ত্রণালয়ে আমার এক সাক্ষাৎকারের সুযোগ হয়েছিল। আমার সঙ্গে ছিলেন ভারতে আমাদের তদানীন্তন রাষ্ট্রদূত লিয়াকত আলী ও দূতাবাসের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফেরদৌস। প্রণব মুখার্জিকে আমার একজন অমায়িক ও অতিশয় বাঙালি বলে মনে হয়েছিল। সাক্ষাতেই তিনি বলেন, আপনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন, বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, আমি ভীষণ খুশি। আসুন, আমরা দুজন বাংলায় কথা বলি। এখানে তো সব সময় এমন সুযোগ হয় না। তিনি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অনেক কথা বলেন। ভারতের জাতীয় সংগীত কবিগুরুর রচিত কবিতা। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতও তাঁর রচিত। তিনি ‘সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ কয়েক লাইন গড়গড় করে আবৃত্তি করেন। আমি বললাম, আরও আছে, শেষ লাইন কটি আরও সুন্দর, আরও অর্থবহ, হূদয় নিংড়ানো। ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি’। আমি বলেছিলাম, আপনি রবীন্দ্রভক্ত, রবীন্দ্রনাথকে আপনি অনেক ভালোবাসেন। বাংলাদেশের শ্রীহানি হলে, বাংলা মায়ের মুখ মলিন হলে রবীন্দ্রনাথ কষ্ট পেতেন, অশ্রুপাত করতেন। বাংলা মায়ের মুখ যেন সদা প্রসন্ন থাকে, যেন তার বদন মলিন না হয়, সে জন্য আপনার কাছে আমি সহযোগিতা চাইব, শুভকামনা চাইব। তিনি আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘আমি নিশ্চয়ই আপ্রাণ চেষ্টা করব বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে থাকতে, তার কল্যাণে যথাসাধ্য করতে। তাঁর কথাগুলো এখনো আমার কানে অনুরণিত হয়।’
কাল প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশে আসছেন। তাঁকে স্বাগত জানাই। অনেক কর্মসূচির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী পালনের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে তাঁর প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিতিও একটি। তাঁর সফর সফল হোক। তাঁর সফরের মধ্য দিয়ে বাংলা-ভারতের শান্তি, সহযোগিতা ও সমৃদ্ধির নতুন অধ্যায়ের বাতাবরণ হোক, অমীমাংসিত সব সমস্যার সমাধান হোক, মৈত্রীর বন্ধন সুদৃঢ় হোক, কামনা করি। কামনা করি, ২০০৬ সালের ৩০ জানুয়ারি দিল্লির সাউথ গেটে তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালিত হোক।
মাহবুবুর রহমান: সাবেক সেনাপ্রধান।

No comments

Powered by Blogger.