গুরু-শিষ্য সমাচারঃ প্রতিপক্ষের প্রতি প্রতিহিংসা by মাহবুব তালুকদার

গুরুদেব যোগাসনে বসিয়া ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন। তাহার মুখমণ্ডলের চতুর্দিক হইতে এক অলৌকিক বিভা চতুষ্পার্শ্বে ছড়াইয়া পড়িতেছিল। এই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখিয়া শিষ্য অভিভূত হইয়া রহিল। তাহার ধারণা হইল, বিশ্ব-সংসারের কত রহস্যই না গুরুদেবের অধিগত।

তিনি উহাদের কার্যকারণ অনুধাবন ও বিশ্লেষণ করিতে পারেন। তথাপি গুরুদেব আচার-আচরণে সাধারণ মানুষের সীমা অতিক্রম করেন না। বিশেষত জ্ঞানের গরিমা তাহার মধ্যে একেবারেই নাই। অনেক সময় এমন প্রশ্ন করেন যে প্রতীয়মান হয়, তিনি নিজেই যেন শিষ্যত্ব বরণ করিয়াছেন। শিষ্য অবশ্য ইহার মাজেজা উদ্ঘাটন করিতে পারে নাই।
এক সময়ে গুরুদেবের ধ্যান ভঙ্গ হইল। তিনি দৃষ্টি উন্মোচিত করিয়া কহিলেন, বত্স! অবধান করো।
আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় আছি প্রভু। শিষ্য বলিল।
গুরুদেব জিজ্ঞাসিলেন, আমার স্বপ্নের কথা তোমার মনে পড়িতেছে কি?
হ্যাঁ, মহাত্মন! আপনি স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন, আমাদের দেশরূপী রেলগাড়ি লাইনচ্যুত হইয়াছিল। পরে উহা লাইনের উপর তুলিয়া চালনা করার পর দেখা গেল সম্মুখে একটি অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ। আপনার ধারণা হইল সামনে একটি বিপজ্জনক সেতু রহিয়াছে। তবে সুড়ঙ্গমুখে গিয়া আপনি দেখিতে পাইলেন, লাইনের এক পাশে লিখিত আছে : ‘সাবধান! সামনে বিপদ!’ উহা পাঠ করিয়া আপনার নিদ্রা ভঙ্গ হইল।
সাধু! গুরুদেব কহিলেন, তোমার স্মৃতিশক্তির উর্বরতার জন্য সাধুবাদ জানাইতে হয়।
শিষ্য জানিতে চাহিল, প্রভু! আপনার স্বপ্নের বিষয়টি পুনরায় স্মরণ করিবার কোনো কারণ আছে কি?
অবশ্যই আছে। গুরুদেব জানাইলেন, আমার স্বপ্ন, দৃশ্যটিকে আমি রূপকার্থে ব্যাখ্যা করিয়াছিলাম। কিন্তু উহা যে সরাসরি ঘটিত হইবে, তাহা তত্কালে ভাবি নাই। এখন দেখিতেছি সামনে সত্য সত্যই বিপদ। আমি বিপদের গন্ধ পাইতেছি।
শিষ্য কহিল, বিপদই সম্ভবত আমাদের রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি।
তুমি যথার্থ বলিয়াছ। গুরুদেব বলিলেন, ইহার কারণ আমাদের দেশের রাজনীতির ভিত্তি। গুরুদেব একটু থামিয়া পুনর্বার জিজ্ঞাসিলেন, তুমি কি বলিতে পারো আমাদের রাজনীতির ভিত্তি কি?
জনগণের প্রতি ভালোবাসা।
উহা তো সর্বত্রই রাজনীতির ভিত্তি। ইহার অতিরিক্ত আর কি আছে?
শিষ্য কোনো উত্তর খুঁজিয়া পাইল না। সে নিরুত্তর রহিল।
আমাদের দেশের রাজনীতির বিশেষ ভিত্তি হইতেছে প্রতিপক্ষের প্রতি প্রতিহিংসা।
প্রতিপক্ষের প্রতি প্রতিহিংসা! ইহার অনুপ্রাস মন্দ নহে।
এই অনুপ্রাসই আমাদের দেশের রাজনৈতিক অভিযাত্রার মূল সত্য। প্রতিহিংসার রাজনীতি বাংলাদেশের ললাট-লিখন। তবে এহেন প্রতিহিংসাপরায়ণতার জন্য কোনো একক দলের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া লাভ নাই।
তাহা হইলে বলিতে হয়, দেশ ধীরে ধীরে সাংঘর্ষিক অবস্থার দিকে চলিয়া যাইতেছে।
আপাতদৃষ্টিতে তাহাই মনে হয়। গুরুদেব কহিলেন, একপক্ষ বলিতেছে শান্তিপূর্ণভাবে মিটিং-মিছিল করার ব্যাপারে বাধা সৃষ্টি করা হইলে হরতালের ন্যায় কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হইবে। অন্যদিকে হুশিয়ার করা হইতেছে, যাহারা আন্দোলনের নামে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করিবে, তাহাদিগকে কঠোর হস্তে দমন করা হইবে।
প্রভু! এই অবস্থায় কে ঠিক? সরকারি দল না বিরোধী দল?
এই প্রশ্নের উত্তর তোমার নিজেকেই বুঝিয়া লইতে হইবে। তবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭-এর বিষয়ে উভয়পক্ষের সতর্ক দৃষ্টিপাত প্রয়োজন। গুরুদেব জানাইলেন।
শিষ্য জানিতে চাহিল, উহাতে কি আছে?
গুরুদেব তাহার ল্যাপটপের বোতাম টিপিয়া অনুচ্ছেদ ৩৭ স্ক্রিনের উপরে তুলিয়া আনিলেন। তাহার ইঙ্গিতে শিষ্য উহা পাঠ করিল : ‘সমাবেশের স্বাধীনতা। জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’
প্রভু! বোঝা যাইতেছে প্রতিজন নাগরিকেরই জনসভা ও শোভাযাত্রা করিবার সাংবিধানিক অধিকার রহিয়াছে।
বত্স! তুমি অনুচ্ছেদের একটি অংশের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করিতেছ। বাকি অংশ উপেক্ষিত হইতেছে। গুরুদেব অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন, ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে’ কথাটি এই স্থানে বিশেষ গুরুত্ববহ। কিংবা তুমি ‘যুক্তিসঙ্গত’ শব্দটিতে আন্ডারলাইন করিতে পারো। ওই ‘যুক্তিসঙ্গত’ শব্দটি লইয়াই মহাগণ্ডগোল।
স্যার! আমি ইহা ঠিক অনুধাবন করিতে পারিতেছি না।
তুমি পুনর্বার অনুচ্ছেদটি পড়িলেই ইহা অনুধাবন করিতে পারিবে। ‘যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ’ কথাটি যুক্তিসঙ্গত হইলেও ইহাতে পরিমাপ নির্দিষ্ট করা হয় নাই। সরকারিদলের নিকট যাহা যুক্তিসঙ্গত, বিরোধী দলের নিকট তাহা যুক্তিসঙ্গত নাও হইতে পারে। সরকারি দল যদি মিছিলে লাঠিচার্জ করিয়া ‘যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ’ আরোপ করে, তাহা হইলে কাহার কি বলার আছে? বিরোধী দল পুলিশি অ্যাকশনকে যুক্তিসঙ্গত মনে না করিলেই বা কি আসে যায়?
শিষ্য জানিতে চাহিলে, ইহার কি কোনো প্রতিকার নাই প্রভু?
প্রতিকার হইতেছে রাজনৈতিক দলগুলি গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা ও কমিটমেন্ট। সরকার ও বিরোধী দল উভয়পক্ষের পারস্পরিক শ্রদ্ধা না থাকিলে গণতন্ত্র বিকশিত হইতে পারে না। সংবিধানে আক্ষরিক অর্থের অতিরিক্ত যাহা আছে, তাহা হইল অনুচ্ছেদের মর্মবাণী বা স্পিরিট। উহা কেবল অনুধাবন করিলে চলিবে না, বাস্তব ক্ষেত্রে উহার অন্তর্নিহিত মর্মবাণীকে লালন করিতে হইবে।
প্রভু! উহা কি সম্ভব?
প্রতিহিংসার রাজনীতি চলিতে থাকিলে উহা সম্ভব নহে। এই অবস্থায় পক্ষ ও প্রতিপক্ষের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য। অবশ্য প্রতিহিংসা ছাড়াও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের কারণে রাজনৈতিক সংঘর্ষ ছড়াইয়া পড়িতে পারে।
কিন্তু উহাকে তো বিচ্ছিন্ন ঘটনাই বলিতে হইবে।
বিভিন্ন স্থানে একই প্রকার ঘটনা ঘটিলে উহাকে আর বিচ্ছিন্ন বলা যায় না। সম্প্রতি মেহেরপুরের গাংনিতে জলমহালের দখল লইয়া যে ঘটনাটি ঘটিয়াছে, তাহা বিচ্ছিন্ন নহে, অবিচ্ছিন্ন ঘটনা। ইতোপূর্বে জলমহালটি বিএনপির নিয়ন্ত্রণে ছিল। আওয়ামী লীগের লোকজন উহার দখল লইতে চাহিলে উভয়পক্ষের সংঘর্ষ বাধে এবং একজন নিহত ও ৬ জন আহত হয়। নোয়াখালিতে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া লইয়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র সংঘর্ষে একজন নিহত হইয়াছে। এইরূপ ঘটনা উপর্যুপরি ঘটা অস্বাভাবিক নহে।
মহাত্মন! বিভিন্ন স্থাপনার নাম পরিবর্তনই যদি যথেষ্ট মনে না হয়, ওই সকল স্থাপনার অধিকার দখলের জন্য যদি প্রতিযোগিতা চলে তাহা হইলে সংঘর্ষ অনিবার্য।
তুমি ঠিকই বলিয়াছ।
এইরূপ সংঘর্ষ কি কোনোভাবেই এড়ানো যায় না? শিষ্য জিজ্ঞাসিল।
বাছা! এই সকল ঘটনার কারণ রাজনৈতিক নহে। বিভিন্ন এলাকা বা স্থাপনার কর্তৃত্ব দখলের পেছনে রহিয়াছে উহাতে আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা। আধিপত্য বিস্তারের অর্থ বোঝ কি?
আধিপত্য বিস্তারের সাধারণ অর্থ হইতেছে—
আধিপত্য বিস্তারের কোনো সাধারণ অর্থ নাই। আধিপত্য বিস্তারের একমাত্র অর্থ হইতেছে, নির্দিষ্ট এলাকা বা স্থাপনা হইতে যাহা অবৈধভাবে আয় হয়, উহা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। উহার উদ্দেশ্য নিতান্তই অর্থকড়ি ভাগবাটোয়ারা।
এই জন্যই কি ছাত্র হলগুলোতে আধিপত্য বিস্তারের নামে অর্থের অবাধ লেনদেনের কারণে বন্দুকযুদ্ধ চলে?
হ্যাঁ তুমি আধিপত্য বিস্তারের সঠিক অর্থ ধরিতে পারিয়াছ।
মহাত্মন! আমার আশঙ্কা হইতেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে নামবদলের পালার সঙ্গে সঙ্গে যদি আধিপত্য বিস্তারের পালা-বদল হয়, তাহা হইলে দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হইবে। এমতাবস্থায় দেশের অগ্রগতির সকল কার্যক্রমই স্থবির হইয়া যাইবে।
তোমার আশঙ্কা অমূলক নহে। দেশ যদি উত্তরোত্তর অস্থিতিশীল হইয়া উঠে, তাহাতে রাজনৈতিক দলের প্রতিহিংসার আগুনে মানুষের জীবন পুড়িয়া ছারখার হইতে পারে।
এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের ভূমিকা কি হওয়া উচিত?
সাধারণ মানুষের এক্ষণে অসাধারণ কোনো ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে বলিয়া আমার মনে হয় না। এরপরে আমাদের দেশের ঐতিহ্যগত রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে হরতাল আহ্বান করা হইলেও সাধারণ মানুষের নীরব দর্শক হওয়া ছাড়া করণীয় কিছুই নাই। এই দেশে সরকার হরতাল ব্যতীত অন্য কোনো রাজনৈতিক ভাষা বোঝে না।
প্রভু! সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সফররত একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছে। তাহারা গণতন্ত্রকে বিকশিত ও সংহত করিতে সরকারকে উদার এবং সহনশীল হইতে আহ্বান জানাইয়াছে। একই সঙ্গে তাহারা বিরোধী দলকে রাজপথ হইতে সংসদে অধিকতর সময় প্রদানের আহ্বান জানাইয়াছে।
আমাদের বন্ধুপ্রতিম অভিভাবকবৃন্দ বিভিন্ন সময়ে নানা বিষয়ে উদাত্ত আহ্বান জানায়। নিতান্ত বাধ্য না হইলে উহাতে কেহ কর্ণপাত করে না।
হুজুর! গোস্তাকি মাফ করিলে একটি কথা বলিতে ইচ্ছা করি।
তুমি নির্ভয়ে বলো।
অদ্যকার আলোচনায় ইতিবাচক কোনো সুর ধ্বনিত হইতেছে না। কেবল হতাশাব্যঞ্জক বিষাদের করুণ সুর ধ্বনিত হইতেছে।
বত্স! আমি দিব্যদৃষ্টিতে চোখের সম্মুখে গণতন্ত্রের একটি কফিন দেখিতে পাইতেছি। প্রতিপক্ষের প্রতি প্রতিহিংসায় ওই কফিনটিতে গণতন্ত্র যেন শায়িত হইয়াছে। তবে আমার প্রতীতী জন্মাইয়াছে, কোনো অলৌকিক ক্ষমতাবলে ঐ শবাধার হইতে গণতন্ত্র বুঝি বাহির হইয়া আসিয়া বলিবে, ‘আমি মরি নাই, মরিতে পারি না। সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় আমি চিরকাল বাঁচিয়া থাকিব।’
প্রভু! ইহা কি সম্ভব?
আশাবাদী মানুষের নিকট সকলই সম্ভব। গুরুদেব শান্তকণ্ঠে কহিলেন, হতাশার অন্ধকার বাস্তবতা হইলেও আশার সূর্যোদয় অধিকতর বাস্তব। আইসো! আমরা রাজনীতিবিদদের পারস্পরিক সহমমির্তা, সমঝোতা ও শুভবুদ্ধির জন্য প্রার্থনা করি।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
ই-মেইল: mahbub_talukdar@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.