সম্পাদকের কলাম-ইলিয়াস আলী কবে ফিরবেন! by ইমদাদুল হক মিলন

একটি পরিবারের পিতা কিংবা স্বামী কিংবা প্রধান পুরুষমানুষটি নিখোঁজ হলে সেই পরিবারটির অবস্থা কী রকম দাঁড়ায়?
ইলিয়াস আলীর পরিবারের কথা ভাবলে কতগুলো দৃশ্য আমার চোখে ভেসে ওঠে। আমি কল্পনা করতে পারি পরিবারটির এখনকার চেহারা কী রকম।


দিনগুলো কাটে তাদের নানা রকম সান্ত্বনায়, আত্মীয়-পরিজন আর দলীয় নেতা-কর্মীদের নানা রকম প্রবোধে। কিন্তু রাতের বেলায় কেমন দাঁড়ায় পরিবারটির চেহারা। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তিন সন্তানকে কিভাবে আগলান, কিভাবে প্রবোধ দেন তাদের। স্বামী নিখোঁজ, এর চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায় তাঁর কাছে তাঁর সন্তানদের পিতা নিখোঁজ- এ ব্যাপারটি। দুই ছেলে একটু বড় হয়েছে, তারা হয়তো বাবাকে নিয়ে অনেক রকমের কথাবার্তা নিজেদের মধ্যে বলে। বাবা নিশ্চয়ই ভালো আছেন, বাবা নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন। পত্রপত্রিকায় বাবাকে নিয়ে এত লেখালেখি, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে এত আলাপ-আলোচনা, সারা দেশের মানুষ বাবাকে নিয়ে ভাবছে, র‌্যাব, পুলিশ, সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা সবার এত চেষ্টা, বাবা নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন। বাবার কোনো ক্ষতি হতে পারে না।
তারা আশায় আশায় থাকে। বাবা ফিরবেন, বাবা নিশ্চয়ই ফিরবেন।
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী সারা রাত জেগে থাকেন। ছোট্ট মেয়েটি থাকে তাঁর কোলের কাছে, নিখোঁজ স্বামীর কথা ভেবে চোখের জলে ভাসেন তিনি। এই চোখের জল সন্তানদের দেখতে দেন না। তাহলে তারা নার্ভাস হয়ে যাবে। তাদের তিনি ভরসা দেন। যখন একা থাকেন, গভীর রাত, বাচ্চারা ঘুমিয়ে, এই ফাঁকে কাঁদেন তিনি। ছোট্ট মেয়েটির হয়তো কখনো কখনো ঘুম ভেঙে যায়। মায়ের জেগে থাকা কিংবা কান্না সে টের পায় না। বিছানায় উঠে বসে। মাকে আলতো স্বরে ডেকে বলে, মা, বাবা কই? বাবা কোথায় গেছে? বাবা কবে ফিরবে?
মা তাকে ছেলেভোলানো কথা বলেন নিশ্চয়ই। সব কষ্ট হৃদয়ে চেপে মেয়েকে প্রবোধ দেন। তাকে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করেন।
সিলেটের বিশ্বনাথের দূর গ্রামে ইলিয়াস আলীর মা জেগে থাকেন সারা রাত। আল্লাহপাকের কাছে দয়া চান আর কাঁদেন। হে আল্লাহ, আমার ইলিয়াসকে ফিরিয়ে দাও। যেখানে যত আত্মীয়-পরিজন আছেন, বন্ধু-স্বজন আছেন, দলীয় নেতা-কর্মীরা আছেন সবার ওই একই প্রার্থনা, আল্লাহপাক যেন ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেন। সবাই আশায় আশায় থাকেন, ইলিয়াস আলী কবে ফিরবেন!
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর বেশ কয়েক দিন কেটে গেছে। পত্রপত্রিকায় ও টেলিভিশনে তাঁকে নিয়ে নানা ধরনের খবর প্রচারিত হচ্ছে। নানা ধরনের গুজবও আমাদের কানে আসছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কোনো হদিস নেই নিখোঁজ এই নেতার। তাঁদের নেতাকে ফেরত পাওয়ার জন্য একের পর এক হরতাল দিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। হরতালে কী কী ক্ষতি হচ্ছে দেশের সেসব নিয়েও লেখালেখি চলছে পত্রপত্রিকায়। টেলিভিশনের পর্দা গরম করে ফেলছেন টক শোতে তুখোড় কথা বলিয়েরা। যাঁকে নিয়ে এত কিছু তাঁর সামান্যতম হদিসও পাওয়া যাচ্ছে না। কেন তিনি এভাবে নিখোঁজ হলেন? কোথায় আছেন তিনি, কেমন আছেন? বেঁচে আছেন তো!
আওয়ামী লীগ-বিএনপির নয়- এ প্রশ্ন দেশের সব মানুষের। এ কেমন রাজনীতি শুরু হলো বাংলাদেশে? নেতা নিখোঁজ হয়ে যান আর তাঁর কোনো হদিস করতে পারে না সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা, র‌্যাব, পুলিশ। একজন নেতার ক্ষেত্রেই যদি এমন হয় তাহলে সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা কোথায়? সাধারণ মানুষ নিখোঁজ হলে, গুম হলে তাদের কী হবে? একটা দেশ তো শুধু নেতা-নেত্রীদের দেশ নয়, দেশটি তো ১৫ কোটি সাধারণ মানুষের দেশ। মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ তো শুধু নেতা-নেত্রীরা স্বাধীন করেননি। দেশ স্বাধীন করেছিলেন দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষ। অস্ত্র হাতে নিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের নানা রকমভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে সাধারণ মানুষ দেশ স্বাধীন করেছেন। রাজাকার-আলবদর-আলশামস নামের কিছু দেশবিরোধী, পাকিস্তানিদের পা চাটার দল ছাড়া দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। দেশ স্বাধীন করেছেন। তারপর ৪০ বছর কেটে গেছে। ৪০ বছরে সাড়ে সাত কোটি মানুষ আমরা দ্বিগুণ হয়েছি। কিন্তু দেশপ্রেম কি আমাদের কমে গেছে?
কেউ কেউ বলেন, আরে নারে ভাই, একাত্তরের মতো দেশপ্রেম এখন আর আমাদের নেই। আমরা আমাদের দেশটাকে আর আগের মতো ভালোবাসি না। এই কথা আমি বিশ্বাস করি না। আমরা এখনো আমাদের দেশটিকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। সাম্প্রতিক সময়ের একটা নমুনাই আমাদের দেশপ্রেমের উজ্জ্বলতম সাক্ষী। এশিয়া কাপ ক্রিকেটে মাত্র ২ রানে পাকিস্তানের কাছে হেরে যাওয়ার পর মিরপুর স্টেডিয়ামে কান্নার রোল পড়েছিল। ১১ জন ক্রিকেটারের সঙ্গে দেশের ১৫ কোটি মানুষ চোখের জলে ভেসেছিল। এই চোখের জলের অর্থ হচ্ছে দেশপ্রেম। একটুও কমেনি আমাদের দেশপ্রেম। আমাদের এই দেশটিকে আমরা গভীরভাবে ভালোবাসি।
আমার এক বন্ধুর কথা বলি। মাঝারি মানের বড়লোক। মালয়েশিয়ায় বাড়ি করেছে, সেই দেশটিকে সেকেন্ড হোম করেছে। দেশের সাম্প্রতিক অবস্থা দেখে তার ছেলেমেয়েরা আর স্ত্রী তাকে চাপ দিচ্ছে, এ দেশে থাকব না। চলো, মালয়েশিয়া চলে যাই। আমার বন্ধু অনড়। সে যাবে না। ব্যবসায়ী হওয়ার পরও সাহিত্য পাঠের অভ্যাস আছে তার। সুনীলের একটি কবিতার লাইন স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের শোনাল।
'বিষণ্ন আলোয় এই বাংলাদেশে, এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো'
এরপর আর কিছু বলার থাকে না। এই মানুষটির কথা শুনলেই বোঝা যায়, আমরা আমাদের দেশটিকে কত ভালোবাসি।
আবার ইলিয়াস আলীর কথায় ফিরি। তাঁর স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। স্বজন হারানোর বেদনা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে কে বেশি বোঝেন আমার জানা নেই। পঁচাত্তর সালে তিনি তো শুধু প্রিয় বোন শেখ রেহানাকে ছাড়া আর সবাইকে হারিয়েছেন। ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে গভীর মমতায় তাঁর হাত ধরে সান্ত্বনা দিয়েছেন। ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের আশ্বাস দিয়েছেন। ইলিয়াস আলীর ছোট্ট মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে আদর করেছেন। পুরো পরিবারটির পাশে দাঁড়িয়েছেন। এসব ছবি পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে দেখে দেশের মানুষ খুশি হয়েছে, আশান্বিত হয়েছে। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী আর সন্তানরা আশার আলো দেখতে পেয়েছেন, ইলিয়াস আলীর মা পেয়েছেন বিশাল ভরসা।
প্রধানমন্ত্রী কোনো দলের নন, তিনি সরকারের প্রধান, দেশের প্রধানমন্ত্রী। আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা। তিনি যখন একটি পরিবারকে আশ্বস্ত করেন তখন পরিবারটি তো বটেই, দেশের মানুষও স্বস্তি পায়, আশান্বিত হয়। আমরা এখন সে রকম আশান্বিত। ইলিয়াস আলীকে নিশ্চয় পাওয়া যাবে। নিশ্চয়ই দেশের মানুষের সামনে হাসিমুখে ফিরে আসবেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.