হিলারির চীন-বাংলাদেশ-ভারত সফর-কৌশলগত সম্পর্ক ও মৈত্রী জোরদারের চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র by মেহেদী হাসান

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটনের চলমান বেইজিং-ঢাকা-কলকাতা-দিল্লি সফরকে এ অঞ্চলের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক ও মৈত্রী জোরদারের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও কূটনীতিকরা। সুদূরপ্রসারী এই প্রচেষ্টা বাস্তবায়নে এ অঞ্চলের সঙ্গে আরো বেশি ঘনিষ্ঠতা চায় ওয়াশিংটন।


ভূরাজনীতিতে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সহযোগিতা পাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ তারও প্রমাণ মিলছে এ সফরগুলোতে।
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-চীন কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সংলাপ। গতকালই আবার শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-চীন উচ্চ পর্যায়ে 'কনসালটেশন অন পিপল টু পিপল এক্সচেঞ্জ' (সিপিই)। সংলাপগুলোতে নেতৃত্ব দিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এখন বেইজিংয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রকাশিত বিবৃতি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের জনগণের মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও নারী ইস্যুতে মৈত্রী জোরদার করাই সিপিইর লক্ষ্য।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র-চীন অর্থনৈতিক সংলাপে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের রাজনৈতিক, কৌশলগত, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ইস্যুতে জোরালো আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
এ ধরনের সংলাপ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাববলয় তৈরিতে কতটা ভূমিকা রাখছে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক চলমান ওই সংলাপের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ইরান, উত্তর কোরিয়া ও অন্যান্য বৈশ্বিক ইস্যুতে উত্তেজনা কমাতে চীনকে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছেন হিলারি ক্লিনটন।
ওই কূটনীতিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সম্পর্ক এ অঞ্চলের একেকটি দেশের সঙ্গে একেক রকম। চীন, ভারতের ক্ষেত্রে তা সামরিক দিক পর্যন্ত বিস্তৃত। ইরান ও উত্তর কোরিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রত্যাশা পূরণের জন্য চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। আবার একই সঙ্গে চীনকে তাগিদ দিচ্ছে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য।
বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সহযোগিতা বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত হলেও তা বিশেষ রূপ পায়নি এখনো। গত ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাবি্লউ মজিনা বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তাসহ সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে কৌশলগত সহযোগিতা কাঠামো চুক্তির স্বপ্নের কথা বলেন। হিলারির সফরের প্রাক্কালে দুই দেশের যৌথ ঘোষণার জন্য যে খসড়া নিয়ে কাজ চলছে তাতে 'কৌশলগত সহযোগিতা সংলাপ'-এর প্রস্তাব থাকলেও 'কৌশলগত' শব্দটি নিয়ে বাংলাদেশের আপত্তি আছে বলে জানা গেছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, কৌশলগত সংলাপের ক্ষেত্রে 'নিরাপত্তা' ইস্যুটি সবার আগে আসে।
বাংলাদেশের সঙ্গে হঠাৎ কৌশলগত সংলাপের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, প্রতিবেশী অনেক দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এমন সংলাপ ও সহযোগিতার সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে, এ অঞ্চলের ভৌগোলিক গুরুত্বের কথা চিন্তা করেই যুক্তরাষ্ট্র আরো বেশি সম্পৃক্ত হওয়ার কথা বিবেচনা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ ও এ অঞ্চলের গুরুত্ব বাড়ছে। এর একটি কারণ হলো ভারত মহাসাগর। বর্তমানে ভারত মহাসাগর দিয়ে বিশ্বের ৭৫ শতাংশ বাণিজ্য হচ্ছে।
তা ছাড়া বাংলাদেশের উন্নতি ও স্থিতিশীলতা এ অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অস্থিতিশীল বাংলাদেশের বোঝা এ অঞ্চল বইতে পারবে না। আকরামুল কাদের বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে দুবার প্রস্তাব পাস হয়েছে। এর একটিতে বাংলাদেশকে সাহায্য করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় নিবিড়। যুক্তরাষ্ট্র চায়, বাংলাদেশের সঙ্গেও ভারতের সুসম্পর্ক থাকুক। বাংলাদেশের পরিণতি পাকিস্তানের মতো হোক তা কাম্য নয় ওয়াশিংটনের।
সূত্র আরো জানায়, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা বিদায় নেবে। দেশটিতে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলো যাতে ভূমিকা রাখে যুক্তরাষ্ট্র তা প্রত্যাশা করে।
হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাবেন। দিল্লিতে তিনি ভারতীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক পর্যালোচনা করবেন। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক পারমাণবিক কর্মসূচিতে সহযোগিতা পর্যন্ত বিস্তৃত। দিল্লি সফরের আগে হিলারি কেন কলকাতা যাচ্ছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, পশ্চিমবঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের সম্ভাবনা থাকতে পারে। তা ছাড়া ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির দল তৃণমূলের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাংলাদেশের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে আগ্রহ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে চায়। গত মাসে দুই দেশের মধ্যে আমরা প্রথম সামরিক সংলাপ হতে দেখেছি।' তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সব সময় নৌসুবিধা পাওয়ার বিষয়কে গুরুত্ব দেয়। বঙ্গোপসাগরের পারে বাংলাদেশ এমন এক স্থানে অবস্থিত যার পাশে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ভারত রয়েছে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি চীনও বাংলাদেশের খুব কাছে, আবার আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যও বাংলাদেশ থেকে খুব দূরে নয়।
ড. দেলোয়ার হোসেন আরো বলেন, ভবিষ্যতে যেকোনো প্রয়োজনের কথা বিবেচনায় রেখেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশসহ পুরো অঞ্চলের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক দৃঢ় করতে চায়। তিনি বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিরসনের পর ওই এলাকায় খনিজসম্পদ অনুসন্ধানের দায়িত্ব কারা পাবে তা নিয়েও প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলোরও আগ্রহ রয়েছে।
ড. দেলোয়ার বলেন, বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সব সময় বহুমুখী কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে যেমন ঢাকা ভালো সম্পর্ক রাখছে, তেমনি রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও। সম্প্রতি বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও অস্ত্র ক্রয়ে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা হচ্ছে। আবার বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের আগ্রহ রয়েছে। বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্র দেখছে কৌশলগত উপস্তিতি হিসেবে। এ কারণে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক ও মৈত্রী জোরদার করে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে তার নিজের প্রভাব বজায় রাখতে চায়।

No comments

Powered by Blogger.