গুয়ানতানামো কারাগার-আট বছরে কী বদলাল by ফ্রিদা বেরিগান

গুয়ানতানামোর ক্যাম্প এক্স-রেতে প্রথম ২০ জন আটক বন্দীকে নিয়ে যাওয়া হয় আট বছর আগে, ২০০২ সালের ১১ জানুয়ারি। এরপর সাত বছর পূর্ণ হওয়ার কয়েক দিন পর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দায়িত্ব গ্রহণের দ্বিতীয় পূর্ণ দিবসে এক বছরের মধ্যে কারাগারটি বন্ধ করে দেওয়ার একটি নির্দেশ জারি করেন।


এ নির্দেশনার ভাষা ছিল সুস্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন, ‘নষ্ট করার মতো কোনো সময় আমাদের নেই।’ মন্তব্য করেছিলেন, নিজেদের মূল্যবোধ, আদর্শ বিসর্জন না দিয়েই যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে পারে। সেই লক্ষ্যে সত্যিকারের পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ব্যতিক্রমহীন ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি যে যুক্তরাষ্ট্র কাউকে নির্যাতন করবে না। দ্বিতীয়ত, গুয়ানতানামো বে কারাগার আমরা বন্ধ করব এবং এখন যারা সেখানে আটক আছে, তাদের বিষয়ে কী করা হবে তা ঠিক করব।’
সেই দিনটা ছিল ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি। কিন্তু ওবামা প্রশাসন তাদের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে কারাগারটি বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারাগারে বন্দীদের ওপর চলেছে নিষ্ঠুর উপায়ে জিজ্ঞাসাবাদ, এমনকি তারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অনেকের ভাষ্যে নির্যাতনমূলক কৌশল অবলম্বনের কথা উঠে এসেছে। এখন শোনা যাচ্ছে, ২০১০ সালের শেষ পর্যন্ত এটি খোলাই থাকবে। আর ইলিনয়ে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কারাগারে (ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজন) বন্দীদের স্থানান্তরের প্রস্তাব কার্যকর হলে প্রতীক হিসেবে গুয়ানতানামো বাহ্যত না থাকলেও এটির সঙ্গে যুক্ত আইনি জটিলতাগুলো রয়ে যাবে। একই রকমের সমস্যাজনক ব্যাপার হলো, ওবামা প্রশাসনের আফগানিস্তানে এমন কারাগারের বিস্তার ঘটানো, যেগুলো আইনজীবী ও মানবিক সংস্থাগুলোর কাছে প্রায় অগম্য।
যেসব বন্দীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই অথবা যারা বিচারাধীন নয়, তাদের ‘দীর্ঘমেয়াদি বন্দিত্ব’র যে পরিকল্পনা ওবামা করছেন তা বন্দী ব্যক্তির মৌলিক আইনি ও মানবাধিকার হরণ করে। এ ধরনের পরিকল্পনা নির্বাহী ব্যবস্থার প্রায় অসীম ক্ষমতার বেপরোয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে আমেরিকার শাসনব্যবস্থাকে আরও গভীরভাবে কলুষিত করে।
বড়দিনে ডেট্রয়েটের উদ্দেশে যাত্রা করা এক বিমানের যাত্রীর আত্মঘাতী হামলার চেষ্টা কোনোমতে ঠেকিয়ে দেওয়া গেছে। কিন্তু এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের মাল্টি বিলিয়ন ডলারের নিরাপত্তা-প্রক্রিয়ার দুর্বলতাকে উন্মোচিত করেছে। কিন্তু এ ঘটনার পর যা যা ঘটল তাতে স্পষ্ট হলো, কেমনভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শগুলোর স্খলন অব্যাহত আছে। ওবামার নীতিতে তার পূর্বসূরির নীতির প্রতিফলন ঘটছে এবং তাঁর উচ্চমনস্ক বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথামালার সঙ্গে তা মিলছে না।
ডেট্রয়েটগামী ফ্লাইট ২৫৩-এর ঘটনার প্রতিক্রিয়া শুধু বিমানবন্দরগুলোতে লম্বা সারি, শরীর স্ক্যান আর নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ভুল স্বীকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। রিপাবলিকান নেতা ও রক্ষণশীল মিডিয়া থেকে ত্বরিত উচ্চকিত ও বিদ্বেষপূর্ণ ঘোষণা আসতে থাকল যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একমাত্র পথ যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু ও আইনের শাসনকে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আঘাত করা। তারা বলতে শুরু করল, হামলার চেষ্টাকারী ফারুক আবদুল মুত্তালিবকে গুয়ানতানামোতে পাঠাও। গুয়ানতানামো কখনো বন্ধ করা চলবে না। সন্দেহভাজন সন্ত্রাসবাদীদের যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক আদালতে বিচারের পরিকল্পনা বাতিল করো। ‘জিজ্ঞাসাবাদের বর্ধিত কৌশলগুলো’ পুনরুজ্জীবিত করো। সংক্ষিপ্ততম সময়ে আইনি প্রক্রিয়ায় সন্দেহভাজন আল-কায়েদা সদস্যদের হত্যা করো।
এমন সব কথা ওবামা প্রশাসন জনসমক্ষে চ্যালেঞ্জ করেনি। তবে, গুয়ানতানামো কারাগার থেকে সব ইয়েমেনি বন্দীর মুক্তি বাতিল করার মাধ্যমে আতঙ্কের কারবারিদের কাছে ইতিমধ্যে ওবামা প্রশাসন একটি দুঃখজনক ছাড় দিয়েছে। এমনকি সরকারের গুয়ানতানামো রিভিউ টাস্কফোর্স কর্তৃক নির্দোষ ঘোষিত বন্দীরাও এর মধ্যে পড়েছে। নির্দোষ ব্যক্তিদের আরও মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর আটকে রাখার এ সিদ্ধান্ত থেকে ওবামা প্রশাসনের নকশা সম্পর্কে পাকা ধারণা লাভ করা যায়। পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া এই প্রশাসন বুশের সময়ের মতো একই ধরনের কাজ করে চলেছে।
ওবামা প্রশাসনের আরও একগুচ্ছ নীতি কোনো অংশে কম সমস্যাজনক নয়: সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের গোপনে অপহরণ ও স্থানান্তর এবং গোপন কারাগার পরিচালনার চর্চা অব্যাহত রাখা; কিছু বন্দীর বিচারে বুশের মতো সামরিক কমিশনের পরিকল্পিত ব্যবহার; আফগানিস্তানে বারগ্রাম কারাগারের বিস্তার ঘটানো ও সেখানকার আফগান যুদ্ধক্ষেত্রে আটক হয়নি এমন বন্দীদেরও তাদের বন্দিত্ব চ্যালেঞ্জ করার অধিকার অস্বীকার করা; সাবেক বন্দীরা যেসব অসদাচরণের শিকার হয়েছিল, তার প্রতিকার চেয়ে করা মামলাগুলো ঠেকানোর জন্য বারবার, উদ্দেশ্যমূলক ‘রাষ্ট্রীয় গোপনীয় বিষয়াদি’ রক্ষার দোহাই দেওয়া; এবং বুশ প্রশাসনের সময়ে বন্দী নির্যাতন নীতিমালার পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও বাস্তবায়নকারীদের কার্যকর দায়মুক্তি দেওয়া। ওবামা প্রশাসনের অধীনে এসব নীতি সত্যিকারের পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত বহন করে না।
আগামী দিনগুলোতে কী ঘটতে যাচ্ছে তার উদ্বেগজনক লক্ষণ ফুটে উঠেছে সম্প্রতি বুশ-নিযুক্ত বিচারক জেনিস রজার্স ব্রাউনের বক্তব্যে। গুয়ানতানামো কারাগারের এক বন্দীর হেবিয়াস করপাস আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে তিনি মত দেন, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আমাদের নতুন এক প্যারাডাইসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা নতুন আইন রচনার দাবি করে...যুদ্ধ আইনের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ, আইনকে অবশ্যই এ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।’
যা হতেই হবে, এ বক্তব্য ঠিক তার উল্টো। কঠিন সময় আর যুদ্ধের প্রচণ্ডতার মধ্যে আইনের জন্য দরকার এমন প্রেসিডেন্ট, যিনি শুধু কথায় নয়, কাজে প্রমাণ দেন।
ফরেন পলিসি ইন ফোকাস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ফ্রিদা বেরিগান: যুক্তরাষ্ট্রের কলামিস্ট ও উইটনেস এগেইনস্ট টর্চারের সংগঠক।

No comments

Powered by Blogger.