মেহনতি মানুষকে প্রেরণা জোগাবে তাঁর জীবনদর্শন-জ্যোতি বসু

ভারতের প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা ও পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মৃত্যুতে আমরা শোকাভিভূত। তাঁর মৃত্যু ভারত তো বটেই, সারা বিশ্বের মেহনতি মানুষের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে দেশে দেশে যখন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটছিল,


তখন এই বামপন্থী নেতা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সমাজতন্ত্রের মূল প্রেরণা সমুন্নত রেখেছিলেন। ধ্রুপদী মার্ক্সীয় দর্শন অনুসরণ না করে তিনি ভারতের আর্থসামাজিক বাস্তবতার নিরিখে যে ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, তা রাজ্যের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে সহায়ক হয়েছে; বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গ বামফ্রন্ট সরকারের ভূমি সংস্কার ও পঞ্চায়েত-ব্যবস্থা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের জন্যও অনুসরণীয় হয়ে আছে। ষাটের দশকে মস্কো-চীন বিরোধে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন বিভক্ত হলেও জ্যোতি বসুর প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব তাদের জোটবদ্ধ রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলোর জন্য এ দৃষ্টান্ত অনুসরণীয় বলে মনে করি।
জ্যোতি বসুর জন্ম ১৯১৪ সালে, কলকাতায়। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদী গ্রামে। তিনি পড়াশোনা করেছেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার স্কুল ও কলেজে। পরে ইংল্যান্ডে চলে যান এবং মিডল টেম্পল থেকে বার-অ্যাট-ল ডিগ্রি নেন। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে তিনি ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত হন।
১৯৪০ সালে জ্যোতি বসু দেশে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে জ্যোতি বসু প্রথম বেঙ্গল আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন রেলওয়ে নির্বাচনী এলাকা থেকে। ১৯৬৪ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হলে তিনি নবগঠিত মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য হন। ১৯৭৭ সালের ২১ জুন থেকে ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পরও জ্যোতি বসু রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
১৯৯৯ সালে ক্ষমতাসীন যুক্তফ্রন্ট জ্যোতি বসুকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিলেও তাঁর দল সিপিআইএম সরকারে যোগদানে অস্বীকৃতি জানায়। পরে জ্যোতি বসু দলের এ সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক ভুল বলে অভিহিত করেছিলেন। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সমর্থন জানিয়েছিলেন এই বামপন্থী নেতা। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু।
১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরে ভারত সরকারকে রাজি করাতেও তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকবার জ্যোতি বসু বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি বরাবর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কোন্নয়নে সচেষ্ট ছিলেন।
চীনের প্রয়াত নেতা মাও সে তুং বলেছিলেন, কোনো কোনো মৃত্যু হাঁসের পালকের চেয়ে হালকা, কোনো কোনো মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়ে ভারী। জ্যোতি বসুর মৃত্যুশোক যেমন মেহনতি মানুষের বুকে পাহাড়ের মতো ভারী হয়ে থাকবে, তেমনি তাঁর জীবনদর্শন তাদের নিত্য প্রেরণা জোগাবে।

No comments

Powered by Blogger.