বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৮৪ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। সাইদুর রহমান, বীর প্রতীক দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে দক্ষিণে নাগরপুর উপজেলা। এর পরই মানিকগঞ্জ জেলার সীমানা শুরু। মুক্তিযুদ্ধকালে নাগরপুরে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা অবস্থান।


কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকবার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ করেছেন। প্রতিবারই প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা কোনোবারই জয়ী হতে পারেননি।
নভেম্বর মাসের শেষে মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা কয়েকটি দল মিলে সেখানে আক্রমণ করবেন। এ জন্য সাইদুর রহমান, মালেক ও খোকার নেতৃত্বাধীন দলের বাছাই করা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি দল গঠন করা হলো। তাঁদের সঙ্গে থাকলেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম) নিজেও। আক্রমণের তারিখ নির্ধারিত হলো ৩০ নভেম্বর।
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত দল নির্ধারিত দিন সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে একযোগে আক্রমণ শুরু করলেন। তাঁদের কাছে ভারী অস্ত্র বলতে ২০টি এলএমজি, একটি থ্রি ইঞ্চি মর্টার ও একটি রকেটলাঞ্চার। নাগরপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানটি বেশ সুবিধাজনক ছিল। সামনে সমতল ভূমি ও আশপাশে বাড়িঘর। ফলে এর আগে আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা তেমন সুবিধা করতে পারেননি।
সাইদুর রহমান দুঃসাহসিকতার সঙ্গে সহযোদ্ধাদের নিয়ে গুলি করতে করতে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষার খুব কাছে গিয়ে অবস্থান নেন। সেখান থেকে পাকিস্তানি অবস্থানে প্রচণ্ডভাবে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। মর্টার, এলএমজি ও রকেটের কর্ণবিদারী শব্দে আশপাশ এলাকা কেঁপে উঠতে থাকে।
পাকিস্তানি সেনাদের দলে ছিল এক কোম্পানি মিলিশিয়া ও শতাধিক রাজাকার। তারা সুরক্ষিত বাংকার থেকে পাল্টা আক্রমণ করে। বাংকারগুলো ছিল মাটির নিচে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের দুটি বাংকার ধ্বংস করলেন। কিন্তু তাতেও তারা কাবু হলো না। সারা দিন ধরে গোলাগুলি চলল। ক্রমে রাত নেমে এল। রাতে থেমে থেমে বিক্ষিপ্ত গুলিবিনিময় হলো।
পরের দিন সকালে মুক্তিযোদ্ধারা নতুন উদ্যমে আক্রমণ শুরু করলেন। উপর্যুপরি আক্রমণে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থান ভেঙে পড়ার উপক্রম। তখন আনুমানিক বেলা সাড়ে তিনটা। এমন সময় সংবাদ এল একদল পাকিস্তানি সেনা টাঙ্গাইল থেকে নাগরপুরে আসছে।
সাইদুর রহমান এতে বিচলিত হলেন না। সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকলেন। তাঁদের সাঁড়াশি আক্রমণে হতাহত হলো বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও তাদের সহযোগী রাজাকার। এর মধ্যে সেখানে হাজির হলো পাকিস্তানি সেনাদের নতুন দল। তারা ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। এ অবস্থায় আবদুল কাদের সিদ্দিকী সাইদুর রহমানকে সহযোদ্ধাদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তখন তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পিছে হটে নিরাপদ স্থানে চলে যান।
সাইদুর রহমান ১৯৭১ সালে এইচএসসির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। পরে দেশের অভ্যন্তরে টাঙ্গাইলে গঠিত কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দেন। বল্লা, ঘাটাইলের মাকড়াই, ভূঞাপুরসহ আরও কয়েক স্থানে যুদ্ধ করেন। বল্লার যুদ্ধে নিহত পাকিস্তানি সেনাদের মৃতদেহ পাকিস্তানিরা উদ্ধার করার চেষ্টা করে। তখন তিনি তাঁর দল নিয়ে তা নস্যাৎ করে দেন। যুদ্ধ চলা অবস্থায় তিনি ও তাঁর চার সহযোদ্ধা নদী সাঁতরে নিহত পাকিস্তানি সেনাদের মৃতদেহ নিজেদের অবস্থানে নিয়ে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য সাইদুর রহমানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪২১।
সাইদুর রহমানের পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলার কালিহাতী পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কামার্থী গ্রামে। বর্তমানে বসবাস করেন একই পৌরসভার কুষ্টিয়ায়। বর্তমানে কৃষিকাজ ও স্ত্রীর চাকরির উপার্জনে সংসার চালান। তাঁর বাবার নাম সিরাজুল ইসলাম, মা বছিরুন্নেছা। স্ত্রী শাহীনা পারভীন। তাঁদের দুই মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: প্রথম আলোর সখীপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি ইকবাল গফুর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.