আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৭৩)-শব্দসৈনিক by আলী যাকের

শামসি রেস্তোরাঁয় পঞ্চাশ পয়সায় গরুর মাংসের তরকারি পাওয়া যেত তখন এবং পঁচিশ পয়সায় দুটো চাপাতি। এই মহার্ঘ মধ্যাহ্নভোজ বড় প্রিয় ছিল ছিন্নমূল বাঙালিদের কাছে। পকেটে কিছু পয়সা থাকলে সপ্তাহে কয়েক দিনের ব্যবধানে এই অতি সুস্বাদু খাদ্যের দ্বারস্থ হতাম আমি।


খাওয়ার পর রেস্তোরাঁ কাউন্টার থেকে বিনি পয়সার একমুঠ ধনে মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভাবছি এখন কী করা যায়। এমন সময় আমার কাঁধের ওপরে এসে পড়ল বিশাল এক থাবা। ''কী ব্যাপার, কী করছ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?' আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পাই আলমগীর কবিরকে। বলি, 'কিছু না কবির ভাই।' 'কিছু না? দেশে একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে আর তুমি বলছ কিছু না?' 'তাই তো ভাবছি কাল একবার কল্যাণীতে রিক্রুটমেন্ট অফিসে যাব। দেখি যদি কিছু একটা হিল্লে হয়।' 'তুমি আমার সাথে এসো। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।' বলেই পাশের মিষ্টি-কাম-চায়ের দোকানটাতে ঢুকে পড়েন আলমগীর কবির। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলেন, 'শামসিতে যাও কেন? ওরা প্রচণ্ড বাংলাদেশবিরোধী, প্রো-পাকিস্তানি এলিমেন্ট।' এত সস্তায় এমন উপাদেয় খাবার যে আর কাছাকাছি কোথাও পাওয়া যায় না? কথাটা প্রায় ওষ্ঠাগ্রে এসেই পড়েছিল আমার। তারপর হঠাৎ মনে হয় কবির ভাইয়ের মন্তব্যে যথেষ্ট সারবত্তা রয়েছে। কলকাতার সব পাড়ায়ই বাঙালিরা শরণার্থীদের যেমন একেবারে বুকে টেনে নেয়, কলকাতার বেশির ভাগ মুসলমান তাদের ততোধিক ঘৃণাভরে দূরে সরিয়ে দেয়। এদের সবাই কলকাতায় আছে বেশ কয়েক পুরুষ ধরে। কিন্তু কোনোভাবেই নিজেদের বাঙালি ভাবতে পারে না ওরা। আবার চোস্ত উর্দু বলিয়ে উত্তর ভারতীয় হিসেবেও উত্তরণ ঘটেনি ওদের। বাংলা হিন্দুস্তানির জগাখিচুড়ি এক উপভাষার সৃষ্টি করেছে ওরা। ওদের অবস্থা না যৌ, না তস্থৌ। পাকিস্তানিদের সঙ্গে কেন নাড়ির যোগ, সেটা প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি। পরে বুঝেছিলাম, ভারতে ওরা একধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং বিশ্বাস করে যে বিপদে-আপদে ওদের রক্ষাকর্তা হবে পাকিস্তান। ওদের এই ধারণাটা যে কত ভুল সে কথা ভেবে আমার একেক সময় হাসি পায়। কলকাতার এই যে জনগোষ্ঠীটি, এদের হাতে অনেক শরণার্থী ইতিমধ্যে লাঞ্ছিতও হয়েছে। বাংলাদেশের স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী মুস্তাফা আজিজ একদিন পার্ক সার্কাসের ব্রাইট স্ট্রিট নামে একটি রাস্তায় একটি বাচ্চার পেনসিল স্কেচ্ করছিলেন। মুস্তাফা আজিজকে যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন এই শিল্পীর আঁকার ব্যাপারে বিষয়ের কখনো অভাব হতো না কোনো দিন। যেকোনো বিষয় তাঁকে আগ্রহী করে তুলত চোখের নিমেষে। তিনি যখন আঁকছিলেন তখন তাঁকে ঘিরে একটা ভিড় জমে উঠেছিল। তারা মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছিল শিল্পীর কাজ। এমন সময় একজনের মন্তব্য, 'বাহ! আপনি তো বেশ ভালো আঁকেন।' 'ধন্যবাদ'। শিল্পীর জবাব। 'আপনার বাড়ি কোথায়?' 'আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি।' মুস্তাফা আজিজ স্বভাবতই আশা করেছিলেন যে কলকাতা শহরে বাংলাদেশ শব্দটি উচ্চারিত হলেই শিল্পীর কর্মের প্রতি আগ্রহ দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। ঘটল তার ঠিক উল্টোটি। তাঁর কাগজ, পেনসিল, ড্রইং বোর্ড সব কেড়ে নেওয়া হলো। তাঁকে চরম অপমান এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হলো।
অবশ্য আমি এটাও জানি যে এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মুসলমান হিসেবে জন্মগ্রহণের কোনো সম্পর্ক নেই। ইতিমধ্যে আমার পরিচয় হয়েছে জাস্টিস মাসুদের সঙ্গে, বামপন্থী রাজনীতিবিদ ডক্টর গনির সঙ্গে, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিধায়ক মনসুর হাবিবুল্লাহ্‌র সঙ্গে, সাহিত্যিক এবং বাংলা ভাষার বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত আবু সায়ীদ আইউবের সঙ্গে, সাহিত্যিক, সাংবাদিক গোলাম কুদ্দুসের সঙ্গে। এঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলি সে সাহস কখনোই হয়নি আমার। দূরে বসে এঁদের কথা শুনেছি। ভেবেছি এ রকম মুক্তবুদ্ধির মানুষ যেকোনো সমাজে কয়েকজন থাকলেই তো বুদ্ধিমুক্তির চরম মানবিক যুদ্ধে জেতা সম্ভব!
'শোনো, তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।' বললেন কবির ভাই। ''রেডিও পাকিস্তান ঢাকা থেকে প্রচারিত 'দ্য হোল ট্রুথ' কমেন্টারিটা শুনেছ?" 'শুনেছি, গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়।' বলি আমি। 'আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি সার্ভিসটা দেখি। আমার একার পক্ষে সব কিছু সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমার সাহায্য চাই। ইংরেজি ভাষার ওপর তো তোমার দখল ভালোই। তুমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দাও না কেন? আমরা দুজনে একসঙ্গে হলে We can take them on. আর বহির্বিশ্বে আমাদের সংগ্রাম সম্পর্কে সঠিক সংবাদ আরো বেশি করে দেওয়া সম্ভব হবে, বাংলায় তো সেটা সম্ভব নয়।' 'কিন্তু আমি যে যুদ্ধে যাব?' বললাম আমি। 'আহা, এও তো যুদ্ধ এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যুদ্ধ। শব্দসৈনিক!' আমি দুদিনের সময় চেয়ে নিই। কবির ভাই দুদিন পর দেখা করতে বলে বালীগঞ্জের একটা ঠিকানা আমার হাতে গুঁজে দেন। এবং ঋজু, টানটান পদক্ষেপে ঠিক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি যেমন ছিলেন, একটা ট্রামে লাফিয়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে যান। আমি ভাবতে থাকি। যেদিন আলমগীর কবিরের সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কথা, সেদিন ভোরবেলা আমি হাঁটছিলাম পার্ক সার্কাসের সীমান্তে অবস্থিত বিখ্যাত চার নম্বর পুল পার হয়ে ধাপার পাশে জলার ধার ধরে। এই চার নম্বর পুলের নিচ দিয়ে চলে গেছে কলকাতার চক্র রেলের লাইন। আমার হাতে একটা নুড়িপাথর। আমি নুড়িপাথরটাকে নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ সেটাকে ছুড়ে দিলাম জলার ওপরে। জলার ওপরে কতগুলো তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। আমার মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে, 'শব্দসৈনিক!'
(চলবে.....)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.