শিক্ষকসংকটে কারিগরি শিক্ষা হয়ে পড়েছে সনদসর্বস্ব by রিয়াদুল করিমশিক্ষকসংকটে কারিগরি শিক্ষা হয়ে পড়েছে সনদসর্বস্ব by রিয়াদুল করিম

দেশের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের যে ধরনের প্রায়োগিক দক্ষতা নিয়ে বের হওয়ার কথা, তা তাঁরা অর্জন করতে পারছেন না। ডিপ্লোমা ডিগ্রির সনদ পেলেও তাঁদের কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জিত হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ও জার্মানির কারিগরি শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় এই চিত্র ফুটে উঠেছে।


এতে দেখা যায়, দক্ষতার দিক থেকে জার্মানির টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের তুলনায় বাংলাদেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা অনেক পিছিয়ে আছেন। দক্ষতা নিরূপণে বিভিন্ন পরীক্ষায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা জার্মানির শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বরের এক-চতুর্থাংশ পেয়েছেন।
কারিগরি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ জন্য শিক্ষকের অভাবকে অনেকাংশে দায়ী করছেন। তাঁরা বলছেন, শুধু পলিটেকনিক নয়, শিক্ষক ও টেকনিক্যাল কর্মচারীর স্বল্পতার কারণে ব্যাহত হচ্ছে দেশের সামগ্রিক কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীদের যে দক্ষতা নিয়ে বের হওয়ার কথা, তা তাঁরা অর্জন করতে পারছেন না। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়ার মান বজায় রাখা যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ শিক্ষকস্বল্পতা।’
চেয়ারম্যান আরও বলেন, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক পদের বেশির ভাগই শূন্য। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে গোঁজামিল দিয়ে। বিষয়টি জানলেও সমাধানে কেউ এগিয়ে আসছেন না।
বাংলাদেশ ও জার্মানির বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১৬০ জন করে শিক্ষার্থীর ওপর ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায়োগিক গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। এতে বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা কেমন ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছেন, তা যাচাই করা হয় বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ১৬টি পরীক্ষা নেওয়া হয়।
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল শিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারুক আহমেদ হাওলাদার এবং জার্মানির স্টুটগার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিনহল্ড নিকোলাস গবেষণাটি পরিচালনা করেন।
ওই গবেষণায় মুখস্থ করে মনে রাখা, বোঝা এবং প্রয়োগ—তিনটি ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা যাচাই করা হয়েছে। দেখা গেছে, মনে রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা ভালো করলেও পরবর্তী দুটি পর্যায়ে, অর্থাৎ বোঝা ও প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ভালো করতে পারেননি।
পাঁচ বছরের প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ করে ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া হয়। অন্যদিকে জার্মানির ছাত্রদের যাচাইয়ের জন্য যে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়, তাতে ব্যবহারিক দিকটাই প্রাধান্য পায়।
গবেষক ফারুক আহমেদ হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে কিছু কিছু বিভাগে মাত্র এক বা দুজন নিয়মিত শিক্ষক আছেন। এ ক্ষেত্রে সদ্য পাস করা খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে ক্লাস পরিচালনা করা হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা আশানুরূপ দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না।
কারিগরি শিক্ষক সমিতির সভাপতি ইদ্রিস আলী বলেন, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য। এ ছাড়া ব্যবহারিক ক্লাসের প্রশিক্ষক নেই বললেই চলে। এর মধ্যে আবার দ্বিতীয় শিফট চালু করা হয়েছে। এ অবস্থায় শিক্ষার মান নেমে যাওয়া স্বাভাবিক।
শিক্ষকসংকট: কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে এখন সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আছে ৪৯টি, আর ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট আছে ৬৪টি। এ ছাড়া আছে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বস্ত্র প্রকৌশল, কৃষি ইনস্টিটিউটসহ মোট ১৫ ধরনের প্রতিষ্ঠান। এসব মিলে সরকারি মোট প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৫১টি। এর মধ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, মনোটেকনিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটগুলোতে মোট স্থায়ী ও অস্থায়ী শিক্ষক পদের ৪৬ শতাংশই শূন্য। এ ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর পদের ৫৬ শতাংশ খালি রয়েছে। অন্যদিকে ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটগুলোতে শিক্ষকদের শূন্য পদ ৬৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০ সালের হিসাবে, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৪৬।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, টিটিসি, মনোটেকনিক, পলিটেকনিক, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে প্রথম শ্রেণীর (শিক্ষক) মোট সৃষ্ট পদ আছে এক হাজার ৩৬১টি। এর মধ্যে শূন্য ৬৪৯টি। দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষকের মোট ৭১২টি পদের মধ্যে ৩৭৪টি শূন্য। এ ছাড়া তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষকের মোট পদ ২০০, এর মধ্যে ২৫টি পদ শূন্য। একইভাবে শূন্য রয়েছে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর পদও।

No comments

Powered by Blogger.