চরাচর-বীর বিক্রম আজিজ বাঁচতে চান by উম্মে কুলসুম মৌ

মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে অসামান্য অবদান রাখার জন্য রাষ্ট্র আমার বাবা আবদুল আজিজকে বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত করেছে। পাঁচ নম্বর সেক্টরের অকুতোভয় এই সৈনিক আজ মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অসহায় অবস্থায় পড়ে আছেন। দেখার, খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই।


পারিবারিকভাবে ওষুধ-পথ্য জোগানোর মতো কোনো সুযোগ পর্যন্ত নেই! সম্প্রতি আমি শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ থেকে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। থিসিসের কাজটা এখনো বাকি। এরই মধ্যে বাবার ভয়ানক অসুস্থতায় মুষড়ে পড়েছি। কী করব, ভেবে পাচ্ছি না। কিভাবে বাবার চিকিৎসার খরচ চালাব, কিভাবে তাঁকে সুস্থ করে তুলব, কিছুই জানি না। ছোটবেলা থেকেই ভালো ছাত্রী ছিলাম বলে নানা রকম বৃত্তি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত আসতে পেরেছি। আমার মা-বাবা গর্ব করে বলতেন, আমাদের মেয়ে অনেক বড় হবে, বড় চাকরি করবে। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরোনোর আগেই মা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। আর বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়ে রইলেন সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এক সময় হাসপাতাল থেকে তাঁকে ফিরিয়ে নিতে হলো গ্রামের বাড়িতে। হাসপাতালের ডাক্তাররা বললেন, তাঁদের কাছে আর কোনো চিকিৎসা নেই। একবার বলেন ঢাকায় নিয়ে যেতে, আরেকবার বলেন বাড়িতে নিয়ে যেতে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বাড়িতেই ফিরতে হলো বীর বিক্রম আবদুল আজিজকে। কারণ, ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য তাঁর পরিবারের নেই। আমরা তিন বোন, এক ভাই। আমার ভাই তখন মাত্র এসএসসি পাস করেছে। ওই বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তাকে। আর লেখাপড়া হয়নি।
আমার বাবার জন্মের কয়েক মাস আগে তাঁর বাবা মারা যান। পাঁচ মাস বয়সে মারা যান মা। বড় হয়ে ওঠেন মামির কাছে। অনেক চেষ্টায়, নিজের বুদ্ধিমত্তায় লেখাপড়া শিখতে সক্ষম হন। এরপর যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঢাকার কর্মস্থল থেকে পালিয়ে সিলেটে চলে আসেন। যোগ দেন পাঁচ নম্বর সেক্টরের বালাট সাব-সেক্টরের অন্যতম কম্পানি কমান্ডার হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, নিজের অধীনস্থ সৈনিকদের দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেন। যুদ্ধের মধ্যেই চিকিৎসার অভাবে মারা যায় আমার ভাই জুয়েল। দুর্ভাগ্য, আমার ভাইকে কাফনের নতুন কাপড়ও দেওয়া সম্ভব হয়নি তখন। বাবা যুদ্ধ শেষেই কেবল জানতে পারেন, তাঁর ছেলে মারা গেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাবা আর সেনাবাহিনীতে ফিরে যাননি। নতুন দেশের নতুন পুলিশ বাহিনীতে হাবিলদার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এরপর একদিন বাংলাদেশ গেজেট, ডিসেম্বর ১৫, ১৯৭৩ প্রকাশিত হয়, যাতে যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি ঘোষিত হয়। আমার বাবা 'বীরবিক্রম' উপাধিতে ভূষিত হন। ১৭৫ জন বীরবিক্রমের মধ্যে ৭০ নম্বরে আছে আমার বাবার নাম। আমি আমার বাবার জন্য গর্ব বোধ করি। কারণ, আমার বাবা আমাদের প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। কিন্তু আমার দুঃখ হয়, যখন আজ তাঁর মতো মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিককে অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। আমি তাঁর চোখে বাঁচার ইচ্ছা দেখি। কিন্তু ঢাকায় নিয়ে কিংবা বিদেশে পাঠিয়ে উন্নত চিকিৎসা করানোর সাধ্য কোথায় আমাদের? আমি আজ এই বীর মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসার জন্য সরকার এবং দেশবাসীর দিকে তাকিয়ে আছি। জানি না, কে এগিয়ে আসবেন আমার বাবার সুচিকিৎসার জন্য। সরকার, দেশবাসী কি এই বীর মুক্তিযোদ্ধার পাশে এসে দাঁড়াবে?
উম্মে কুলসুম মৌ

No comments

Powered by Blogger.