পাকিস্তান-সরকার-বিচার বিভাগ মুখোমুখি by ডেক্লান ওয়ালস

সরকার ও বিচার বিভাগের এই সংঘাত সম্পূর্ণরূপে একটি বিস্ময়কর বিষয়কে ঘিরে।'সুইস লেটার' নামে পরিচিত যে বিষয়টি গোটা বিবাদের কেন্দ্রে রয়েছে, সেটা অর্থহীন প্রমাণিত হতে পারে। যে সুইস আইনজীবী ও ম্যাজিস্ট্রেট এই মামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা জেনেভা থেকে এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে জানান,


এই মুহূর্তে জারদারির বিরুদ্ধে মামলা পুনরুজ্জীবিত করা কার্যত অসম্ভব



বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে দৃশ্যত প্রতীকী শাস্তি প্রদান করলেও এই রায়ের কারণে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হতে পারে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত ও সরকারের মধ্যে কয়েক মাস ধরে বাদানুবাদ ও অচলাবস্থা চলার পর বৃহস্পতিবার রায় প্রদানের পর মুলতবি ঘোষণা পর্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে শাস্তি প্রদান করে। এটা জানামতে সবচেয়ে লঘু দণ্ড বলা যায়।
এই শাস্তিটা প্রতীকী হলেও প্রধানমন্ত্রীকে এ জন্য আগামীতে বেশ সমস্যায় পড়তে হতে পারে। তাকে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার প্রশ্ন আসবে। এই মামলাটি পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভঙ্গুরতাকে আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এখানে উল্লেখ করা যায়, দেশটি যখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট ও নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলা করছে, তখন দেশের সরকার ও বিচার বিভাগ পরস্পর লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। উভয় পক্ষই এখন পর্যন্ত স্ব-স্ব অবস্থানে অনড়।
সুইস ব্যাংকে প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির কথিত অবৈধ অর্থ গচ্ছিত রাখা নিয়ে রজু করা একটি মামলার নিষ্ক্রিয় তদন্ত প্রক্রিয়াকে পুনরায় সচল করতে সুইস কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখতে প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে আদালত আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সংবিধান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে বিচারের আওতাবহির্ভূত রেখেছে উল্লেখ করে এই আদেশ পালন করতে অপারগতা প্রকাশ করেন গিলানি।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রধানমন্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি প্রদান করে দেওয়া আদালতের এই রায় পাকিস্তানকে নতুন আইনি জটিলতায় নিয়ে যেতে পারে। আর জারদারি সরকারের জন্য এর নিহিতার্থ প্রণিধানযোগ্য। জানুয়ারিতে সামরিক ক্যু জল্পনা মাটি দিয়ে সরকার যখন তার ৫ বছর মেয়াদ পূর্ণ করার আশা করছে, তখন এই রায় ঘোষিত হলো।
পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, জেনারেল, এমনকি ক্রিকেটার পর্যন্ত সবার মধ্যে দুর্নীতি মহামারীর মতো বিস্তার লাভ করেছে। সেখানে এখন ঘুষ আদান-প্রদান, স্বজনপ্রীতি ডালভাত। আর এটা পাকিস্তানের বহু চর্চিত পুরনো সমস্যাও বটে। এখানে দুর্নীতির জন্য দায়ীদের শাস্তি প্রদানের প্রক্রিয়াটাও আবার অনেক বেশি রাজনীতিকরণকৃত। রাজনীতির ক্ষেত্রেই হোক আর সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রেই হোক, দুর্নীতিকে এখানে একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায়। বস্তুত সব রাজনীতিবিদ এবং অনেক সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ের মাধ্যমে হয়তো এটা দেখাতে চেয়েছেন যে, মহামারীর আকারে বিস্তার লাভ করা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় তাদের সদিচ্ছা যেমন রয়েছে, তেমনি ক্ষমতাও রয়েছে। বৃহস্পতিবার এই রায় ঘোষণার আগে বুধবার সৈন্যদের ইসলামাবাদের চেকপয়েন্টগুলোতে নজরদারিতে বসানো হয় ও টিভি-রেডিও সেন্টারগুলো সরাসরি এই সংবাদ সম্প্রচারের ব্যবস্থা করে।
সরকার ও বিচার বিভাগের এই সংঘাত সম্পূর্ণরূপে একটি বিস্ময়কর বিষয়কে ঘিরে। 'সুইস লেটার' নামে পরিচিত যে বিষয়টি গোটা বিবাদের কেন্দ্রে রয়েছে, সেটা অর্থহীন প্রমাণিত হতে পারে। যে সুইস আইনজীবী ও ম্যাজিস্ট্রেট এই মামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা জেনেভা থেকে এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে জানান, এই মুহূর্তে জারদারির বিরুদ্ধে মামলা পুনরুজ্জীবিত করা কার্যত অসম্ভব।
তাদের মতে, মামলা পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে একটি বাধা হচ্ছে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার সাংবিধানিক সুরক্ষা কবচ। অন্যটি হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের ১৫ বছরের আইনের সীমাবদ্ধতা। অবশ্য এটা চলতি বছরেই শেষ হচ্ছে। আর তৃতীয় বাধাটি হচ্ছে, সুইস কর্তৃপক্ষের অসহিষ্ণুতা।
১৯৯০'র দিকে যিনি জারদারির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনেছিলেন সেই ড্যানিয়েল জাপেলি্ল বলেন, সুইজারল্যান্ডে আপনি যেমনটা খুশি তেমনটা করতে পারেন না। একদিন হয়তো আপনি একটি মামলা নিয়ে হাজির হলেন, আবার আরেকদিন বললেন_ সেটা চালাবেন না। তা হবে না। আমরা মামলার সব দিক পর্যালোচনার জন্য পাকিস্তানিদের সঙ্গে ১০ বছরের মতো সময় ব্যয় করেছি। পুনরায় একই বিষয় নিয়ে কাজ করতে আমরা উৎসাহিত নাও হতে পারি। মি. জাপেলি্ল ৩১ মার্চ জেনেভা কেঁৗসুলি হিসেবে পদত্যাগ করেছেন। তার উত্তরসূরির মহিলা মুখপাত্র ওলিভার জারনট এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ ব্যাপারে সুইস অনীহা একটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সেটি হচ্ছে, তাহলে কেন পাকিস্তানের বিচারক এবং রাজনীতিবিদরা এই বিষয়টি নিয়ে পায়ে পা লাগিয়ে অর্থহীন বিবাদে জড়াতে গেলেন?
এই সংঘাতটা অংশত প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আক্রমণাত্মক মনোভাবের কারণেই বাধে। মি. চৌধুরীর সঙ্গে জারদারির সম্পর্ক তিক্ত। ২০০৯ সালে তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে পুনর্নিয়োগদান করতে চাইলে জারদারি বাধা দিয়েছিলেন। সেই থেকে অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ প্রতিপন্ন করে বারবার সরকারের কর্তৃত্বকে প্রধান বিচারপতি চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করেছেন।
সমালোচকদের মতে, আদালত কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার এখতিয়ারকে ছাড়িয়ে যায়। তখন আদালতকে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে ধাবিত হতে দেখা যায়। এবার প্রধানমন্ত্রীকে শাস্তি প্রদানের ঘটনায়ও আদালত তার এখতিয়ার ছাড়িয়ে গেছেন বলেই কতিপয় বিশ্লেষক মনে করেন। পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ডনের কলামিস্ট সিরিল আলমেইডা মনে করেন, সামরিক বাহিনীর মতো সুপ্রিম কোর্টও মনে করে থাকতে পারেন যে, তারাও সরকারকে ভীতসন্ত্রস্ত করে দিয়ে তাদের ইচ্ছাপূরণে বাধ্য করাতে পারবেন। সরকার এসবকে ধোঁকাবাজি বলছে।

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে ভাষান্তর
সুভাষ সাহা

No comments

Powered by Blogger.