বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে -আলাপচারিতা :সুগত বসু

বাঙালিদের মধ্যে অনেক প্রতিভা রয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ শক্তির প্রকাশে সমস্যা রয়েছে। ব্যক্তিগত প্রতিভাকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে নিয়ে আসা হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের উদ্যোগে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে। একই সঙ্গে থাকতে হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।


হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারিভাবে পরিচালিত। কিন্তু বেসরকারিভাবে পরিচালিত হলেও কোনো প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য মুনাফা
হতে পারে না


'হিজ ম্যাজেস্টিস অপোনেন্ট :সুভাষ চন্দ্র বোস অ্যান্ড ইন্ডিয়াস স্ট্রাগেল এইেনস্ট এম্পায়ার' বইয়ের প্রকাশনা উপলক্ষে ঢাকা এসেছিলেন অধ্যাপক সুগত বসু। নেতাজী সুভাষ বসুর ভাই শরৎ চন্দ্র বসুর পৌত্র তিনি। পিএইচডি করেছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, বর্তমানে বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গার্ডিনার প্রফেসর অব হিস্ট্রি। তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে পেজান্ট লেবার অ্যান্ড কলোনিয়াল ক্যাপিটাল এবং এ হান্ড্রেড হরাইজন : দি ইন্ডিয়ান ওসেন ইন দি এজ অব গ্গ্নোবাল এম্পায়ার। হিজ ম্যাজেস্টিস অপোনেন্ট বা সম্রাটের প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাজী সুভাষ বসুর জীবনকথা। বুধবার বিকেলে সমকালের সহযোগী সম্পাদক অজয় দাশগুপ্তের সঙ্গে তিনি কথা বলেন এ বইসহ নানা প্রসঙ্গে।
চার দশকের বাংলাদেশ
বুধবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ভবনে বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গুণীজনের সমাবেশ ঘটেছিল। অনুষ্ঠানের আগেই নীল পাঞ্জাবি ও সাদা পাজামায় ড. সুগত বসুকে দেখা গেল নানাজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় ব্যস্ত। জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন তার খুবই পরিচিত। সত্তরের দশকের শেষার্ধে এখানে এসেছিলেন গবেষণার কাজে। থেকেছেন ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের অতিথি কক্ষে। সহাস্যে জানালেন, বিকেলে সমকালের সঙ্গে কথা বলবেন। সময়মতো হাজির হয়ে মুখোমুখি বসে পড়ি সোনারগাঁও হোটেলের সুইমিংপুল এলাকায়। সেই সকালের পোশাকেই তিনি হাজির। বাংলাদেশে কী পরিবর্তন নজরে পড়ছে, এটাই ছিল আমার মূল প্রশ্ন। তিনি বলেন, ১৯৭৯-৮০ সালে যখন এসেছি তখন শহর ও গ্রাম সর্বত্রই দারিদ্র্যের যথেষ্ট ছাপ ছিল। এখনও যে দরিদ্র মানুষ নেই, সেটা বলব না। তবে চার দশকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে, সেটা নিদ্বর্িধায় বলা চলে। সত্তরের শেষ দিকে ঢাকায় মোটর গাড়ি তেমন ছিল না। তখন যেসব প্রাইভেট গাড়ি দেখেছি তার অনেকগুলোতে হলুদ প্লেটে লেখা থাকত_ সা.স. অর্থাৎ সাহায্য সংস্থা। সরকারি লাল প্লেটের গাড়িও দেখা যেত। এখন প্রাইভেট গাড়ি প্রচুর এবং অনেকে বলছেন, যানজটের বড় কারণ হয়ে উঠেছে এসব গাড়ি। একই সঙ্গে তা কিন্তু অনেক লোকের সচ্ছলতারও নিদর্শন। মেয়েদের শিক্ষার প্রসারে সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গ থেকেও বাংলাদেশ কিন্তু অনেক বেশি সফল। এখানে নতুন গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে উঠছে। ১৯৭১-এ মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্তদের বিচারের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সব ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ভাষাভিত্তিক বাঙালি দেশপ্রেমের ভিত্তি এবং এটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখতে পেয়েছি।
একাত্তরের রণাঙ্গনে
নেতাজী সুভাষ বসু বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামেরও প্রেরণা ছিলেন। তার দৌহিত্র, যিনি একজন খ্যাতিমান ঐতিহাসিকও_ বাংলাদেশে এসেছিলেন একাত্তরেই। কী ভাবে? জানালেন, সে সময়ে দশম শ্রেণীর ছাত্র। নভেম্বরের এক বিকেলে বাবা শিশির বসু বললেন, চলো বনগাঁ সীমান্তে যাই। তিনি একজন চিকিৎসক। বনগাঁয় নেতাজী ফিল্ড হাসপাতালে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের চিকিৎসা দেওয়া হতো। বাবা তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। পরে মায়ের কাছে শুনেছি, এ হাসপাতালে স্যালাইনের অভাব ছিল। ডাক্তাররা নিজেদের মধ্যে আলাপ করতেন, কচি ডাবের জল ব্যবহার করে কাজ চালানো যায় কি-না। তক্তপোষ পেতে ২৫ বেডের ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে ওষুধ সংগ্রহ করা হয়। বাবা এখানে তার কাজ শেষ করে আমায় নিয়ে চলেন যশোর-খুলনা সড়ক ধরে। কী রোমাঞ্চকর সময় এক কিশোরের জন্য! বাংলাদেশের বেশ কিছুটা ভেতরে যাওয়ার পর আমাদের গতিরোধ করে জানিয়ে দেওয়া হলো, সামনে যুদ্ধ চলছে। আর যাওয়া ঠিক হবে না। তিনি বলেন, সে সময়টি ছিল বিভীষিকাময়, একই সঙ্গে ছিল অগণিত মানুষের বীরত্বের কাহিনীতে ভরপুর।
সুগত বসুর মা কৃষ্ণা বসু পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেত্রী, লোকসভার সদস্য। পুত্রের বইয়ের প্রকাশনা উপলক্ষে তিনিও ঢাকা এসেছিলেন। সুগত বসু জানালেন, একাত্তরের ১৮ এপ্রিল কলকাতার পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশন অফিসের সব বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে লাল-সবুজ-সোনালি পতাকা উড়িয়ে দেয়। আমার বাবা ও মা সেদিন ওই ভবনে গিয়ে ভারতে বাংলাদেশের প্রথম হাইকমিশনার হোসেন আলীর হাতে ফুল তুলে দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি বাবা ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধু এ সময়ে অশ্রুসিক্ত। বাবাকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের চিত্র তুলে ধরে বলেন, আমাদের আর কিছুই নেই। বাবা উত্তরে বলেন, আপনাদের সব আছে। রক্তের বিনিময়ে যারা স্বাধীনতা অর্জন করে তাদের কিছুই শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যায় না। ছাত্রাবস্থায় বঙ্গবন্ধু নেতাজী সুভাষ বসুর ডাকে কলকাতায় হলওয়েল মুনমেন্ট বিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন এবং এ বিষয়েও স্মৃতিচারণ করেছিলেন বলে বাবার কাছে শুনেছি।
বাংলাদেশের আদর্শগত ভিত
বাংলাদেশের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ যিনি কৈশোরে প্রত্যক্ষ করেছেন, তার নানা গবেষণায় এখন ঘুরে-ফিরে আসছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে মুক্তির আকাঙ্ক্ষার মূলে ছিল সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণের সমাবেশ। দুই দশক ধরে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল বাঙালি দেশপ্রেমের এক আদর্শ। এ দেশপ্রেম কখনও ধর্মীয় আইডেনটিটি বর্জন করেনি, বরং সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে চলছিল। একাত্তরের কয়েকটি মাস এ বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের নতুন করে পরিচয় ঘটে। সে সময়ে মনে আছে শিল্পী ফাহমিদা খাতুনের রেকর্ডে শুনেছি বারবার :'এখনও তারে চোখে দেখিনি শুধু বাঁশি শুনেছি...।' তবে সৌভাগ্য যে, 'বাংলাদেশ যাদের চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের অনেকের সঙ্গে আমার বাবা-মা ও আমার সরাসরি পরিচয় গড়ে উঠেছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং সেখানকার পুঁজিপতিদের দ্বারা পূর্ব বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতির বিশেষত পাটচাষিদের শোষণের ঘটনা মুক্তি সংগ্রামীদের জন্য একটি গণভিত তৈরি করে দিয়েছিল। বাংলাদেশের কৃষক সমাজ আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফা দাবির প্রতি বিপুল সমর্থন জানায় এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এ দলকে নিরঙ্কুশ বিজয় এনে দেয়। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র তুলে না নিলে স্বাধীনতাকামী মানুষের স্বপ্ন হয়তো সফল হতো না। পারিবারিক কারণেই মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার সুযোগ আমার হয়েছিল। সে সময়ে কলকাতার নেতাজী ভবন ছিল মুক্তি সংগ্রামীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী সেনা অফিসার নাজমুল হুদার কাছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনা আমি শুনেছি। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের সময় তাকে হত্যা করা হয়।'
শিক্ষা-বাণিজ্য নয়
কলকাতার নামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্সি কলেজ এখন বিশ্ববিদ্যালয়। তবে নানা কারণে এর গৌরবের ধারায় খানিকটা ছেদ পড়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা উঠছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসে সুগত বসুর নেতৃত্বে একটি মেন্টর গ্রুপ করে দেন, যার দায়িত্ব হবে সংস্কারের বিভিন্ন সুপারিশ উপস্থাপন। এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তার কী পরিকল্পনা সেটা জানতে চেয়েছি, পাশাপাশি প্রশ্ন করেছি তার শিক্ষা ভাবনা নিয়ে। তিনি বলেন, নেতাজী সুভাষ বসু এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলেন। বাঙালি মননে এ প্রতিষ্ঠানের রয়েছে বিশেষ স্থান। এ প্রতিষ্ঠানের অনেক প্রাক্তন ছাত্র পরবর্তী জীবনে বিখ্যাত হয়েছেন। যেমন বলতে পারি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেনের কথা। আমাদের মেন্টর গ্রুপের কাজের সঙ্গে তিনি বিশেষভাবে যুক্ত রয়েছেন। গত তিন দশকে এ প্রতিষ্ঠানের অধঃপতন ঘটেছে বলে কথা উঠছে। অনেক ভালো শিক্ষক চলে গেছেন কিংবা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা চাই এটিকে ফের উন্নতমানের করে গড়ে তুলতে। তবে এটি যেন কোনোভাবেই আলাদা দ্বীপ হিসেবে গড়ে না ওঠে, সে বিষয়ে আমরা সচেতন। আমাদের লক্ষ্য_ এটি যেন হয়ে ওঠে দৃষ্টান্তস্থানীয়। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়নের প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই আমরা এগিয়ে যেতে চাই। সুগত বসু বলেন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মানের হেরফের থাকবে, এটি স্বাভাবিক। অনেক প্রতিষ্ঠান কখনও বেশ খানিকটা এগিয়ে যায়, আবার থেমে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও এক সময়ে খুব খ্যাতি ছিল। আমি এটা বলতে পারি যে বাঙালিদের মধ্যে অনেক প্রতিভা রয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ শক্তির প্রকাশে সমস্যা রয়েছে। ব্যক্তিগত প্রতিভাকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে নিয়ে আসা হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের উদ্যোগে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে। একই সঙ্গে থাকতে হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারিভাবে পরিচালিত। কিন্তু বেসরকারিভাবে পরিচালিত হলেও কোনো প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য মুনাফা হতে পারে না। এ বিষয়ে উদ্যোক্তাদের অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে।
সুগত বসু বলেন, সুভাষ বসু আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করেছিলেন। সে সময়ে তাদের অর্থভাণ্ডার শক্তিশালী থাকার কথা নয়। কিন্তু তার মধ্যেও থাইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি চালুর জন্য বৃত্তি দিয়েছিলেন তিনি।
এশিয়ার পুনর্জাগরণ ও বাংলাদেশ
দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশে দারিদ্র্য সমস্যা প্রকট_ এ তথ্য ইতিহাসবিদ সুগত বসুর জানা রয়েছে। তার গবেষণাতেও এ প্রসঙ্গ বারবার এসেছে। তবে তিনি আশার আলোও দেখছেন। এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নতির পথে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। এশিয়ার পুনর্জারণ ঘটছে। দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সর্বত্র এগিয়ে যাওয়ার লক্ষণ। বাংলাদেশ শুধু এ প্রক্রিয়ায় শামিল হবে না, থাকবে নেতৃত্বের ভূমিকায়_ এমনটিই মনে করেন সুগত বসু। এক সময়ে এ দেশটিকে পশ্চিমি বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলো বাস্কেট কেস বলত। এখন সে ধারণা বদলেছে। এ দেশের উন্নতি সহজেই দৃশ্যমান।
সম্রাটের প্রতিদ্বন্দ্বী
নেতাজী সুভাষ বসু সম্পর্কে লেখা বইটি নিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ভবনে বক্তব্য রেখেছেন সকালে। সেখানে তিনি বলেন, সুভাষ চন্দ্র সম্পর্কে ধারণা, তিনি শুধু যোদ্ধা দেশনায়ক। কিন্তু সেটাই সব নয়। কেমন মানুষ ছিলেন তিনি? সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনে কি কোনো টানাপড়েন ছিল তার? গবেষণার সময় এগুলোও দেখতে চেয়েছিলাম এবং তা উঠে এসেছে বইয়ে। ভারতের জনজীবনে দু'জন আলাদা সুভাষ চন্দ্র_ একজন ইতিহাসের চরিত্র। রক্ত-মাংসের মানুষ। আরেকজন ভক্তদের কাছে ভগবানতুল্য। তিনি বিমান দুর্ঘটনায় মরতে পারেন না। আমি বলেছি, শুধু যোদ্ধা, দেশনায়কের ইমেজে গুরুত্ব দিলে ভ্রান্তি আসবেই। সকালে বইয়ের আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, নেতাজী জেলখানায় বসে কিংবা প্রবাসে অনেক চিঠি লিখেছেন। লক্ষণীয় যে বাঙালি মেয়েদের কাছে লেখা সব চিঠিই লিখেছেন বাংলায়। কিন্তু এমনকি ভাই শরৎ বসুর কাছে যখন লিখেছেন, তার ভাষা ইংরেজি। সন্দেহ নেই যে আইসিএস পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অধিকার করা সুভাষ বসুর জীবন ছিল এক্সট্রা অর্ডর্িনারি। তাকে নিয়ে মিথ হতেই পারে। মহাত্মা গান্ধী তাকে বলেছেন, আমার বিদ্রোহী পুত্র। অন্তরীণ অবস্থা থেকে তিনি পালিয়ে চলে গেলেন কাবুল হয়ে জার্মানিতে। তারপর সাবমেরিনে জাপানে। তাকে নিয়ে কল্পকাহিনী তো হতেই পারে। হিজ ম্যাজেস্টিস অপোনেন্ট বইয়ে বলা হয়েছে : এপ্রিল ২, ১৯৪৩। ভারত মহাসাগরে এগিয়ে চলেছে জাপানি সাবমেরিন আই ২৯। অভিযানে চরম গোপনীয়তা। অপরদিক থেকে এগিয়ে আসছে জার্মান সাবমেরিন ইউ ১৮০। উত্তাল মহসাগরে ভেসে চলেছে দুই ডুবোজাহাজ। ২৭ এপ্রিল দুই ডুবোজাহাজ কাছাকাছি এলো। ২৮ এপ্রিল প্রত্যুষে জার্মান সাবমেরিন থেকে একটি ডিঙি নৌকায় উঠলেন দুই ভারতীয় তরুণ। উত্তাল ঢেউয়ে উথালপাথাল করতে করতেই তাদের ডিঙি পেঁৗছে গেল জাপানি সাবমেরিনের কাছে। ডুবোজাহাজ থেকে ডুবোজাহাজে যাত্রী পারাপারের ঘটনা এমনকি নৌবাহিনীর সদস্যদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে কি?
রক্ত দাও, স্বাধীনতা দেব
নেতাজী সুভাষ বসুর প্রসঙ্গ এলেই সবচেয়ে বেশি করে আসে প্রবাদ বাক্যে পরিণত হওয়া এ কথাটি_ তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি স্বাধীনতা দেব। অথচ সুগত বসু বলছেন, এভাবে কথাটি তিনি আদৌ বলেননি। রক্তের কথা গান্ধীজীও বলেছিলেন_ স্বাধীনতার মূল্য দিতে গেলে আমাদের রক্তের নদী বইয়ে দিতে হবে। সুভাষ বসু বলেছেন, ব্লাড ব্রাদারহুড ফর পূর্ণ স্বরাজ ইন ইন্ডিয়া। তারা দু'জনেই ব্রিটিশের রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়া নয়, দেশবাসীকে রক্তের বিনিময়ে আত্মাহুতির ডাক দিয়েছেন। সুভাষ বসু বলেছেন, দিলি্ল ইজ কলিং। ব্লাড ইজ কলিং টু ব্লাড। তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব_ এমন কথা তিনি কখনও বলেননি। এটি বাঙালির অতিসরলীকরণ। তিনি নিজেকে বাঙালি নয়, ভারতীয় পরিচয় দিতেন। অমর্ত্য সেন বহুমুখী আইডেনটিটির কথা বলছেন। একটি লোক একই সঙ্গে বাঙালি, ভারতীয়। সুভাষ বসুর বিশ্বাস সেখানেই। তিনি ছিলেন পরিপূর্ণভাবে অসাম্প্রদায়িক। তিনি হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য চেয়েছেন এবং সে জন্য কাজ করেছেন। ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাছাউনিতে বিভিন্ন ধর্মের সৈনিকদের জন্য ছিল আলাদা ক্যান্টিন_ বিভেদের জন্যই এমনকি করা। সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজে হিন্দু-মুসলিম-শিখ সবার জন্য এক ক্যান্টিন। মুসলিম মনে আঘাত লাগতে পারে, এমন ধারণা থেকেই ১৯৪২ সালে 'বন্দেমাতরম'-এর বদলে 'জনগণমনঅধিনায়ক'কে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেন তিনি। তিনি ব্যক্তিগত জীবনের আনন্দ জীবন থেকে বাদ দেননি। কিন্তু একই সঙ্গে তার ছিল জনগণের প্রতি ও দেশের প্রতি দায়িত্ব। আর এর প্রতিই ছিল তার প্রকৃত ভালোবাসা। জীবন দিয়ে তিনি তার প্রমাণ রেখে গেছেন।
সুগত বসু বলেন, নেতাজী সুভাষ বসু মরতে পারেন না, এমন বিশ্বাস অনেকের। তিনি ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছেন। উপমহাদেশের মানুষ তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিল, কল্পনা করেছিল। আমরা এটাও জানি যে, মানুষের কল্পনার মৃত্যু হয় না। সুভাষ বসুর মৃত্যু ১৯৪৫ সালের আগস্টেই হয়েছে এবং এটা বিমানে তার সহকর্মী এবং অন্যদের সাক্ষ্য থেকে সমর্থিত। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে।
 

No comments

Powered by Blogger.