সরল গরল-সংসদনেত্রী, ‘শকুন’ সহোদর ও সপ্তম সংশোধনী by মিজানুর রহমান খান

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ যা ‘ভাই-বোন’, কাল তা-ই ‘দেবর-ভাবি’। এটা অবশ্য অতি পুরোনো খোঁচা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পতিত স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদের ছবি দেখে আমাদের আরও একটি ছবির কথা মনে পড়ল। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের ঘনিষ্ঠতার ছবি।


তাঁরা সাংবাদিকদের সামনে পোজ দিয়েছিলেন। এরও আগে অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছে দোয়া চাইতে গিয়েছিলেন বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী। বিচারপতি হিসেবে কিংবা তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়ে নয়; আওয়ামী লীগের মনোনীত রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে। একদল চেনা মিত্রজীবীর কাছে এসবের টাটকা ব্যাখ্যা মজুদ আছে।
তবে এ নিবন্ধ যে কারণে লেখা, তার কারণ হলো, সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়গুলোর কালি শুকাতে না-শুকাতেই প্রধান অভিযুক্তের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক অনুষ্ঠান। সবচেয়ে বড় বিস্ময়মিশ্রিত প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রপক্ষ ও আওয়ামী লীগের সমর্থক আইনজীবীরা সপ্তম সংশোধনী মামলায় অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে জেনারেল এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে অমন ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছিলেন কেন? ফৌজি স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের মুণ্ডপাত করে থামলেই তো হতো। তবে তাঁরা কেন এমন প্রচণ্ডতায়, সর্বাত্মকভাবে এরশাদের বিচার চাইলেন। আমরা অবাক বিস্ময়ে রায় পড়ি আর ভাবি, অ্যাটর্নি জেনারেল ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলদের হলো কী! অ্যাটর্নি জেনারেল যদিও সাংবিধানিক পদ। কিন্তু সেটা অন্যান্য পদের মতো শক্ত নয়। তাঁর চাকরি মন্ত্রীদের মতোই। চুন থেকে পান খসলেই ফুটুস। তাই আমরা দৃশ্যত ধরেই নেব, অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর কোনো কেতাবি চর্চা করেনি। সরকারের নির্দেশনা তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। শুধু এরশাদ নন, তাঁর সহযোগীদেরও তাঁরা শাস্তি চেয়েছেন। খটকা সেখানেই।
স্ববিরোধিতা ও নির্লজ্জতার এমন দৃষ্টান্ত বহুদিন আমরা দেখিনি। তবে এসব কথা বলে আমাদের রাজনীতিকদের কাউকে লজ্জা দেওয়া যাবে না। তবে আমরা বুঝতে চাই, সপ্তম সংশোধনীতে এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে এমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলা হলো কেন?
এও বোধগম্য, সামরিক সংস্কৃতি যেকোনোভাবেই আওয়ামী লীগ সংস্কৃতি নয়, সেটা মানুষকে ভুলতে না দেওয়া। অবশ্য অষ্টম সংশোধনীর রায়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের একটি মন্তব্য পড়ার পর থেকে আমার প্রায়ই মনে হয়, স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক কালচারের চাষাবাদ চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমেই ঘটেছিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সেদিন বলেছেন, জিয়াউর রহমান সংসদকে রাবার স্ট্যাম্প করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও পার্লামেন্টকে রাবার স্ট্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। সংসদে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই কালাকানুনসর্বস্ব চতুর্থ সংশোধনী তার সাক্ষ্য। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতার শত্রুরা তাতে উল্লসিত হয়েছিলেন, আর মিত্ররা হয়ে পড়েছিলেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সেটা ছিল যেন বেসামরিক ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত একটি অভ্যুত্থান।’
আওয়ামী লীগের সমর্থক আইনজীবী ও তদীয় গণমাধ্যম পঞ্চম সংশোধনী ও সপ্তম সংশোধনী নিয়ে যেসব কারণে মাতামাতি করছে, এর অন্যতম একটি কারণ হলো, সাধারণ মানুষকে বলা, আওয়ামী লীগ সেনাশাসনবিরোধী। এমনকি শুধু বিরোধী নয়, তারা এবার সংবিধানে এমন সংশোধনী আনবে, যাতে সামরিক শাসন আসার পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যায়!
‘ভাই’ এরশাদের কথায় আসি। পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে আপিল বিভাগে এরশাদের বিচারে ফাঁক রয়ে গিয়েছিল। কারণ, রায়ে বলা হয়েছিল, জাতীয় সংসদ প্রয়োজনে আইন করবে। এরপর আওয়ামী লীগের নেতারা সাফ জানালেন, তাঁরা এমন কিছু করবেন না, যাতে মহাজোটে চিড় ধরে। তাঁরা জানালেন, তাঁরা এরশাদের বিচার করবেন না। সুপ্রিম কোর্টের রায় তাঁদের দিলপছন্দ ততখানি, যতখানি তাঁদের স্বার্থের সঙ্গে খাপ খায়। আর বাকিটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বাকিটা বাতিল।
এরশাদের বিচার করা হবে না, এ কথা আওয়ামী লীগ স্পষ্ট করার পর সপ্তম সংশোধনীর শুনানি হলো। সে কারণেই প্রশ্ন, এরশাদের বিচারের প্রশ্নে রাষ্ট্রপক্ষ এমন অবস্থান নিল কেন?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামান একটি বই লিখতে চেয়েছিলেন। স্বাধীনতার কুখ্যাত বিরোধিতাকারী গোলাম আযম সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নাগরিকত্ব ফিরে পান। এতে নির্মূল কমিটির আন্দোলন স্তিমিত হয়। এটা হয়তো তাঁর চিন্তাজগৎকে আন্দোলিত করে যে বিচার বিভাগ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে বদলে দিতে পারে। এটাকেই তিনি বইয়ের থিম করতে চেয়েছিলেন। এখন আমরা কী দেখি? এটা কি আদৌ হওয়ার? ইয়াজউদ্দিনের সাংবিধানিক বিচ্যুতি সুপ্রিম কোর্ট শুধরে দিয়ে আরও বড় বিচ্যুতি ঠেকাতে পারেননি। কারণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুপস্থিত ছিল। আদালতের রাজনৈতিক ঝোঁক হয়তো আমাদের বড় বিপদের দিকে ঠেলছে। এর পথিকৃৎ হিসেবে ইতিহাসে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের অবস্থান কী হবে, তা দেখার বিষয়।
বিচারপতি এ এইচ এম শামুসদ্দিন চৌধুরী তাঁর রায়ে ক্ষমতা নিতে গিয়ে এরশাদ যা বলেছেন, তাঁকে তিনি যথার্থই ইস্কান্দার, আইয়ুব, মোশতাক, জিয়াউর রহমান, সুহার্তো, পিনোশে, ফ্রাঙ্কো, ইদি আমিন ও জিয়াউল হকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু কে অস্বীকার করবেন যে এই রায়ের মূল্যায়ন ১৯৮২ সালের মার্চে এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণকে স্বাগত জানিয়ে বাংলার বাণীতে লেখা সেই সম্পাদকীয় ভাষ্যকে খাটো করতে পারবে না। সেটাই প্রাধান্য পাবে। রায় পাবে না। ৮ জানুয়ারি রংপুরের সভায়ও আমরা তার ধারাবাহিকতা দেখি। হাইকোর্টের বর্ণিত ধূর্ত স্বৈরশাসক এরশাদ ইতিহাসের ‘কৃষ্ণ গহ্বরে’ নয়, বোনের পাশে ঠাঁই পেয়েছেন।
হাইকোর্টের রায়ে লক্ষণীয়ভাবে এরশাদের বিচার প্রশ্নে একটি স্বতন্ত্র প্যারাগ্রাফ আছে। এর শিরোনাম: এরশাদ ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটকদের কী করে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব? সংবিধানকে বহুকাল নিষ্ক্রিয় করে রাখার দায়ে অভিযুক্ত হন এরশাদ। রায়ে তাঁকে জঘন্য অপরাধ সংঘটক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এরশাদকে বলা হয়েছে ফেলোনি সংঘটক। ফেলোনি শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো নরহত্যা, সশস্ত্র ডাকাতি, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদির মতো গুরুতর অপরাধ। রায়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, এমন একজন জঘন্য অপরাধী কি নির্বিঘ্নে পালাতে পারেন? আদালতই উত্তর দিয়েছেন: ‘আমাদের জবাব যদি নেতিবাচক হয়, তাহলে ইতিহাস আমাদের অভিশংসিত করবে’ অর্থাৎ ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। শুধু এরশাদ নন, তাঁর দুষ্কর্মের সহযোগী এবং এমনকি পঁচাত্তরের ক্যুর সহযোগীদের মধ্যে যাঁরা আজও বেঁচে আছেন, তাঁদেরও আলটিমেট জাস্টিসের মুখোমুখি হতে হবে। এখানে আলটিমেট জাস্টিস শব্দের অর্থ যদি হাসরের ময়দানকে আমরা বুঝে নিই, তাহলে কিন্তু বেশ হয়। তাহলে আর আমাদের হাইকোর্টের রায়ের লঙ্ঘন ঘটে না।
এরশাদের বিচারের বিষয়ে ওই রায়ে লেখা আছে, এম আমীর-উল ইসলাম, আবদুল মতিন খসরু একমত হন যে কোনো বিচারক এরশাদের কাজের বৈধতা দিলে তিনি বা তাঁরা অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত হবেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা অভিমত রাখেন, এরশাদকে কী করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে, তা সরকারই ঠিক করবে। হাইকোর্ট একপর্যায়ে পঞ্চম সংশোধনী মামলায় আপিল বিভাগের রায়েরও বরাত দেন। বলা হয়, আপিল বিভাগ সংসদকে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা উচিত বলে মত দিয়েছেন। এ বিষয়ে অবশ্যই শাস্তি দরকার। কারণ, সেটা ভবিষ্যতের শকুনদের (সেনাশাসক) নিরুৎসাহিত করবে। তাই এরশাদের বিচারে সরকারের এবং জনগণের প্রতিনিধিদের অবশ্যই ‘প্রাইম অবলিগেশন’ বা সর্বাধিক নৈতিক বা আইনি বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে।
আপিল বিভাগ যখন সাংবিধানিক সরকার উৎখাতকারীদের বিচারে প্রচলিত আইনে কোনো বিধান খুঁজে পাননি, তখন আমরা তার সমালোচনা করেছিলাম। দণ্ডবিধির ১২১(এ) ও ১২৪ ধারার আওতায় বিচার সম্ভব বলে মত দিয়েছিলাম। এবার হাইকোর্ট বলেছেন, সরকার সেনাশাসক ও তাঁর সহযোগীদের বিচারে দণ্ডবিধির ওই ধারা বা কোনো বিশেষ আইনে বিচারের সম্ভাব্যতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখতে পারে।
কিন্তু পরিহাস অন্যত্র। সেদিন একটি টিভি আলোচনায় একটি ফোন কল এল। প্রশ্নকর্তার সরল প্রজ্ঞায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না। তাঁর প্রশ্ন এ রকম: ‘আমরা জানি, সংসদের কাজ আইন করা, আর বিচারকের কাজ বিচার করা। এখন সংসদ নতুন সংবিধান দিচ্ছে। তাঁরা তা পুনর্মুদ্রণের নির্দেশ দিচ্ছেন। আর এরশাদকে বিচারকেরা শাস্তি দিচ্ছেন না। বলছেন, সংসদ বা সরকারকে ব্যবস্থা নিতে। এটা কেন?’
ওই প্রশ্নকর্তা বা আমাদেরও তখন জানা ছিল না সপ্তম সংশোধনী আমাদের জন্য নতুন কী বিস্ময় বয়ে আনছে। যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। কাউকে খুন করতে দেখলেও তাঁকে খুনি বলা যাবে না। আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সপ্তম সংশোধনী এরশাদ বা ভবিষ্যতের শকুনদের জন্য কী প্রভাব বয়ে আনল। এরশাদ ফেলোনি হলেন। এমনটা তিনি মেঠো বক্তৃতায় অতীতে বহুবার হয়েছেন এবং হবেন। তবে যেটা দেখার তা হলো, হাইকোর্ট এরশাদকে শাস্তি দিতে পারেননি। কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিতে পারেননি। কিন্তু সংসদের কাজের জবরদখল দৃশ্যত ঠিকই হলো। রায়ে বলা হয়েছে, ‘১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক শাসন ও ফরমানের বৈধতা প্রদানকারী ১৯ প্যারাগ্রাফকে (১৫০ অনুচ্ছেদের চতুর্থ তফসিল) মৃত ঘোষণা করা হলো। সংবিধান থেকে এই মুহূর্তে ১৯ প্যারাগ্রাফ মুছে ফেলা হলো এবং সরকারকে সে মতে সংবিধান পুনর্মুদ্রণের আদেশ দেওয়া হলো।’
কিন্তু ভবিষ্যতের শকুনদের কি মুছে ফেলা যাবে? নাকি পতিত স্বৈরশাসক এরশাদকে মুছে ফেলা যাচ্ছে! সপ্তম সংশোধনীতে এরশাদকে দোষী সাব্যস্ত করার বিষয়টি অন্তত এরশাদের জন্য একটি রাজনৈতিক হুমকি মনে হয়। রংপুরে বোনকে নিয়ে জনসভা করে ভাই নিজেকে কি ধন্য মনে করছেন? এরশাদকে হাস্যোজ্জ্বল মনে হলো কি? এরশাদের ভোট ব্যাংকে শেখ হাসিনা ভাগ বসালেন। সময়টা অবশ্য ব্যাংক দখলের! চাপের মুখে কি এরশাদ তা মেনে নিলেন? শনিবার উৎফুল্ল শেখ হাসিনা আসলে বলেছেন, রংপুর ভাইয়ের নয়, রংপুর বোনের।
আজ যা ‘ভগ্নি-সহোদর’, কাল তা যাতে ‘ভাবি-দেবরে’ (মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের খচ্চর নিয়ে টানাটানি স্মরণযোগ্য) রূপ না পায়, সে জন্য সপ্তম সংশোধনী মামলার রায় একটা ডেটারেন্ট বা নিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে। এরশাদ তেড়ি-বেড়ি করলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ আমাদের সংসদনেত্রী তো আর চুপ করে থাকতে পারবেন না! হাইকোর্টের রায়ের পাতা তখন হয়তো ওল্টাতেই হবে। অবশ্য সে জন্য তেমন পরিবেশ ও সময় থাকতে হবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.