সংঘাত ও শান্তি-সুদানে গণভোট ও শুভসূচনা by বারাক ওবামা

অতীতের পৃষ্ঠা উল্টে ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায় রচনা করার সুযোগ খুব কম প্রজন্মের ভাগ্যেই জোটে। গৃহযুদ্ধে ৫০ বছরে নিহত হয়েছে দুই মিলিয়ন মানুষ, শরণার্থী হয়েছে আরও কয়েক মিলিয়ন। এসব ইতিহাস পেরিয়ে আজ দক্ষিণ সুদানের জনগণের সামনে এই বিরল সুযোগটি এসেছে।


সামনের পুরো সপ্তাহজুড়ে লাখ লাখ দক্ষিণ সুদানি ভোটদানের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবেন, তাঁরা কি সুদানের অংশ হয়েই থাকতে চান, নাকি নিজেদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে চান। এই প্রক্রিয়াটির পাশাপাশি সুদানি নেতাদের তৎপরতার মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নির্ধারিত হবে—এতকাল ধরে যারা দুর্বিষহ জীবন ভোগ করছে, তারা কি এবার শান্তি-সমৃদ্ধির নাগাল পাবে, নাকি তাদের ঠেলে দেওয়া হবে আরও রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতির মধ্যে। এই বিরাট ঘটনার প্রভাব শুধু সুদানের ওপরই পড়বে না, সাব-সাহারান আফ্রিকা, সেই সঙ্গে গোটা বিশ্বের ওপরই পড়বে।
দীর্ঘদিন ধরে ঘনীভূত হচ্ছে রাজনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের তৎপরতা। এরই সর্বশেষ ঘটনা এই ঐতিহাসিক গণভোট। ২০০৫ সালে যে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সুদানের গৃহযুদ্ধ শেষ হয়, সেই চুক্তির একটি আবশ্যক শর্ত ছিল গণভোট। তা সত্ত্বেও মাত্র কয়েক মাস আগে, নির্ধারিত তারিখের জন্য প্রস্তুতি চলাকালে; গণভোট আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কি না, তার অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। এ কারণেই সেপ্টেম্বর মাসে আমি সুদান এবং বিশ্বের অন্যান্য নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল, এটা জানান দেওয়া যে গণভোট হতেই হবে—এ অবস্থানের ব্যাপারে বিশ্ববাসী ঐক্যবদ্ধ। সেই সঙ্গে সুদানের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে মূল্য দিতে হবে অবশ্যই, তাতে ফলাফল যেমনই হোক না কেন।
সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল উত্তর ও দক্ষিণ সুদানের নেতাদের নির্বাচনবিষয়ক মতৈক্যে পৌঁছানো। এ ক্ষেত্রে তাদের পেছনে থেকে কাজ করেছে ৪০টির বেশি জাতি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। তাদের সিদ্ধান্ত ছিল, ভোট যথাসময় শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত হবে। সুদানের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নিশ্চিত করা হবে। যথাসময়েই গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার এই ঘটনাটি তাই সেসব নেতার প্রতি শ্রদ্ধা, যাঁরা তাঁদের অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন। সম্প্রতি সুদান সরকার বলেছে, গণভোটে যদি স্বাধীনতার পক্ষে মত পড়ে, তবে সুদান সরকারই দক্ষিণের স্বতন্ত্র স্বীকৃতি দেবে।
এখন গোটা বিশ্ব এই সংকল্পের সঙ্গে গণভোট প্রত্যক্ষ করছে যে সুদানের সব পক্ষই আশানুরূপভাবে বিধিনিষেধ মেনে চলবে। ভয়ভীতি বা বল প্রয়োগ থেকে মুক্ত থেকে তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। এ সময় সব পক্ষের উচিত হবে উসকানিমূলক আচরণ থেকে বিরত থাকা, যাতে গোলযোগ সৃষ্টি না হয়।
ভোট চলাকালে কোনো দল যেন নির্বাচনের ফলাফল আগাম ঘোষণা না করে। গণভোট তদারকির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশন বাইরের হস্তক্ষেপ ও চাপমুক্ত থেকে দায়িত্ব পালন করতে পারছে কি না, সেটা নিশ্চিত হওয়া দরকার। অন্যথায়, গণভোটের ফলাফল বিশ্বাসযোগ্য হবে না। এ সময় উত্তর ও দক্ষিণের নেতাদের উচিত হবে একযোগে কাজ করে কয়েকটি ব্যাপার নিশ্চিত করা। যেমন—সহিংসতা ঠেকানো বা বিচ্ছিন্ন ঘটনার ছুতোয় বড় ধরনের অস্থিতিশীলতাকে পল্লবিত হতে না দেওয়া। সেই সঙ্গে চূড়ান্ত ফলাফল পাওয়ার আগেই কোনো পক্ষের বাড়তি সুবিধা আদায় করতে ছদ্মপক্ষকে কাজে লাগানো উচিত হবে না।
গণতন্ত্র ও ন্যায়ের পথে আফ্রিকার সুদীর্ঘ যাত্রায় সফল গণভোট হবে উদ্যাপনের উপলক্ষ এবং একটি উদ্দীপনামূলক ধাপ। কিন্তু সুদানে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি স্থাপন করার কাজটি একটি বিশ্বাসযোগ্য গণভোট অনুষ্ঠানের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।
২০০৫ সালে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আপস-রফা হওয়া জরুরি। সীমান্ত-বিরোধের নিরসন করতে হবে, বিশেষ করে উত্তর-দক্ষিণ দুই দিকে বিস্তৃত আবেয়ি অঞ্চলের পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি করতে হবে। সব সুদানির নিরাপত্তা ও নাগরিকত্ব রক্ষা করতে হবে। বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে সংখ্যালঘুদের বেলায়। যেমন—উত্তরে বসবাসরত দক্ষিণপন্থী এবং দক্ষিণের উত্তরপন্থী। বন্দোবস্ত এমনভাবে করা দরকার, যাতে তেল রাজস্বের স্বচ্ছ বণ্টন হয়। যেসব শরণার্থী ফেরত আসবে, তাদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সামলাতে হবে। নয়তো আবার কোনো মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। দক্ষিণ যদি নিজেদের জন্য স্বাধীনতা বেছে নেয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্ব যে প্রধান লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করবে সেটা হলো, উদ্ভূত এই দুটি জাতি যেন পরস্পরের স্থায়ী এবং অর্থনৈতিকভাবে সংহত প্রতিবেশী হতে পারে। কারণ তাদের নিয়তি পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সবচেয়ে বড় কথা, পশ্চিম সুদানের দারফুর অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে হবে। তা না হলে গোটা সুদানেই শান্তি সংহত রাখা অসম্ভব। শত-সহস্র নিরপরাধ দারফুরিকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের শরণার্থীরা অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সহ্য করেছে। বছর পাঁচেক আগে পার্শ্ববর্তী শাদের একটি ক্যাম্পে গিয়ে আমি শরণার্থীদের যন্ত্রণা দেখেছি। এসব বিষয় কিছুতেই ভুলে যাওয়া চলবে না। এ ব্যাপারেও বিশ্ববাসীর মনোযোগ রয়েছে। সুদানের সরকারকে আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধগুলো মেনে চলতে হবে। সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করা যাবে না। যাদের সহায়তা দরকার, তাদের কাছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী ও ত্রাণকর্মীরা যেন পৌঁছাতে পারেন, সেই পথ খোলা রাখতে হবে।
গত সেপ্টেম্বরেও সুদানের নেতাদের আমি বলেছি, যুক্তরাষ্ট্র দারফুরের জনগণকে পরিত্যাগ করবে না। এখানকার সংকট সমূলে উৎপাটনের জন্য আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আমরা চালিয়ে যাব। অন্যান্য দেশেরও উচিত হবে নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে সব পক্ষকে বৈঠকের ব্যাপারে রাজি করানোর চেষ্টা করা। এটা নিশ্চিত করতে হবে যে নিপাট বিশ্বাসে তারা সমঝোতা করবে। দারফুর স্থিতিশীল শান্তির ব্যাপারে আমাদের জোরালো অবস্থান জারি থাকবে। সেই সঙ্গে গণহত্যাসহ যেসব অপরাধ হয়েছে, সেগুলোর জবাবদিহির ব্যাপারেও আমাদের অবস্থান সুস্পষ্ট।
সুদানি জনগণের প্রাপ্য শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সুদানি নেতাদের কাছে আমার প্রস্তাব, আমি আজ আবার পেশ করতে চাই। আপনারা নিজেদের ওপর নির্ধারিত বিধিনিষেধ মেনে চলুন। শান্তিকে বেছে নিন। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে। আপনারা বিভিন্ন আর্থিক অনুমোদন পাবেন। সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে—এমন রাষ্ট্রগুলোর তালিকায় সুদানের নাম আছে। প্রস্তাবিত পথে হাঁটলে আইনসংগতভাবে সেই তালিকা থেকে সুদানকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হবে। অন্যথায়, যারা আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ অমান্য করবে, তারা আরও ভয়ংকর চাপের মুখোমুখি হবে। আরও বেশি একা হয়ে যেতে হবে।
এই সেই মুহূর্ত, যখন সাহসী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতারা তাঁদের জনগণকে সুদিনের পথে পরিচালিত করতে পারেন। যাঁরা ঠিক সিদ্ধান্তটি নেবেন, ইতিহাস তাঁদের মনে রাখবে। পাশাপাশি তাঁরা হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত মিত্র।

৯ জানুয়ারি সুদানে অনুষ্ঠিত গণভোটের প্রাক্কালে ৮ জানুয়ারি বারাক ওবামার এ লেখাটি প্রকাশিত হয় নিউইয়র্ক টাইমসে

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে ভাষান্তর: তৈমুর রেজা
বারাক ওবামা: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

No comments

Powered by Blogger.