বিশেষ সাক্ষাৎকার-জবাবদিহির জন্য নতুন আইন হোক by খন্দকার মাহবুব হোসেন

অধস্তন আদালতের একটি নিয়োগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি মুখোমুখি অবস্থানে। কমিটি সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রারের কাছে চিঠি লিখে পদায়নের ব্যাপারে তথ্য জানতে চেয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট মনে করেন, এটি সংসদীয় কমিটির এখতিয়ারবহির্ভূত।


এ নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলম ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। দুজনের দুটি সাক্ষাৎকার ছাপা হলো।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো  হাইকোর্ট বিভাগ সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চিঠির বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সে সম্পর্কে সাংবাদিকদের ব্রিফ করা হয়নি। পত্রিকান্তরে বিবিধ বিবরণ এসেছে। তবে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট মনে করেন, সংসদীয় কমিটিতে তাঁরা যেতে পারেন না। আপনি কীভাবে দেখছেন?
খন্দকার মাহবুব হোসেন  আমাদের বিচার বিভাগের জবাবদিহি অবশ্যই থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের যে ভাবমূর্তি আছে, সেটা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে তাহলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সেটা দেখবেন, সেখানেই তার সমাধান হবে। সেখানে কে সার্বভৌম কে সার্বভৌম নয়, সেটা বিতর্কের ব্যাপার। আমরা অত দূর না গিয়েও বলতে পারি, বিচার বিভাগের জবাবদিহি থাকতে হবে। সেটা কোথায় হবে—সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে না পোষালে প্রয়োজনে নতুন আইন করতে হবে।
প্রথম আলো  সংবিধানেই বলা আছে, সুপ্রিম কোর্ট অধস্তন আদালত নিয়ন্ত্রণ করবেন। সরকার প্রস্তাব দিলে তাঁরা অনুমোদন দেবেন। সেভাবে প্রায় ২০০ জ্যেষ্ঠ বিচারককে ডিঙিয়ে ঢাকার জেলা জজ নিয়োগের প্রস্তাবে তাঁরা সায় দেন। এটা কী নীতির ভিত্তিতে হলো, তা-ই জানতে চেয়েছিল সংসদীয় কমিটি। কমিটি কেন শুনতে পারবে না?
খন্দকার মাহবুব হোসেন  আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে প্রশাসনিক বিষয় থেকে দূরে রাখতে হবে। সংসদীয় কমিটিতে রাজনৈতিক ব্যাপার আছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। এখন যদি বিচার বিভাগের জবাবদিহির দরকার হয়, তাহলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে।
প্রথম আলো  কিন্তু এ ধরনের বিষয়ে তো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রযোজ্য হওয়ার নয়।
খন্দকার মাহবুব হোসেন  সুপ্রিম কোর্টকে নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, এটা কিন্তু সঠিক নয়। এখানে দ্বৈত ব্যবস্থা চলছে। বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি সবকিছুই আইন মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করছে।
প্রথম আলো  আপনার কথা অংশত সঠিক। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের আগে এই নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ ছিল। কিন্তু এখন দায়দায়িত্ব উভয়ের। মাসদার হোসেন মামলার রায়মতে, আইন মন্ত্রণালয়ের একক নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রস্তাব বৈধ না মনে করলে সুপ্রিম কোর্ট তাতে ভেটো দেবেন। সংসদীয় কমিটি দেখেছে, ২০০ জনকে ডিঙানোর প্রস্তাব সুপ্রিম কোর্ট অনুমোদন করেছেন। অথচ এর আগে একই প্রস্তাব সুপ্রিম কোর্ট উপেক্ষা করেছেন।
খন্দকার মাহবুব হোসেন  আমি কিন্তু এসব তথ্য জানি না।
প্রথম আলো  অথচ এটাই সত্যি। এর দলিলপত্র আমাদের হাতেও আছে। সংসদীয় কমিটি বুঝতে চেয়েছে, কোন নীতির ভিত্তিতে এটা হলো। এখানে সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক হলো কী করে?
খন্দকার মাহবুব হোসেন  কী কারণে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে ডাকা হলো, তা কিন্তু কমিটি বলেনি।
প্রথম আলো  এই যে আপনি ডাকাডাকি শব্দটি ব্যবহার করলেন। অন্য কেউ তলব শব্দটি ব্যবহার করেন। কিন্তু সেটা তো ঠিক নয়। কমিটির চিঠিতে আলোচনার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
খন্দকার মাহবুব হোসেন  সেটা সুপ্রিম কোর্টকে কেন? আইন মন্ত্রণালয়কে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়। তারাই তো অনুমোদন দিয়েছে।
প্রথম আলো  তাহলে আপনি কি বলতে চান যে, সুপ্রিম কোর্ট থেকে কোনো অবস্থাতেই কোনো ব্যক্তি জাতীয় সংসদের কোনো কমিটিতে যেতে পারবেন না? যদি যান তাহলে সংবিধানের চেতনা পরাভূত হবে?
খন্দকার মাহবুব হোসেন  আমার কথা হলো সুপ্রিম কোর্টের সব ব্যাপারে জবাবদিহির জন্য একটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার।
প্রথম আলো  তাহলে আপনার প্রস্তাব কী?
খন্দকার মাহবুব হোসেন  হাউস অব কমন্সেও কিন্তু জবাবদিহির জন্য কোনো বিচারককে ডাকা হয় না। তবে জবাবদিহি সুপ্রিম কোর্টকে করতে হবে। ইদানীং যা হচ্ছে তা অস্বাভাবিক। আমি কোনোমতেই এটা অনুমোদন করি না। এ জন্য সরকারকে ভিন্ন আইন প্রণয়ন করতে হবে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের আওতা বাড়ানো যেতে পারে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের এতে সম্পৃক্ত করা যায়। তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের বিচারিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবেন। এ ব্যাপারে যথাযথ উপদেশ দেবেন বা কার্যক্রম গ্রহণ করবেন।
প্রথম আলো  হাউস অব কমন্সের কমিটিতে সে দেশের বিচারকেরা অংশ নেন। আলাপ-আলোচনা করেন।
খন্দকার মাহবুব হোসেন  আমিও একমত যে আলাপ-আলোচনায় কোনো সমস্যা নেই।
প্রথম আলো  কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেলের যুক্তি হচ্ছে, ব্রিটেনের সংসদ সার্বভৌম কিন্তু বাংলাদেশের সংসদ সার্বভৌম নয়। তাই সংসদীয় কমিটিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রতিনিধি যেতে পারেন না। আপনি কীভাবে দেখেন?
খন্দকার মাহবুব হোসেন  সুপ্রিম কোর্টের কোনো ব্যতিক্রমী কার্যক্রমের জন্য সংসদীয় কমিটি সুপ্রিম কোর্টকে ডাকতে পারে না। তাঁদেরকে ডাকা উচিত হবে না। তারা সার্বভৌম কি না, সেটা অন্য ব্যাপার। তবে আমি মনে করি, সুপ্রিম কোর্টের কোনো কাজ যদি ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হয়, সে ক্ষেত্রে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল দেখতে পারে। আইন সংশোধন করতে হবে।
প্রথম আলো  কিন্তু সেই সংশোধিত কাউন্সিলেরও জবাবদিহির একটা প্রশ্ন থাকবে। আমরা কেন সর্বান্তঃকরণে সংসদকে পাশ কাটাতে চাইছি, যখন সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্ট সংসদেরই সৃষ্টি?
খন্দকার মাহবুব হোসেন  বর্তমানে আমাদের সংসদের যে অবস্থা, তাদের যে ভাবমূর্তি দেখতে পাচ্ছি, সংসদকে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করে রাখা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমরা ভয় করছি, সুপ্রিম কোর্ট যদি তাঁদের সহায়ক ভূমিকা পালন না করেন, তাহলে তারা কথায় কথায় সুপ্রিম কোর্টকে ডেকে নাজেহাল করবে। সে জন্যই দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়কে সবার ওপরে রাখতে হবে। তাদের জবাবদিহি দরকার হলে সে জন্য নতুন আইন করুন।
প্রথম আলো  আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত স্পষ্ট করেছেন যে, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে তলব করা হয়নি, ডাকা হয়নি, তাঁদের মতামত কামনা করা হয়েছে। অথচ পত্রিকান্তরে তলবটাই তাপ ছড়াচ্ছে বেশি।
খন্দকার মাহবুব হোসেন  এই তলবেই কিন্তু আমাদের আপত্তি।
প্রথম আলো  কিন্তু সংসদীয় কমিটি তো তা করেনি।
খন্দকার মাহবুব হোসেন  কিন্তু কমিটির সভাপতি তলব করেছিলেন।
প্রথম আলো  তাঁরা যে চিঠি দিয়েছেন, সেটা আমরা দেখেছি। তাতে তলবের কথা লেখা নেই।
খন্দকার মাহবুব হোসেন  তাঁকে জিজ্ঞেস করুন, তিনি বলুন যে তাঁরা তলব করেননি। সেটা তিনি পরবর্তীকালে বলেছেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে যখন ডাকা হয়েছিল, তখন কি বলা হয়েছিল আপনাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে চাই?
প্রথম আলো  কমিটির চিঠিতে লেখা হয়েছিল ঢাকার বর্তমান জেলা জজের পদায়নসংক্রান্ত তথ্য প্রয়োজন বিধায় কমিটির সভাপতি আপনার উপস্থিতি কামনা করেছেন। এখন আপনিই বলুন এই কথাকে আলাপ-আলোচনা হিসেবে না গণ্য করে তলব হিসেবে দেখার সুযোগ কতটা?
খন্দকার মাহবুব হোসেন  সেটা ভিন্ন ব্যাপার। যদি কৈফিয়ত তলব করা হয় তাহলে কমিটি সেটা পারে না।
প্রথম আলো  গত ২৪ মার্চ সংসদীয় কমিটি সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বেতন-ভাতাসংক্রান্ত বিল পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ কামনা করে। তখন কিন্তু কারও উপস্থিতি কামনা করা হয়নি। অথচ সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন রেজিস্ট্রার (বর্তমানে বিচারপতি) সংসদীয় কমিটির বৈঠকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপস্থিত হন এবং বক্তব্য দেন। সেটা যদি সংবিধানসম্মত হয়, সার্বভৌমত্ব খর্ব না হয়, তাহলে এখন এ প্রশ্ন উঠল কেন?
খন্দকার মাহবুব হোসেন  যদি কৈফিয়ত চাওয়া না হয়, যদি আলাপ-আলোচনার জন্য ডাকা হয়ে থাকে, বিষয়টি অবগত হওয়ার জন্য ডাকা হয়ে থাকে, তাহলে রেজিস্ট্রারের যাওয়া উচিত ছিল।
প্রথম আলো  প্রথম চিঠি পেয়ে সুপ্রিম কোর্ট জানালেন, কমিটির বৈঠকে উপস্থিত হওয়ার জন্য রেজিস্ট্রার সুপ্রিম কোর্টের অনুমতিপ্রাপ্ত হননি। এরপর দ্বিতীয় চিঠি গেল। রেজিস্ট্রার উপস্থিত হন। কমিটির সভাপতি তাঁকে অভিনন্দন জানান। রেজিস্ট্রার তাঁকে কমিটিতে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ধন্যবাদ জানান এবং কমিটির অভিপ্রায় অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তীকালে তাঁদের মতামত কমিটিকে অবহিত করার আশ্বাস দেন। এরপর গণমাধ্যমে শুধু দায়িত্বশীল সূত্রে খবর বের হয় যে, সুপ্রিম কোর্ট কমিটিতে যাবেন না। কারণ সংসদ সার্বভৌম নয়। মন্তব্য করুন।
খন্দকার মাহবুব হোসেন  আমি মনে করি আলাপ-আলোচনার জন্য ডাকা হয়ে থাকলে তার সুযোগ ছিল এবং সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রারের কমিটিতে আলোচনা করতে কোনো বাধা ছিল না।
প্রথম আলো  সংসদীয় কমিটিতে আলাপ-আলোচনা করলে সার্বভৌমত্ব বলুন আর সংবিধানের চেতনাই বলুন—কোনো কিছুই খর্ব হতো না।
খন্দকার মাহবুব হোসেন  আমি আপনার সঙ্গে একমত। আমরা বাইরে থেকে যেটা মনে করছি, সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্রমের ব্যাপারে সংসদীয় কমিটি সুপ্রিম কোর্টের কাছে কৈফিয়ত তলব করেছে। সেখানেই আমাদের আপত্তি।
প্রথম আলো  আপনি সম্ভবত একমত হবেন যে সুপ্রিম কোর্টের স্বাধীনতার জন্য আমাদের অবশ্যই বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে হবে। মওদুদ আহমেদও এ বিষয়ে একমত।
খন্দকার মাহবুব হোসেন  অধীন আদালতের নিয়ন্ত্রণভার পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত করতে হবে।
প্রথম আলো  আপনি কি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিলোপ করে সংসদের মাধ্যমে অভিশংসন প্রথা ফিরিয়ে আনতেও একমত হবেন?
খন্দকার মাহবুব হোসেন  নিশ্চয়ই। সংসদের মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণে অভিশংসন প্রথা গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ।
খন্দকার মাহবুব হোসেন  ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.