প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠক-সরকারের দুই বছর

২ জানুয়ারি প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘সরকারের দুই বছর’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো: যাঁরা অংশ নিলেন নুরুল ইসলাম নাহিদ
শিক্ষামন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার


মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব, বিএনপি
সুলতানা কামাল
সাবেক উপদেষ্টা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাহী পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র
অধ্যাপক মিজানুর রহমান
চেয়ারম্যান, মানবাধিকার কমিশন
খন্দকার মাহবুব হোসেন
সভাপতি, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি
এ কে আজাদ
সভাপতি, এফবিসিসিআই
দিলারা চৌধুরী
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
সম্মানীয় ফেলো, সিপিডি
ইফতেখারুজ্জামান
নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
আসিফ নজরুল
অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আল মাসুদ হাসানুজ্জামান
অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
মতিউর রহমান: সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা
মতিউর রহমান
২০০৮ সালের নির্বাচনের পরপর ‘সংসদের কাছে প্রত্যাশা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে কয়েকটি গোলটেবিল বৈঠক করেছি সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও কার্যক্রম সম্পর্কে। ৬ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের দুই বছর পূর্ণ হবে। বিগত দিনগুলোতে সরকারের কার্যক্রম নিয়ে পর্যালোচনা ও আগামী দিনগুলোতে সরকারের কাছে আমাদের আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা কী হবে—এসব বিষয় নিয়ে আজকে আলোচনা হবে। পাশাপাশি বিরোধী দলের অবস্থান বা ভূমিকা কী বা কী হওয়া উচিত, সে বিষয়গুলোও আলোচনায় উঠে আসবে। উপস্থিত আলোচকদের আলোচনার মাধ্যমে সরকারের করণীয় কী হওয়া উচিত, সে বিষয়ে মতামত ও পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে এই বৈঠকে। পত্রিকার মাধ্যমে আমরা তা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে পারি এবং এভাবে সরকারকে সহযোগিতা করতে পারি।
আমরা প্রতি এক বছর পরপর একটি জরিপ করি। বর্তমান সরকার বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু গত বছরের তুলনায় সরকারের জনপ্রিয়তা কমে এসেছে। প্রথম বছর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের জনপ্রিয়তা সাধারণভাবেই ৮ থেকে ১০ শতাংশ কমে গিয়েছিল বলে ধারণা পাওয়া গিয়েছিল জরিপে। এবারও একই রকম হবে বলে আমাদের ধারণা।
ডেইলি স্টার ছয় মাস অন্তর অন্তর এ ধরনের জরিপ করে। সেখানে ছয় মাস আগের জরিপের রিপোর্টে দেখা গেছে, সরকারের ভূমিকার মধ্যে কৃষি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনেক বেশি সফলতার প্রমাণ দিয়েছে। অন্যদিকে সরকারের ব্যর্থতার দিক থেকে যদি বলি, তাহলে দেখা যায়, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং বিদ্যুৎ-সমস্যার সমাধান করতে না পারা। যদিও বিদ্যুৎ-সমস্যা খুবই কঠিন অবস্থায় আছে। এককভাবে হয়তো সরকারের পক্ষে দুই বছরের মধ্যে এ সমস্যা সমাধানে বিরাট পরিবর্তন আনা সম্ভব ছিল না। এ বছর সরকার বিদ্যুৎ-সমস্যা সমাধানে অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। এগুলো যদি তারা সফলভাবে শেষ করতে পারে, তবে আগামী বছর এ ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি আমরা দেখতে পাব। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে অগ্রগতি, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শাস্তি কার্যকর করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্র বর্তমান সরকারের সাফল্যের দিক হিসেবে তুলে ধরা যায়।
একইভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছে। বিশেষ করে, ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করা অতি জরুরি ছিল। কারণ, দুটি দেশই আমাদের নিকটবর্তী দেশ।
এ ছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের প্রতি জনগণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন কিংবা সংসদকে কার্যকর করতে সরকারের ভূমিকা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি বিষয় সমালোচিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তারা বন্ধ করবে। কিন্তু এর সংখ্যা কমছে না, বরং বাড়ছে। উপজেলা পরিষদগুলো কার্যকর করতে সরকার আরও উদ্যোগী হবে বলে আমরা আশা করেছিলাম, সেখানে কিছু সমস্যা রয়েছে। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাও একটি বড় ধরনের সমস্যা। যদিও সমস্যাটি প্রথম বছর যে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল, এ বছর তা কিছুটা কমে এসেছে।
অন্যদিকে বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে জনগণের মনে প্রশ্ন রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে সংসদ বর্জন দেশবাসী ও আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। একইভাবে গত ১০-১৫ বছরের জরিপে বা জনমতে কখনো প্রতিফলিত হয়নি যে হরতালকে জনগণ সমর্থন করে। সরকারের অবস্থান ও সংসদ পরিচালনার ক্ষেত্রে বিরোধী দলের মতামত ইত্যাদি বিষয়গুলো আলোচনায় তুলে ধরা হবে। আগামী বছরটি আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী দুই বছর অর্থাৎ, সরকারকে তার তৃতীয় ও চতুর্থ বছরের মধ্যে অনেক জরুরি কাজ সম্পন্ন করতে হবে এবং জনগণের কাছে প্রমাণ করতে হবে, নির্বাচনী ইশতেহারে যে অঙ্গীকারগুলো প্রকাশ করা হয়েছিল, তা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। তার ওপর নির্ভর করবে আগামী নির্বাচনে সরকারের অবস্থান।
এটা আবারও দেখা যাচ্ছে, বিরোধী দল সংসদে যায় না। তারা হরতাল, অবরোধ করে বিভিন্নভাবে দেশের মধ্যে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করে। এত কিছুর পরও অতীতে দেখা গেছে, ঘুরেফিরে মানুষ আবার সেই বিরোধী দলকেই ভোট দেন। এর কারণ কী? সরকারের ব্যর্থতা, নাকি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, পাওনার ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তি থেকে তাঁরা বিরোধী দলকে সমর্থন দেন। জরিপে দেখা যায়, বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা বা সমর্থন কিছুটা বেড়েছে। এসব ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পাশাপাশি গণমাধ্যমেরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। স্বাধীনতার পর গত ৪০ বছরে আমাদের অনেক ক্ষেত্রে সফলতা রয়েছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন হলেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে কিছুটা সংকট রয়ে গেছে। আগামী বছরগুলোতে সবাইকে নিজ অবস্থান থেকে ভালো কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
আলোচনার শুরুতে সামগ্রিক দিক তুলে ধরবেন বর্তমান সরকারের সফল শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

নুরুল ইসলাম নাহিদ
আমি এ কথা বলব না যে আমাদের সরকার শতভাগ সফল হয়েছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমরা সফলতা পেয়েছি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে আমাদের যে সময় এবং যে চলমান বাস্তবতার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল, এই বাস্তবতা ধারণ করেই কিন্তু এগিয়ে যেতে হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা অধিক গুরুত্বসহকারে কাজ করেছি। যেমন, কৃষিক্ষেত্রে সরকার অনেকাংশে সফল। বর্তমান সময়ে বিশ্বে টাকা থাকলেও খাদ্য কিনতে পাওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যে স্বনির্ভরশীল হওয়ার জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ এই কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাঁদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো হয়েছে। সব গ্রামে কৃষকদের তালিকা করা হয়েছে। উপজেলাভিত্তিক তাঁদের সংগঠিত করে কার্ড দেওয়া হয়েছে। এই কার্ড দিয়ে তাঁরা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পেরেছেন। এর মাধ্যমে আমন ও আউশ ধানসহ কৃষির বিভিন্ন মৌসুমে সরকারের আর্থিক ঋণ ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পেরেছেন কৃষকেরা। আমাদের দেশে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে সার না পাওয়া। এমনও হয়েছে, সারের দাবি করায় গাইবান্ধায় গুলি করে কৃষকদের হত্যা করা হয়েছে। আমরা কৃষকের পক্ষে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর খাদ্যের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় বছর কৃষি খাতে ভর্তুকি দিয়ে কম দামে কৃষকের কাছে সার পৌঁছে দিয়েছি। যাঁদের কার্ড দেওয়া হয়েছে, এ বছর তাঁদের বিনা মূল্যে সার ও বীজ দেওয়া হয়েছে। এদিক থেকে বলা যায়, খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি একটি বড় সমস্যা। আমাদের কৃষকদের উৎপাদিত খাদ্যের দাম ভালোভাবে পাওয়ার চাহিদা রয়েছে। আবার যাঁরা খাদ্য কিনে খান, দাম বাড়লে তাঁদের জন্য সমস্যা। এ দুটোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা আরও দরকার। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা এত দিন যা চলে আসছে, তা দিয়ে আমরা যা অর্জন করতে চাই, তা করা সম্ভব নয়। সে জন্য আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনতে চাই। এটাও সত্য, রাতারাতি কোনো পরিবর্তন আমরা আনতে পারব না। আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে যে মৌলিক পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছি, তার ফল আগামী পাঁচ, সাত কিংবা ১০ বছর পর গিয়ে দেখতে পাব। মৌলিক পরিবর্তনের অন্যতম সফল কাজ হচ্ছে নতুন শিক্ষানীতি। নতুন শিক্ষানীতিটি দেশবাসী ও গণমাধ্যমে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। ১৯৬২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এমন কোনো বছর যায়নি, যেখানে শিক্ষানীতি নিয়ে আন্দোলন হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ে সত্যিকার অর্থে কোনো শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা হয়নি। যদি কোনো শিক্ষানীতি জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য না হয়, তবে তা বাস্তবায়ন করা যায় না। শিক্ষানীতি অবশ্যই বাস্তবসম্মত ও জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। সে জন্য শিক্ষানীতিটি খসড়া করে ওয়েবসাইটে দিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে সবাই এর আলোচনা ও সমালোচনা করতে পারে। এক বছর ধরে আলেম-ওলামাসহ সবার সঙ্গে শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা সবার চিন্তাধারা নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমরা প্রধান বিরোধী দলের যাঁরা শিক্ষানীতি নিয়ে কাজ করেন, যেমন-অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ও মনিরুজ্জামান মিঞা, তাঁদের কাছ থেকে লিখিত মতামত নিয়েছি। তাঁরা আমাকে সহযোগিতামূলক পরামর্শ দিয়েছেন। এগুলোর ভিত্তিতে শিক্ষানীতির খুবই মৌলিক কিছু বিষয়ে আমরা পরিবর্তন এনেছি। শিক্ষানীতি প্রকাশের পর গত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ওসমান ফারুক প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন। সবার মন্তব্য, শিক্ষানীতি ভালো হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন করা কঠিন কাজ হবে। আমরা এই কঠিন কাজটি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিচ্ছি। আমরা এ ধরনের চ্যালেঞ্জিং কাজ যদি করতে না পারি, তবে কখনো এগিয়ে যেতে পারব না।
দ্বিতীয়ত, আমাদের নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করতে হলে তাদের বুঝতে দিতে হবে, আমরা কঠিন চ্যালেঞ্জিং কাজগুলো সফল করতে পারি। নতুন প্রজন্মকে আধুনিক, মানসম্মত ও যুগোপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। আমরা যেমন আধুনিক প্রযুক্তির ওপর জোর দিচ্ছি, ঠিক তেমনি নৈতিক মূল্যবোধ, যেমন-সততা, নিষ্ঠা, ন্যায়নীতি, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করাসহ সামাজিক বিষয়গুলো ধরে শিক্ষানীতিকে বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা সময়মতো ছাত্রদের হাতে বই পৌঁছে দিচ্ছি। দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা। টিআইবির রিপোর্ট বের হলে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এটি ভুল না সঠিক, সে প্রশ্নে যাচ্ছি না। কিন্তু যেসব বিষয়ে দুর্নীতি বাড়ছে, সেগুলো অতিমাত্রায় প্রচার করা হয়। আর যেসব খাতে দুর্নীতি কমে, সেগুলো তেমন প্রচারিত হয় না। যেমন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি ৩৯ থেকে কমে ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। টিআইবির এই রিপোর্ট ভুল না শুদ্ধ, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। আমরা দেখতে পাই, যা বললে অন্যকে আক্রমণ করতে পারা যায়, সেগুলো বেশি ব্যবহার করা হয়। কোথাও চোর বাড়লেও, কোথাও যে চোর কমছে, সে বিষয়গুলো গণমাধ্যমে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আমি প্রথমেই বলেছি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছিল দুর্নীতিপ্রবণ মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। আজ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আমি চাই দক্ষ, সৎ, গতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন। সেদিক থেকে আমরা ব্যাপক প্রচেষ্টা নিয়েছি। সে ক্ষেত্রে আমরা সফল হয়েছি। আমাদের সহকর্মীরা নিশ্চয় এতে উৎসাহিত হয়েছেন। এগুলো প্রচারিত হলে তাঁরা আরও বেশি উৎসাহিত হতেন। এ রকম ভালো-মন্দ নিয়ে প্রশাসন সর্বত্র রয়েছে। সামগ্রিকভাবে প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ও সন্তুষ্টি অবশ্যই আছে। তা না হলে দুই বছর ধরে মানুষ আমাদের মেনে নিত না। আমাদের ভালো কাজ করার উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা আছে। আমরা সবার সহযোগিতা চাই।
আর বিরোধী দল সম্পর্কে বলতে চাই, আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সংসদ। আমরা যা-ই করি না কেন, তা নিয়ে সংসদে বিতর্ক, আলোচনা, সমালোচনা অব্যাহত রাখা জরুরি। বিষয়টি বিরোধী দল যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল। বিরোধী দলকে সংসদে আনার জন্য অবশ্যই সরকারি দলের ভূমিকা থাকা দরকার। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখার জন্য সংসদের কোনো বিকল্প নেই। জাতীয় ঐক্য আর বিরোধিতার্থক স্বার্থ—সবকিছু সংসদে এসে আলোচনা করা উচিত। বিরোধী দল আমাদের ভুল-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেবে। আমরা তা শোধরানোর অবশ্যই চেষ্টা করব। আমরা চাই, সরকারি ও বিরোধী দল সংসদে একটি জোরালো ভূমিকা রাখবে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
২০০৮-০৯ সালে আন্তর্জাতিক মন্দাক্লিষ্ট বিশ্বপরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসে। বিশ্ব প্রবৃদ্ধির ধারা কমে আসছিল এবং একই সঙ্গে চাহিদা কমে আসার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমতির দিকে ছিল। সরকার যখন এ ধরনের পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেয়, তখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো ছিল বিনিয়োগ-পরিস্থিতি চাঙা করা, নাজুক বিদ্যুৎ-পরিস্থিতির উন্নয়ন ও আইনশৃঙ্খলা-পরিস্থিতির উন্নয়নসহ বেশ কিছু বিষয়। সামগ্রিকভাবে একটি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের ভেতর দিয়ে একটি জাতীয় অর্থনীতির পুনর্গঠন বা নতুন গতিশীলতা আনার চ্যালেঞ্জ সরকারের সামনে ছিল। সে সময় সরকার যে সুবিধাজনক অবস্থানটি পেয়েছিল, সেটি হলো আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় পণ্যের মূল্য কমে গিয়েছিল। তার ফলে প্রথম বছরে মূল্যস্ফীতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল। সে সময়টি ক্রমান্বয়ে শেষ হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দা কেটে যাচ্ছে, চাহিদা বাড়ছে। ফলে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার প্রতিফলন আমাদের দেশেও দেখা যাচ্ছে।
সরকারের মূল চ্যালেঞ্জটি ছিল আন্তর্জাতিক বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে কীভাবে নতুন প্রবৃদ্ধির ধারা সৃষ্টি করা যায়। এই পরিস্থিতিতে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বিশেষ করে, কৃষির মাধ্যমে এই প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ধারাটি অব্যাহত রাখতে পেরেছে। দ্বিতীয় যে সাফল্য, সেটি ছিল যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা পড়ে যাচ্ছিল, সে ক্ষেত্রে আমাদের পণ্য রপ্তানির ধারাটিকে অব্যাহত রাখা। পণ্য রপ্তানির ধারাটি গত বছরের প্রথম দিকে কিছুটা কমলেও বছরের শেষ দিকে তা কাটিয়ে উঠেছে। সুতরাং, আন্তর্জাতিক বাজারে সরকার পণ্য রপ্তানির ধারা ধরে রাখতে সফল হয়েছে। তৃতীয়ত, পণ্য রপ্তানির পাশাপাশি সেবা রপ্তানির ক্ষেত্রে, রেমিট্যান্সের আয়ের ক্ষেত্রে একই রকমভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ার পরও বাংলাদেশ গত দুই বছরে অন্তত এই রেমিট্যান্সের আয়ের ধারাটি অব্যাহত রাখতে পেরেছিল। যদিও বর্তমানে এটি কমে আসছে। এই দুটি ধারা অব্যাহত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা করা এবং উচ্চমানের আমদানি নিশ্চিত করার জন্য এই বৈদেশিক মুদ্রার আয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতা ছিল। কিন্তু এ সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছি। চতুর্থ যে সাফল্যের কথা বলব, তা হলো কর আদায়-পরিস্থিতি উন্নয়ন। বৈদেশিক সাহায্য কমে আসা, একই সঙ্গে সামগ্রিকভাবে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নিজস্ব সম্পদ আহরণের কোনো বিকল্প ছিল না। সে অর্থে গত দুই বছরে কর আদায়-পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে সাফল্যের সঙ্গে সরকার এগিয়ে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছে। কর আদায়ের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কর যেমন, আয়করসহ বিভিন্ন উৎস থেকে কর আদায়ের ধারা ইতিবাচক ছিল।
বাজার অর্থনীতি যতই ব্যাপকতা লাভ করুক না কেন, গরিব মানুষ সব সময় এর মধ্যে গুরুত্ব পায় না। বিশেষ করে, বিরূপ আন্তর্জাতিক অর্থনীতির কারণে যথোপযুক্তভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে তাদের জন্য একটি নিরাপত্তাবলয়, একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের অপরিহার্য দায়িত্ব হিসেবে এসে দাঁড়ায়। এ সময় আমরা দেখেছি, সরকারের বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি—হতদরিদ্র ও দরিদ্রের জন্য সেটি ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে। পুরো দারিদ্র্য ও মূল্যস্ফীতি-পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য ভিজিডি, ভিজিএফ কার্ড, দুস্থ ও পরিত্যক্ত মহিলা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতার মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা মানবাধিকারের অংশ হিসেবে পড়ে, তা গুরুত্বসহকারে সরকার দেখেছে।
বাংলাদেশের সমস্যার জায়গাগুলোর ব্যাপকতা এত বড় এবং অর্থনৈতিক কাঠামোগত দুর্বলতা এত গভীর যে এসব সাফল্য সত্ত্বেও তেমন সামান্য বিরূপ ধাক্কায় এ ক্ষেত্রগুলো অস্থিতিশীল হয়ে যেতে পারে। সাধারণভাবে বিশ্ব পণ্যমূল্য যদি একটু বাড়তির দিকে থাকে, তখন আমাদের খাদ্য মূল্যস্ফীতি হতে পারে, একই সময় অন্যান্য শিল্প বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এগুলোর প্রতিঘাত আসে বলে মনে হয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে, রেমিট্যান্স আয়ের ধারা যে কমে যাচ্ছে, এর একটি বড় ধরনের প্রতিঘাত আমাদের অর্থনীতিতে পড়বে। এই ভঙ্গুর পরিস্থিতিকে কঠিন করে তুলবে যে বিষয়টি, তা হলো জ্বালানি-পরিস্থিতির সংকট। জ্বালানি-পরিস্থিতি বর্তমানে একটি অমোচনীয় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। গত দুই বছরে যে জায়গাটিতে বড় সাফল্যের প্রয়োজনীয়তা ছিল, সে জায়গাটিতেই বরং সবচেয়ে কম অগ্রগতি আমরা লক্ষ করেছি। গ্যাস সরবরাহ, বিদ্যুৎ-সংযোগ স্থাপন ও ব্যবস্থাপনায় কয়লার সঠিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ কথাটি সত্য। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি-সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সর্বাপেক্ষা গভীর দুষ্টচক্রের মধ্যে নিয়ে গেছে এই মুহূর্তে। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমন্বয়হীনতা, বাস্তবায়নের গাফিলতি এবং অনেক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব দেখা গেছে। ফলে সরকারকে নিজস্ব আইন করে নিজেকে দায়মুক্তি দিতে হয়েছে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের চাঞ্চল্যকে অনেকে বিনিয়োগ-পরিস্থিতির ওপর আস্থার অভিপ্রকাশ হিসেবে দেখতে চান। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে অর্থের যে প্রভূত সঞ্চালন, সেটি বাংলাদেশে বিনিয়োগে বিকাশের অভাবেরই মূল প্রকাশ বলে আমি মনে করি। দেশের ভেতরে বিকল্প অন্য কোথাও বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় এবং সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের যেসব সঞ্চয়পত্র ছিল, সেগুলোর ওপর সুদের হার কমানো এবং সুদের আয়ের ওপর কর আরোপ করার ফলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের বিকল্প আয়ের সীমিত সুযোগ বন্ধ হওয়ায় এটা ঘটছে। এর সঙ্গে রেমিট্যান্স আয় ও অনিয়ন্ত্রিত অর্থ এবং বিশেষ করে, ব্যাংকের টাকা বিকৃতভাবে পুঁজিবাজারে চলে আসছে। পুঁজিবাজার নিয়ে কোনো আত্মপ্রসাদের সুযোগ নেই। বাংলাদেশে পুঁজিবাজারে ছিয়ানব্বইয়ের অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। তখন পাঁচ মাসে সূচক উঠেছিল ২২০ শতাংশের মতো এবং পরবর্তী পাঁচ মাসে তা নেমে গিয়েছিল। লক্ষ করলে দেখবেন, ডিসেম্বর মাস থেকে পুঁজিবাজারে হেঁচকি ওঠা শুরু হয়েছে এবং আস্তে আস্তে তা নামছে। আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে এটিকে ঠেকা দিয়ে ধরে রাখা হয়েছে। সরকারের এই পুঁজিবাজারের ব্যাপারে নীতির সমন্বয় ও জোর নজরদারি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে অতি জরুরি।
ভবিষ্যতে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যকে আধুনিক বিশ্বের কাছে আরও গ্রহণযোগ্যভাবে নিয়ে যেতে চাই এবং আমাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির বিষয়টিকে সর্বদা মনের ভেতর রাখতে চাই। শিল্প-সম্পর্ক আধুনিকায়ন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আধুনিক শিল্প-সম্পর্কের মূল বিষয় হলো, সঠিক মজুরিকাঠামো ও অন্যান্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। যতই এর ভেতর ষড়যন্ত্র খুঁজি না কেন, এ প্রশ্নটি ঘুরেফিরে আমাদের কাছে আসবে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সংঘবদ্ধ শিল্পশ্রমিকেরা যদি দাবি আদায়ে রাস্তায় নামেন, তবে এটি যে শুধু শিল্প-সম্পর্কিত তা নয়, সামগ্রিকভাবে জাতীয় জীবনে অনিশ্চয়তার একটি বড় ধরনের বিপর্যয়কর ইঙ্গিত হিসেবে আসবে। এটি শুধু বাংলাদেশের বিষয় নয়, সম্প্রতি চীন, কম্বোডিয়া ও ভারতে শিল্প-সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিস্ফোরণ ঘটেছে। শ্রমিক-শ্রেণী সচেতন হচ্ছে এবং তা উৎপাদনশীলতার সঙ্গে যুক্ত। আমি মনে করি, আগামী বছরগুলোতে সরকারকে শিল্প-সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে।
রেমিট্যান্স আয়ের ক্ষেত্রে সম্প্রতি নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে। এর পেছনে মূল জায়গাটি বৈদেশিক বাজারে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও কূটনীতিক অসফলতা। আমাদের সবচেয়ে বড় বাজারটি সৌদি আরবে। সেখানে আকামা-সম্পর্কিত যে সমস্যা সমাধানের কথাগুলো বলা হয়েছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি দুঃখজনকভাবে। এখন আমরা বলছি, নেপালের কাছে আমাদের বাজার চলে গেছে। নেপালের রিক্রুটিং এজেন্ট ঢাকায় বসে নেপালি নামে বাংলাদেশিদের তাদের দেশের মাধ্যমে বিদেশ পাঠাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে নতুন সম্পর্কের বিষয়গুলো আসছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির দুর্বলতার সবচেয়ে বড় জায়গাটি হলো উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ দিয়ে তা খরচ করার সক্ষমতা আমরা রাখি না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেখবেন, এর হার গত বছর অনেক চেষ্টা করে প্রথম পাঁচ মাসে ২৩ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিন্তু এটি এ বছর ২০ শতাংশে নেমে গেছে। সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে গুরুত্ব আরোপ করার পরও বাংলাদেশে উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেওয়ার পরও খরচ আমরা করতে পারি না। খুবই আশ্চর্যের বিষয়, সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা মন্ত্রণালয় হচ্ছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। যেসব খাতে বড় অঙ্কের টাকা খরচ করার কথা, সেখানেই কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না।
এখানেই রাজনীতি ও উন্নয়ন-অর্থনীতির আন্তঃসম্পর্কে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশে ব্যাপক ধরনের জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মসূচি পরিচালনা করতে হলে কোনোভাবেই সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবায়ন করা যাবে না। এ ধরনের কর্মসূচির জন্য ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্তি প্রয়োজন। আমার কাছে মনে হচ্ছে, পুরো জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মসূচিটি সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে পরিচালনা করা হচ্ছে। লক্ষণীয়, উন্নয়ন প্রশাসনের ক্ষেত্রে যে ধরনের যোগ্যতা, দক্ষতা, নিষ্ঠা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে কাজ করার কথা, সে জায়গাটিতে আমরা সমস্যা বোধ করছি। যার ফলে উন্নয়ন প্রশাসনের ভেতর অস্থিরতা দেখা যায়। এতে দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে অসুবিধা হয় এবং পেশাদারি মনোভাবের ক্ষেত্রেও সমস্যার সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করার কথা থাকলেও স্থানীয় সরকারের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার বা সাংসদদের পক্ষ থেকে বিরূপ মনোভাব নিয়ে আচরণ করা হচ্ছে বলে জনগণের কাছে প্রতিভাত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারে বসে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হবে আর তা জনগণের পক্ষে যাবে, তা বাস্তবসম্মত নয়। সেহেতু স্থানীয় সরকারকে আয়-ব্যয়ের বৃহত্তর দায়দায়িত্ব দিয়ে উন্নয়নে অংশীদার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু স্থানীয় সরকারকে আমরা সেভাবে সম্পৃক্ত করতে পারিনি। ব্যবসায়িক গোষ্ঠী একটি স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে কাজ করে বিনিয়োগ-পরিস্থিতিতে। কিন্তু এ মুহূর্তে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সরকারের হাতে নেই। আগে যেটুকু ছিল, বেটার বিজনেস ফোরাম, রেগুলেটরি কমিশন, এগুলো ভেঙে দেওয়ার পর বিকল্প কাঠামো কিন্তু দেখিনি চলমান বিষয়ে আলোচনা ও নীতি আলোচনার জন্য। একইভাবে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান যেসব আছে, সেগুলোর সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক আজ ভালো তো কাল খারাপ দেখা যায়। এদের মধ্যে অস্বস্তিকর সম্পর্ক থাকার ফলে উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে সরকারের সম্পূরক শক্তি হিসেবে কাছে রাখার ব্যাপারে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখিনি।
দেশের সামগ্রিকভাবে চিন্তাশীল মানুষ, সুশীল সমাজ, সচেতন নাগরিক গোষ্ঠীর সঙ্গেও সরকারের সম্পর্ক যে খুবই স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ, তাও কিন্তু আমরা বলতে পারি না। এমনকি সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠানের নজরদারি করার কথা, সেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও সরকারের মাঝেমধ্যে অসুবিধাজনক সম্পর্ক দেখা যায়। সংসদের ভেতর ধারাবাহিকভাবে বিরোধী দলের অনুপস্থিতি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে বাধাগ্রস্ত করে। এ ক্ষেত্রে সরকার কিংবা বিরোধী দলের কী দায়িত্ব, তা উপলব্ধি করা উচিত। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যেসব সম্ভাবনা আছে, তা বাস্তবায়ন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়, যদি না একটি পরিপূরক, সহযোগিতামূলক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করে। সহযোগিতামূলক, অবৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সরকারের। সরকার যদি স্থিতিশীলভাবে, শান্তিতে রাজনৈতিক অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারে, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরকার নিজেই। সেহেতু সরকারের আরও বেশি সংবেদনশীলভাবে সবার জন্য একটু জায়গা করে দিয়ে, একটু সহিষ্ণুতার সঙ্গে, একটু বিনয়ের সঙ্গে এখানে আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু সরকারের পাঁচ বছরের জন্য নয়, জাতি হিসেবে আমাদের উন্নয়নের জন্যও একটি সামাজিক ঐক্যবোধ প্রয়োজন। জাতীয় ঐক্যবোধটি ফিরিয়ে আনা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি। আমরা আফ্রিকা মহাদেশে দেখেছি, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা এমন ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, যা দুই-এক বছরের ভেতরে সব অর্থনৈতিক অর্জন ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ মুহূর্তে আফ্রিকার দুটি দেশ—রুয়ান্ডা ও ঘানাকে বড়ভাবে তুলে ধরা হয়। রুয়ান্ডায় একটি বড় ধরনের গণহত্যার পর সেখানে এখন একটি ঐক্যের সরকার এসেছে এবং তারা এগিয়ে যাচ্ছে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। রুয়ান্ডা আফ্রিকার একমাত্র দেশ, যেখানে নারী সাংসদের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি। আর ঘানায় মাত্র শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ ভোটের পার্থক্যে সরকারি দল হেরে গেছে। স্বাচ্ছন্দ্যে সেখানে ক্ষমতার বদল হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে কেনিয়ার মতো একটি সম্ভাবনাময় দেশ নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেনি, হানাহানি-মারামারিতে অনেক লোক মারা গেছে। এই মুহূর্তে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে সরকার চলছে। সেটি কার্যকর হচ্ছে না। আমরা জিম্বাবুয়ের পরিস্থিতি দেখেছি, এখন আইভরি কোস্টের অবস্থাও দেখছি। অর্থাৎ, কেউ যদি মনে করেন, বাংলাদেশ এদের চেয়ে অনেক দূরে, তবে সেটি উচ্চাশা হবে। পুরোটাই ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, একটা বড় ধরনের বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যত্যয়, দেশের ভেতর সামাজিক অস্থিরতা আমাদের অর্থনৈতিক সফলতাকে অনেকাংশে ব্যর্থ করে দিতে পারে। যাঁরা জনগণের জন্য রাজনীতি করেন, তাঁরা একদিনের জন্য রাজনীতি করেন না। আজ যদি কোনো একটি ক্ষতি করেন, তা পরে যখন ক্ষমতায় আসবেন, তখন উত্তরাধিকার সূত্রে সেটি কিন্তু আপনাদের কাছেই এসে বর্তাবে। অর্থনীতিকে কীভাবে আমরা সংরক্ষণ করব এই বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে, আগামী বছরে, বিশেষ করে, সরকার যখন মধ্য মেয়াদ অতিক্রম করবে, সে ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। কারণ, মধ্য মেয়াদ পার হওয়ার পর উত্তেজনা আরও বাড়বে এবং বিরূপ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থাকবে। এর মধ্যে কীভাবে সরকার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নে এগিয়ে যাবে, সে বিষয়ে দুশ্চিন্তা রয়েই যাচ্ছে।

দিলারা চৌধুরী
সব সরকারের জন্যই তৃতীয় বর্ষটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। বর্তমান সরকার সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দুই বছর জনগণ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে ফলাফল দেখার জন্য এবং তৃতীয় বছর থেকে তাদের প্রাপ্তির প্রত্যাশা বাড়তে থাকে সরকারের প্রতি। আমাদের দেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলে আসছে, সেখানে বিরোধী দল সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমকে ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করে। কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকে না, যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকে। স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ধরে রাখতে সব জাতি-গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়। সুতরাং, যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্য, তাদের যাঁরা সমর্থন করেন, তাদের বাইরে রেখে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। সংসদকে কার্যকর করতে আমাদের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কিছুতেই ভূমিকা পালন করতে পারছে না। সংসদকে কার্যকর করতে না পারার দায়ভার শুধু সরকারকেই নিতে হবে তা নয়, এর দায়ভার বিরোধী দলকেও নিতে হবে। আমরা আপামর জনগণও এই দায়ভার বহন করে যাব। বর্তমানে দুটি দলের মধ্যে যে রাজনৈতিক বৈরীভাব ছিল, তা আরও ঘনীভূত হয়েছে। সংসদকে কার্যকর করা যাবে কি না, এটি একটি কঠিন প্রশ্ন। করা যাবে না, এমন কিছু নেই। কথা আছে, যেখানে ইচ্ছা আছে, সেখানে অবশ্যই পথ খোলা আছে। এই ইচ্ছাটি আসতে হবে দুটি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে। কিন্তু সে ইচ্ছাটি আমরা দেখতে পাচ্ছি না দুটি দলের কারও মধ্যে। যদিও দুটি রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল, তারা গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং সংসদকে কার্যকর করবে। কিন্তু কার্যত দুই বছরের মধ্যে দেখা গেছে, যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সেই সমঝোতা, আলোচনা এবং যে নীতি দ্বারা সংসদ পরিচালিত হবে তা স্থির করা। সে-জাতীয় কার্যকলাপ আমরা দেখতে পাইনি। দুটি দলের রাজনৈতিক অঙ্গীকার অত্যন্ত জরুরি সংসদকে কার্যকর করার জন্য। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থের ওপরে গিয়ে দেশের জন্য কাজ করতে হবে—এই উপলব্ধিটা তাদের ভেতর আসতে হবে।
বিরোধী দলের বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের পরও কেন তারা ভোট পান—প্রশ্ন উঠেছে। এর প্রধান কারণ হলো, বাংলাদেশের মতো একটি দেশের কোনো সরকারেরই পক্ষে জনগণের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় কারণটি হলো, মানুষ সব সময়ই একটা পরিবর্তন চায়। জনগণ মনে করে, চালের দাম বেড়েছে, আমরা ভোট দিয়ে ভুল করেছি। এর আগের যে সরকার ছিল, সে-ই ভালো ছিল। এখন কিন্তু বাংলাদেশের লোকের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। তারা যেকোনো দলের পক্ষেই কিন্তু সমান অনীহা প্রকাশ করছে। বিশেষ করে, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে এই অনীহা সুস্পষ্ট। তারা বিএনপির কার্যকলাপেও খুশি নয়, আওয়ামী লীগ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বলে তাতেও খুশি নয়। যদি জনগণ কিংবা নাগরিক সমাজ এই দুটি দলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং ক্রমাগত এই চাপ অব্যাহত রাখতে পারে, দেশের স্বার্থের জন্য দলগুলোকে কাজ করতে হবে, যাতে দুটি দল একটি কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আমরা যে জাতীয় রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছি সেখানে বড় বড় জনস্বার্থ-ইস্যু বাদ দিয়ে ছোট ছোট সংকীর্ণ ও স্বার্থজড়িত ইস্যু নিয়ে দুটি দলের মধ্যে কথাবার্তা ও আচরণ লক্ষ করছি। এটা আমরা গ্রহণ করব না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ২০ বছর কেটে গেছে, আমরা চাইব, এগুলো অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত। যদি দুটি দলের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে, তবে এটি অসম্ভব কিছু নয়। যেখানে মালয়েশিয়ার মতো দেশে জাতিগত ভিন্ন জনগোষ্ঠী—মালয়া, চায়নিজ, ইন্ডিয়ান—থাকে, তারা যদি গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সমঝোতার ভিত্তিতে, সেখানে বাংলাদেশের মতো জাতিগোষ্ঠী-নিরপেক্ষ দেশে কেন সম্ভব নয়? আমি মনে করি, এই রাজনৈতিক বিভেদ শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর সংকীর্ণ স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এখানে সমঝোতা করা এত কঠিন নয়। যেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থাকে এবং তাদের ভেতর মতবিরোধ থাকে, সেখানে কঠিন হয়ে পড়ে সমঝোতা। সেখানেও কিন্তু লোকেরা সমঝোতা করে। এটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের ব্যাপার। আমি মনে করি, ২০ বছরে আমরা গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে এসেছি। যেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের উন্মেষ আমরা দেখতে পাব। গণতন্ত্রের জন্য সুশীল সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তারা জনগণ ও সরকারের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। কিন্তু সুশীল সমাজেও দলীয়করণ ঘটেছে। এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। এটি আমাদের সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার ক্ষেত্রে বিরাট বাধা। সুশীল সমাজ যদি দলীয়করণের বাইরে এসে যে যার অবস্থান থেকে কাজ করতে পারে এবং সম্মিলিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে সরকার ও বিরোধী দলকে তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন করতে ও পরামর্শ দিতে পারে, অর্থনৈতিক উন্নতি যদি ধরে রাখা যায়, তার প্রভাব জনগণ ও রাজনীতিতে পড়ে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সরকারি ও বিরোধী দল উভয় পক্ষকে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে সদিচ্ছা সবচেয়ে বড়। তবে সেই সদিচ্ছা হতে হবে কাযর্কর। কারণ, মুখে সবাই বলছে তাদের সদিচ্ছা আছে, কিন্তু বাস্তবে তারা তা করছে না। এমনকি লিখিতভাবেও অনেকে বলছে, সুশীল সমাজের মধ্যে রাজনীতিকীকরণের বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। সর্বত্র যদি রাজনৈতিক দলের ঊর্ধ্বে থেকে জাতীয় কল্যাণের স্বার্থে সবাই একসঙ্গে কাজ করি, তবেই প্রকৃত পরিবর্তন আনা সম্ভব। আলোচনার এ পর্যায়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানকে বলার জন্য অনুরোধ করব।

ইফতেখারুজ্জামান
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছরের মধ্যে আমাদের অনেক সফলতা রয়েছে। এই ৪০ বছরে আমরা গণতন্ত্রের পথে যেভাবে এগিয়েছি, পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কম দেশই আছে যারা এত দ্রুত অগ্রসর হয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। সুশাসন গণতন্ত্রের সঙ্গে দুর্নীতির বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের অর্জন অনেক, তবে প্রত্যাশার তুলনায় অর্জনে অনেকটা পিছিয়ে আছি। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রাতারাতি পরিবর্তনের জন্য কোনো ম্যাজিক ফর্মুলা আমার জানা নেই। তবে একটি বাস্তবিক ম্যাজিক ফর্মুলার কথা বলতে পারি।
আমাদের দেশে যে দুটি বড় রাজনৈতিক দল আছে তাদের নির্বাচনী ইতিহাসের দিকে অন্তত মাসে একবার তাকান এবং পর্যালোচনা করেন, তবেই গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এখান থেকে গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যদি দলগুলো নিজেরা আত্মসমালোচনা করতে পারে, তারা জনগণের কাছে কী নির্বাচনী অঙ্গীকার করেছিল এবং তা পূরণে কী পদক্ষেপ নিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আমরা গবেষণা ও প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিভিন্ন রিপোর্ট পেশ করি। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি যে প্রতিবেদন বেশ ঝড় সৃষ্টি করেছে, সেটা বাস্তবে মানুষের ধারণা কিংবা জনমত ভিত্তি করে নয়, সেটা ছিল সাধারণ মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা। সম্পূর্ণ একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর নির্ভর করে জরিপটি করেছিলাম। যেখানে মানুষকে থানা পর্যায়ে গিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘আপনি এ খাতগুলোতে কী সেবা নিয়েছেন?’ যখন তিনি বলেছেন, তিনি এ খাতগুলোতে যাননি, তখন আর তাঁকে পরবর্তী প্রশ্ন করা হয়নি। কিন্তু যখন তিনি বলেছেন, ‘হ্যাঁ, আমি বিচার বিভাগে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা নিতে গিয়েছিলাম’, তখন তাঁকে পরবর্তী প্রশ্নগুলো করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জরিপের প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছিল।
শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো খাতে বিশেষ করে, শিক্ষা খাতে অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে ইতিবাচক সংবাদগুলো চাপা পড়ে যায়। দুর্নীতির সার্বিক যে চিত্র তা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক। ২০০৭ সালে দেশের ৬৬ শতাংশ মানুষ কোনো না-কোনোভাবে দুর্নীতি-প্রতারণার শিকার হয়েছিল বা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু ২০১০ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৮৪ শতাংশে। সার্বিকভাবে সেবামূলক খাতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির পরিমাণ বেড়েছে। কয়েকটি যে মৌলিক ক্ষেত্র দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহায়ক হতে পারত, সেখানে কিন্তু ঘাটতি দেখা গেছে। যেমন বিচারব্যবস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন—এসবের সার্বিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি বৃদ্ধির দরকার ছিল, সেখানে ঘাটতি রয়ে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর যে অঙ্গীকার ছিল, দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে সেখানে অনেকটাই ঘাটতি রয়ে গেছে। আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হলে প্রথমে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সে সদিচ্ছা কাগজে-কলমে, নির্বাচনী অঙ্গীকারে সব রাজনৈতিক দলগুলো সব সময়ই বলে আসছে। কিন্তু সেগুলো কতটুকু বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে, সেটি দেখার বিষয়। অনেক মৌলিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জাতীয় সংসদ, গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তার কার্যকর ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সংসদের যে ভূমিকা হওয়া দরকার ছিল, তাতে ঘাটতি দেখা যায়। যদিও সরকারের এ ব্যাপারে শুরুটা ভালো হয়েছিল। কিন্তু পরে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সংসদীয় কমিটিগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম অধিবেশনেই সব গঠিত হয়। প্রথম দিকে কমিটিগুলো কার্যকর থাকলেও ধীরে ধীরে তার কার্যকারিতা কমে এসেছে। কমিটিগুলোতে বিশেষ করে, স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। যেখানে জবাবদিহি ও দুর্নীতি নিয়ে কাজ হবে, সেখানে যদি নিজের স্বার্থ দেখা হয়, তাহলে সে কমিটি সঠিকভাবে কাজ করে না। এ ছাড়া অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের কমিশন না থাকলেও সেখানে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছি না। দুটি দলেরই নির্বাচনী অঙ্গীকারে দুদককে শক্তিশালী ও কার্যকর করার কথা থাকলেও বাস্তবে তার ভিন্ন চিত্র আমরা দেখতে পাই। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে দুদক আইনের সংশোধনী আনতে উদ্যোগ নেয়। আমরা জনমত গঠনের মাধ্যমে সরকারকে সংশোধনী গ্রহণের কথা বলি। সেই উদ্যোগ এখন থেমে গেছে। সংশোধনীর বিষয়টি সরকার পর্যালোচনা করছে। কিন্তু কমিশনটি একটি অস্থিতিশীল পরিবেশের মধ্যে আছে যে এই আইনগুলো হবে কি না। সংশোধনী গৃহীত হবে কি না, সে বিষয়ে পরিষ্কার চিত্র দেখছি না। এই প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের একটি প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এ ছাড়া অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক কমিশনেরও তাদের যথাযথ সামর্থ্য, পেশাগত উৎকর্ষ নিয়ে কাজ করার যে পরিবেশ তা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে সরকার কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
দুর্নীতি যে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তা প্রতিষ্ঠা করার বাস্তব পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। কিছু কিছু মামলার ক্ষেত্রে দেখেছি, যেগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। অপরাধ করলে যে তার জন্য শাস্তি দিতে হবে, সে ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি।
কিছুদিন আগে আমরা জাতীয় থানা জরিপ ও ‘গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার’ নামে প্রতিবেদন করেছিলাম। সেখানে একটি সুসংবাদ ছিল। সুসংবাদটি হলো বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করে, দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সরকার, যেটি সারা বিশ্বে ছিল ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ, বাংলাদেশের মানুষ সরকারের ওপর এ আস্থাটি রাখছে। পাশাপাশি আরেকটি দিক ছিল, বিশ্বের ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করে, দুর্নীতি প্রতিরোধে জনগণের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মনে করে, দুর্নীতি প্রতিরোধে তাদের ভূমিকা রয়েছে। আর ৯৫ শতাংশ মানুষ মনে করে, তারা যদি সুযোগ পায়, তবে তারা দুর্নীতি রুখে দাঁড়াবে। সুশীল সমাজ সরকারের বাইরে থেকে সরকারের ভালো চায়। কিন্তু সরকারের রাজনৈতিক অবস্থানে সুশীল সমাজের অবস্থানটি সংকীর্ণ হয়ে আসছে। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে রাজনীতির পাশাপাশি অর্থের প্রভাব বাড়ছে। রাজনীতিতে অর্থকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। অর্থ বিনিয়োগ করে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আমাদের সাংসদদের মূল পেশা দেখলে দেখা যাবে, অধিকাংশই ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে আসবেন, সে ব্যাপারে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু যেখানে রাজনীতিটি ব্যবসায়িক পেশায় রূপান্তরিত হয়, সেখানেই মূল সমস্যা। রাজনৈতিক অঙ্গনে খারাপ রাজনীতির প্রভাবে ভালো রাজনীতি দূরে সরে যাচ্ছে। আমাদের দেশে দুটি দলের মধ্যে বৈরিতা এত বেশি যে সেখানে রাজনৈতিক ইস্যুর চেয়ে ব্যক্তিগত ইস্যুগুলো বেশি প্রাধান্য পায়। আমাদের রাজনীতি হয়ে গেছে জেতার রাজনীতি বা না হারার রাজনীতি। আমাদের সব সময় জিততেই হবে—সেটি নির্বাচনেই হোক, নির্বাচনের ঊর্ধ্বেই হোক। যখন আমরা জিতে যাই, তখন জনগণের কাছে দেওয়া অঙ্গীকার ভুলে যাই। আর হারার ফলে সংসদ বর্জন, হরতাল-অবরোধসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এ দুটির প্রভাবে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে।
বর্তমান সরকার যে নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো করেছিল, দুর্নীতি প্রতিরোধে তা প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। তবে অনেক কাজ হয়েছে। যেমন, তথ্য অধিকার আইন ও তথ্য কমিশন হয়েছে, মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কারণে প্রত্যাশিত অর্জনটি দেখতে পাইনি।
সুশীল সমাজের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর পার্থক্য বাড়ার ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনকে ক্রমান্বয়ে দুর্বল করা হচ্ছে। সত্যকে মেনে না নেওয়ার মনোভাব দেখা যাচ্ছে। সুশীল সমাজের সমালোচনা হচ্ছে এবং তাদের দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সুশীল সমাজেও রাজনীতি প্রভাব বিস্তার করেছে। সুশীল সমাজের সঙ্গে সরকারের সব সময়ই ‘লাভ অ্যান্ড হেইট’ (নরম-গরম) সম্পর্ক থাকে। সুশীল সমাজে যারা কাজ করেন, তাঁরা এসব জেনেশুনেই করে যান। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও টিআইবি সরকারের সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করছে। টিআইবির উদ্যোগের কারণেই বর্তমান সরকার তথ্য অধিকার আইন ও কমিশন করেছে। বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজ করেই ‘হুইসেল ব্লোয়ার অ্যাক্ট’ নামে আইন হচ্ছে, যেটি আগামী অধিবেশনে সংসদে গৃহীত হবে। এটি হচ্ছে সরকারের সঙ্গে ‘লাভের’ একটি। পাশাপাশি ‘হেইটের’ চিত্র হবে, আমরা যখন সরকারের সমালোচনা করব, তা মেনে নেওয়ার মতো সৎ সাহস থাকবে না। আমাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হবে। আমি কোনো চোর-ডাকাত নই, কাউকে খুনও করিনি। কিন্তু আমাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য এক ঘণ্টার মধ্যে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়। আবার ১২ ঘণ্টার মধ্যে তা বাতিল করা হয়। দুটিই অস্বাভাবিক। ফলে প্রকারান্তরে আমাদের প্রতিবেদনে মানুষ যা বলেছে, তা কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি যদি সাধারণ মানুষ হিসেবে সত্যিকার অর্থে বিচারপ্রার্থী হই, আমার অধিকার যদি কেউ হরণ করে থাকে, বিচারব্যবস্থার কাছে গেলে ওই রকম যদি ত্বরিত গতিতে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়, যে আমার অধিকার হরণ করেছে তার বিরুদ্ধে, তাহলে আমাদের বিচারব্যবস্থা সুষ্ঠু হবে। সার্বিকভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা, প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করা, সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে সবার জন্য দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা এবং জনগণকে বিশ্বাস করানোর মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কারণ, ৯৫ শতাংশ লোক সুযোগ পেলে দুর্নীতি প্রতিরোধে রুখে দাঁড়াতে চায়। সরকারকে সৎ সাহস নিয়ে কাজ করে যেতে হবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য।

আব্দুল কাইয়ুম
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার, সুশীল সমাজ, জনগণ—সব দিক থেকে একটি প্রতিরোধের ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার যে সম্ভাবনা আমাদের রয়েছে, তাকে কাজে লাগাতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে অনুরোধ করব বলার জন্য।

আসিফ নজরুল
গত বছর অনেক সফলতা আমাদের এসেছে। কিছু ক্ষেত্রে সরকারের তেমন ভূমিকা ছিল না। যেমন, প্রথম বাঙালি হিসেবে মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয়, সাকিব আল হাসান বিশ্বে ১ নম্বর অলরাউন্ডার, পাটের জিন আবিষ্কার। এই অর্জনগুলো সাধারণভাবে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের। সরকার কিছু কিছু ভালো কাজ করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শিক্ষানীতিটি। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে বহির্বিশ্বে জঙ্গি উত্থানের যে নেতিবাচক মনোভাব ছিল, তা অনেকাংশে সরকার কাটাতে পেরেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রসর হয়েছে। এগুলো হচ্ছে সরকারের ভালো দিক। আমি মনে করি, সরকারের দুই বছর নিয়ে যখন আলোচনা করব, তখন সরকারের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতা নিয়েই বেশি আলোচনা করা উচিত। কারণ, সফলতা কী সরকার সেটি খুব ভালোভাবে জানে, কিন্তু ব্যর্থতা কী তা সরকার দেখতে বা জানতে চায় না।
সরকারের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ও ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করতে চাই। যেকোনো গণতন্ত্রের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কিছু প্রতিষ্ঠান থাকে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ কীভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করছে, কীভাবে দেশ চালাচ্ছে এবং তাদের যদি কোনো ভুল হয়, তাদের জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসা। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সংসদ। আমরা প্রায়ই বলি, সংসদে বিরোধী দল থাকে না। আমার ধারণা, সংসদে সরকারি দলও থাকে না। শুধু সাংসদদের শারীরিক উপস্থিতির কথা বলছি না। আমাদের যাঁরা সাংসদ আছেন, তাঁদের একমাত্র কাজ সরকারের প্রশংসা করা বা সরকারের স্তুতি করা নয়, তাঁরাও অনেক প্রশ্ন তুলতে পারতেন। সংসদে থেকে তাঁরা বিরোধী দলের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সংসদকে কার্যকর করতে পারতেন। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি যারা দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মামলা নির্বিচারে প্রত্যাহার করছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এসব সম্পর্কে মন্ত্রীদের প্রশ্নে জর্জরিত করার মাধ্যমে তাঁরা সংসদকে জনগণের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় ও জবাবদিহিমূলক করতে পারতেন। সেটি করতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। সংসদের মর্যাদা যেভাবে হানি হয়েছে, তার প্রধান কারণ হচ্ছে নিম্নরুচির ভাষার প্রয়োগ। আমরা যে সংসদের অধিবেশনের খোঁজ রাখব, সেটি কোনো রুচিবান মানুষের শোনার ইচ্ছা হবে না—কোনো কোনো সাংসদ যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তাঁদের সন্তানদের তা শোনাতে চাইবেন না। এটি সংসদের একটি বেদনাদায়ক চিত্র।
সংসদ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি অবমূল্যায়িত হয়েছে আদালতের কারণে। আজ সপ্তম ও পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় হয়েছে। রায়টি গবেষণাধর্মী হয়েছে। রায়ে সংবিধানের কোন ধারাটি বাতিল হয়েছে, কোনটি ফিরে এসেছে—সবকিছু বিবেচনা করার জন্য লেজিসলেটিভ মাইন্ডের প্রয়োজন হয়। আর কাজটি করছেন আইন মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা। আইন প্রণয়ন ও সংবিধান সংশোধনীর দায়িত্ব কি আমরা ডেপুটি সেক্রেটারি পর্যায়ে দিয়ে দিলাম? আর প্রধান বিচারপতি বললেন, সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করা প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে সংবিধান সংশোধনী-সম্পর্কিত কমিটি সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিল। আমি মনে করি, সংবিধানের বিষয়ে আদালতের চেয়ে অনেক বড় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সংসদ। সংবিধানের বিষয়ে আদালতের রায়ের পরবর্তী সময়ে সংসদ যে আচরণ দেখিয়েছে, তাতে সংসদের মর্যাদাহানি হয়েছে। সংসদের কমিটিগুলো প্রথম দিকে কার্যকর ভূমিকা পালনের চেষ্টা করলেও পরে সংসদীয় কমিটি-সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়গুলোকে খুব বেশি গঠনমূলক পরামর্শ বা সমালোচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সামগ্রিকভাবে সংসদ সরকারের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। বিচার বিভাগের অনেক অর্জন ছিল। সংবিধান সংশোধনের চমৎকার দুটি রায় দিয়েছিল, সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করেছিল, বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব অর্জনের পরও বিচার বিভাগ নির্বাচিত কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ছিল না। মাহমুদুর রহমান যে কথা বলার জন্য বাংলাদেশে নজিরবিহীন শাস্তি পেয়েছেন, বাংলাদেশে একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে আপিল ও রিভিউ করার সব সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, সেই একই ধরনের কথা আরেকজন স্বনামধন্য ব্যারিস্টার বলেছেন, তার চেয়ে অনেক বাজে বাজে কথা বলছেন। তিনি নাম ধরে ধরে বলেছেন, কোন আমলে কী ধরনের বিচার পাওয়া যায়। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো আদালত অবমাননার মামলা কেন হয়নি? মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান তাঁর নিজস্ব উপলব্ধি থেকে বলেছেন, ‘গরিব লোক বিচার পায় না।’ পত্রপত্রিকায় দেখেছি, আমাদের প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘কারা তোলা নেন, কারা বদলির সময় টেলিভিশন, ফ্রিজ চান, সেটি আমার জানা আছে।’ কেন এঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা হলো না। আমি মনে করি, প্রত্যেকে তাঁর জায়গা থেকে যা উপলব্ধি করেছেন, তা সৎ ও সততার সঙ্গে উপস্থাপন করছেন। যখন এ ধরনের কাজ হয়, তখন বোঝা যায় বিচারব্যবস্থা কিছু নির্বাচিত ব্যক্তির জন্য দৃশ্যমান ছিল। আমাদের বিচার বিভাগে বিতর্কিত নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমরা বিচার বিভাগ পৃথক্করণে যে চেতনা দেখি, সেখানে এ ধরনের নিয়োগ প্রাথমিক পর্যায়ে হওয়ার সুযোগ থাকে কীভাবে। বিচারপতিরা যেন তাঁদের সম্পর্কের বিবরণ দেওয়ার মাধ্যমে উদাহরণ সৃষ্টি করেন। প্রধান বিচারপতি তাঁর সম্পত্তির হিসাব রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়ার মাধ্যমে অসাধারণ উদাহরণ দেখিয়েছেন। আমরা মনে করি, বিচারকদের নিয়ে যে প্রশ্নে উদ্বেগ সৃষ্টি হচ্ছে, সেখানে নিয়োগের সময় ও চাকরি করার সময় যদি বিচারকেরা তাঁদের সম্পত্তির হিসাব দেন, তাহলে অনেকটা স্বচ্ছতা পাওয়া সম্ভব। শুধু বিচারকেরাই নয়, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ও পেশাজীবীরা এই হিসাব দেওয়ার চর্চা শুরু করতে পারি। তাহলে নির্বাহী বিভাগে কতটুকু ঠিকভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ করা হচ্ছে, তার জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
বিভিন্ন জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান গঠন করেছি। কিন্তু কার্যত তাঁদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ফল পাচ্ছি না। শুধু প্রতিষ্ঠান গড়ে যদি তাকে কার্যত শক্তিশালী ও ক্ষমতায়িত না করা হয়, তবে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
গত ১ বছরে আমাদের বিচারবহির্ভূত অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। প্রতি তিন দিনে একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে প্রতি চার দিনে এক দিন। বিভিন্ন মানুষ গুম হয়ে গেছে। লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকায় সবচেয়ে বর্বর যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটত, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লাশ গুম করে ফেলা। এটি যদি বাংলাদেশে শুরু হয়, তবে তা উদ্বেগের বিষয়। এরই মধ্যে এ রকম দু-তিনটি বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ উঠেছে। সাবেক একজন উপমন্ত্রীকে ৬৩ দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। লুৎফুজ্জামান বাবরের কথাই ধরুন, অপরাধ করলে তাঁকে শাস্তি দেন, কিন্তু ৬৩ দিন রিমান্ডে নেওয়া কী ভালো লক্ষণ? বর্তমান আমলে যাঁরা মন্ত্রী আছেন, তাঁরা কি ৬৩ দিনের রিমান্ডে যেতে প্রস্তুত আছেন, তা ন্যায়ভাবেই হোক আর অন্যায়ভাবেই হোক। বিরোধী দলে গেলে আন্তমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত একটি কমিটি আছে, যেখানে নির্বিচারে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হচ্ছে। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারছি না। সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমি বলব, বিরোধী দলেরও সীমাহীন ব্যর্থতা রয়েছে। বিরোধী দলের মুখে হিংস্রতার ভাষা শুনি, আমরা এই কাজ বন্ধ করে দেব। কাউকে ছাড়ব না। এটি কি বিরোধী দলের কাজ। আপনারা কেন বলেন না সরকার আজকে বিরোধী দলের সঙ্গে যে আচরণ করছে, ক্ষমতায় গেলে বিকল্প হিসেবে আপনারা কী করবেন। জ্বালানিসংকট নিরসনে আপনারা কী করবেন আগামী দিনগুলোতে। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকারের ব্যর্থতার জন্য আপনারা কী উদ্যোগ নেবেন, সেগুলো কেন বলছেন না। এ ধরনের কথা বললে সেগুলোই সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহির প্রশ্ন উঠবে। জনগণ সরকারকে চাপ প্রয়োগ করবে, বিরোধী দল তো ভালো উদ্যোগের কথা বলছে, সরকার কেন সেগুলো পূরণ করছে না? বিরোধী দলের হুমকি ও হিংস্রতার ভাষা জনগণ পছন্দ করে না। সুস্থভাবে সরকারে জবাবদিহি আদায়ে বিরোধী দলকে উদ্যোগী হতে হবে।
সরকারের মনে রাখা উচিত, বিরোধী দল বা মতকে দমন, নিপীড়নের মাধ্যমে পুনর্নির্বাচিত হওয়া যায় না। পুনর্নির্বাচিত হওয়া যায় শুধু সুশাসন দিয়ে। কেউ কেউ বলেছেন, বাংলাদেশে সিঙ্গাপুর মডেলের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠান করবেন। কিন্তু আগেও এটি করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন নেতারা। আমি আশা করব, আগামী তিন বছর বরং আগের সরকারের চেয়ে বেটার গভর্ন্যান্স দিয়ে মানুষের মন জয় করে পরের নির্বাচনে জেতার চেষ্টা করবেন।

মিজানুর রহমান
বর্তমান সরকার আমাদের যে স্বপ্ন দেখিয়ে আকর্ষিত করেছিল, তা হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। সে স্বপ্নের বাস্তবায়নের ধাপ হিসেবে সব ইউনিয়ন পরিষদকে (ইউপি) ইন্টারনেটের আওতায় আনা হয়েছে। গ্রামের যেকোনো নাগরিক ইউপি কার্যালয়ে গিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। ইউএনডিপির সহযোগিতায় এই বিশাল কাজটি কেন তেমন প্রচার পেল না, ভাবতে আমার অবাক লাগে। নতুন একটি আইনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছে নতুনভাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের আইনের চেয়ে বর্তমান মানবাধিকার কমিশনের আইনে মানবাধিকার কমিশনকে আরও বেশি ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। তবে আইন অনুযায়ী কাজ করার জন্য যে লোকবল দরকার, তা তুলনায় কম। প্রথমত বিদেশি বিশেষজ্ঞের হিসাব অনুযায়ী ১২৮ জন, সেখান থেকে বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী নিজেই তা ৮৬-তে কমিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, তারপর অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে তা ২৮ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে। গত বছরের শেষে এসে আমরা ২৮ জনের জনবলের একটি চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছি। উল্লেখ্য ২৮ জন জনবলের অনুমোদন প্রধানমন্ত্রী দেওয়ার পরও দুই মাস ধরে সে ফাইলটি আটকা ছিল মন্ত্রণালয়ে। এখনো বলা হচ্ছে, এই ২৮ জনকে নিয়োগ দিতে হলে আরও কিছু পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। আমলাতান্ত্রিক যে জটিলতা, তা যদি কাটানো সম্ভব না হয়, তাহলে সরকারের যেসব ভালো ভালো সংকল্প ও অঙ্গীকার আছে, তা বাস্তব করা আদৌ সম্ভব হবে কি না, সে ব্যাপারে একটি বিরাট প্রশ্ন থেকে যায়।
প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান ও ব্যাখ্যা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এগুলো হয়তো সরকারের কোনো কোনো মহলে সমাদৃত নাও হতে পারে, তবে এখন পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে কোনো অনুরোধ, টেলিফোন বা এ ধরনের কথা বলা যাবে না। সেটি হয়েছে প্রথমবারের মতো ২৯ ডিসেম্বর। আইন অনুসারে যেকোনো জেলখানা, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সবকিছু পরিদর্শন করে তার ওপর বিবেচনা করে সরকারের কাছে একটি সুপারিশ পেশ করার এখতিয়ার রয়েছে মানবাধিকার কমিশনের। সেই আইন অনুসারেই আমি খাগড়াছড়ি জেলখানা পরিদর্শন করি। ঘটনাচক্রে খাগড়াছড়ি জেলখানায় বন্দীদের অধিকাংশ হচ্ছেন বিডিআর জওয়ান, যাঁদের বিচার প্রক্রিয়াধীন। তাঁদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয়। তাঁরা অনেক অভিযোগ মানবাধিকার কমিশনের কাছে তুলে ধরেন। আমি তাঁদের স্পষ্ট বলি, বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে জেল কর্তৃপক্ষের করার কিছু নেই। জেলের ভেতরে আপনাদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হচ্ছে, সে সম্পর্কে অভিযোগ থাকলে তা বলতে পারেন। কিন্তু তাঁদের জেল কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে তেমন কোনো অভিযোগ নেই। তাঁরা সন্দেহ পোষণ করেছেন, ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে তাঁদের মধ্যে বদ্ধ ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। আমি সাংবাদিকদের বলেছিলাম, এভাবে সবাই যদি এ ধারণা পোষণ করেন, তাঁরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তবে তা ভবিষ্যতের জন্য ভালো নয়। বিচার প্রক্রিয়াটি এমনভাবে হওয়া উচিত, যাতে সেটি কারও মনে কোনো সন্দেহের সৃষ্টি না করে। বিডিআরের আইন অনুসারে বিচার হচ্ছে। সেখানে স্বাভাবিক আইনের ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা রয়েছে। সে সম্পর্কে যদি প্রত্যেকের স্বচ্ছ ধারণা না থাকে, তাহলে তাঁরাও কিন্তু ভুলের ভেতর থেকে মনে করতে পারেন, তাঁরা ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না। এ কথাটি যেহেতু আমি বলেছি, তার পরের দিন আমি রাঙামাটি জেলখানা পরিদর্শন করতে যাই, তখন আমাকে বসিয়ে রেখে এমনভাবে অভিনয় করা হলো, যেন ঢাকাতে আইজি প্রিজনকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি ফোন ধরবেন না। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছেন, আমাকে কৌশলে এতটা সময় বসিয়ে রাখা হয়, যেন আমি অসহ্য হয়ে সেখান থেকে চলে আসি পরিদর্শন না করে। আমি সেটি করতে বাধ্য হয়েছি। এটি হয়েছে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন, যিনি কিনা সামরিক বাহিনী থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত। কিছু কিছু জায়গায় যদি পরিবর্তন না আনা হয়, বেসামরিক প্রশাসনকে সেখানে বসানো না হয়, যাঁরা প্রগতিশীল চিন্তা করেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা ভাবেন, তাঁদের বসানো না হয়, তাহলে পরিবর্তন আসবে না। এঁদের থেকে মুক্ত হতে হবে। ন্যায়বিচার চাওয়া ও প্রত্যাশা করা প্রত্যেকটি নাগরিকের অধিকার এবং সে কথা বলার অধিকারও প্রত্যেকটি নাগরিকের রয়েছে। সে কথা যদি বলতে দেওয়া না হয়, তবে সে ধরনের কোনো মামলার গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না।
বছরের শেষ প্রান্তে এসে ‘চিলড্রেন অ্যাক্ট-২০১০’ আইনটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছে। এখন থেকে বাংলাদেশে ১৮ বছর পর্যন্ত প্রত্যেকটি ছেলেমেয়ে শিশু হিসেবে অভিহিত হবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে। সেটি আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনে আমাদের এখানে রূপান্তরিত হচ্ছে। এটি কিন্তু একটি বড় দায়িত্ব, যা রাষ্ট্র নিজেই নিয়ে নিচ্ছে। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব ছেলেমেয়ে শিশু হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। বিশ্বাস করতে চাই, রাষ্ট্র বুঝেশুনে এই বিরাট দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। যদি সৎ উদ্দেশ্যে এই উদ্যোগ সরকার নিয়ে থাকে, তবে শিশু অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বিরাট একটা অগ্রগতি হবে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হত্যা, গুম ও নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সম্পর্কিত আইন ও সালিশ কেন্দ্র যে প্রতিবেদনটি পেশ করেছে, সেখানে এগুলোকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্বেগজনক উল্লেখ করে চিহ্নিত করা হয়েছে। মানবাধিকার কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর বলেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অপরাধকে অধিক গুরুত্ব দেবে। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে বলেছি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিছু তদন্ত রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছি, প্রয়োজনে মানবাধিকার কমিশন নিজে তদন্ত-প্রক্রিয়া চালাবে। ফলে বছর শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত তিনটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হত্যাকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতি রয়েছে। তারা দায়ী এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যখন আমরা ভূমিকা নেওয়া শুরু করেছি, তখনই কিন্তু তিনটি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায় স্বীকার করেছে। আমরা মনে করি, মানবাধিকার কমিশনের কার্যক্রমের ফলে মানবাধিকার রক্ষায় ফল পাওয়া শুরু হয়েছে। মানবাধিকার কমিশন শুধু নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে কথা বলবে না। আমরা নাগরিকের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়েও কাজ করব। সে জন্য আমরা হাসপাতাল, মাতৃসদন, বিদ্যালয়, শিশুসদন পরিদর্শনে যাচ্ছি। সেখানে নাগরিকেরা সেবা গ্রহণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কি না, তা পরখ করে দেখতে চাই। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুসদনে প্রত্যেকটি শিশুর মাথাপিছু মাসিক ব্যয় বরাদ্দ মাত্র এক হাজার ১৫০ টাকা। অর্থাৎ, প্রত্যেকটি শিশুর সকালের নাশতা বাবদ বরাদ্দ এক টাকা ৩৮ পয়সা, এই এক টাকা ৩৮ পয়সা দিয়ে একটি শিশুকে কি নাশতা বা সেবা দেওয়া যেতে পারে। এ কাজগুলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে হবে। শিশুসদনে কোনো বাবুর্চি পদ নেই। বিশেষ করে, বালিকা শিশুসদনে ১০০ জন বালিকার রান্নাবান্নার কাজ করতে হয় ছোট মেয়েদের। এগুলো আমরা দেখেও দেখছি না। আমাদের ৬৪ জেলায় ৬৪টি শিশুসদনের জন্য ৬৪টি বাবুর্চি পদ সৃষ্টি করা কী এমন ব্যাপার, যেখানে ৩৪৫টি শুল্কবিহীন গাড়ি আমদানি করতে সময় লাগে না। আমি অনেক বিদ্যালয় পরিদর্শন করেছি। সেগুলোতে লাইব্রেরি ও কম্পিউটার ল্যাব দেখতে চেয়েছি। দেখেছি কম্পিউটারগুলো চালানোর জন্য কম্পিউটার প্রশিক্ষকের পদ নেই বিদ্যালয়গুলোতে। লাইব্রেরিতে দীর্ঘদিন ধরে কোনো শিক্ষার্থী প্রবেশ করেনি বলে আমার ধারণা। প্রতিষ্ঠিত এসব বিদ্যালয়ে লাইব্রেরির চাবি খুঁজতে সময় লেগে যায় আধা ঘণ্টা এবং বইগুলোর ওপর ধুলা দেখে মনে হয় কয়েক বছর মানুষের হাত বইতে পড়েনি। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে সহপাঠ্য বই কিনতে মন্ত্রণালয় যে বরাদ্দ দিচ্ছে, তা মনিটর করার জন্য শিক্ষা কর্মকর্তারা কী উদ্যোগ নিচ্ছেন, তা আরও জোরালোভাবে দেখা উচিত।
আগামী বছরে মানবাধিকার কমিশন যে ভিত্তিতে কাজ করবে, তা হলো অধিকারভিত্তিক ও দায়িত্বসচেতন। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী দিয়ে আমরা সারা দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুল ও কলেজে অধিকার ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করার উদ্যোগ নিয়েছি। শুধু বিজি প্রেসের একটি শাখা যদি সুপ্রিম কোর্টের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়, তাহলে পেপার বুক তৈরি করতে দেরি হয় না। পেপার বুক যদি যথাসময়ে তৈরি হয়, তাহলে বছরের পর বছর আসামিরা ভুগবেন না। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামি, যাঁরা পাঁচ-সাত বছর ধরে ঝুলে আছেন, তাঁদের আপিল রিভিশন হচ্ছে না শুধু পেপার বুকের অভাবে। দ্রুত এসব মামলার নিষ্পত্তির জন্য এটি অত্যন্ত জরুরি।
২০১১ সাল থেকে মানবাধিকার কমিশন প্রতিটি হরতাল পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুই পক্ষ থেকেই হরতালের সময় অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে কি না, সে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করবে মানবাধিকার কমিশন। প্রতিটি হরতাল পর্যবেক্ষণ করে তার ওপর একটি প্রতিবেদন জাতির সামনে তুলে ধরা হবে।

সুলতানা কামাল
সরকারি কার্যক্রমে নজরদারি রাখা নাগরিক সমাজের একটি কাজ, তা অব্যাহত রাখাই হবে নাগরিক সমাজের বড় সার্থকতা। নাগরিক হিসেবে আমার যে দায়িত্ব আছে, যত ঝুঁকিই আসুক না কেন, আমি আমার কথা বলেই যাব। আমি আমার বাক্স্বাধীনতা কখনোই সমর্পণ করব না। আমাদের কথা বলার অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সেখানে গণমাধ্যমের ওপর যদি কোনো আক্রমণ বা আঘাত আসে, তবে সেটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য খুব একটা সুখকর সংবাদ নয়। আমরা একটা প্রতিবেদনে পেয়েছি, ২৯৮ জন সংবাদকর্মী সাংবাদিকতার পেশাগত কাজ করতে গিয়ে নানা ধরনের হুমকি, আক্রমণ, এমনকি শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, তাঁদের বেশির ভাগই আক্রমণের শিকার হয়েছেন সরকারপক্ষের সাংসদ কিংবা তাঁদের দলীয় সমর্থক নেতা-কর্মীর দ্বারা। সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা প্রশাসনের তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। আমাদের যে বিষয়ে সমস্যা হচ্ছে, সে ব্যাপারে যদি আমরা কথা বলতে চাই, যাঁর কাছে ক্ষমতা আছে তাঁর কাছে নালিশ করতে চাই, তখন দেখা যায়, ক্ষমতাসীনদের সহনীয় ক্ষমতা খুবই কম। তাঁরা তাতে যথেষ্ট মনোযোগ দিচ্ছেন না এবং সহনশীলভাবে দেখছেন না। সেটি সত্য না মিথ্যা, তা নির্দিষ্ট একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হোক। কিন্তু তার আগেই অন্য ধরনের প্রতিক্রিয়া কেন থাকবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারে সন্তু লারমা কেন বলবেন, ‘এ সরকারের আমলে এই সমস্যার কোনো সমাধান হবে, সে ব্যাপারে আমার বিশ্বাস নেই।’ অথচ এ সরকারই বিগত সময়ে পার্বত্য চুক্তিটি সম্পাদন করেছিল। তাদের নির্বাচনী ইশতেহার থেকে শুরু করে সব কথাবার্তায় পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার পেয়েছি। কিন্তু তার কোনো বাস্তব তৎপরতা দেখতে পারছি না। এর ফলে সাধারণ মানুষ কিন্তু উচ্চপর্যায়ের নেতাদের কথার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। মানুষের মধ্যে যখন এ ধরনের আস্থাহীনতা দেখা যায়, তখন মানুষ কিন্তু নিজের হাতে আইন তুলে নিতে চায়—সেটা ভালো কিংবা খারাপ হোক।
বিগত সব সরকারের আমলে আমরা দেখেছি, যাঁরা ক্ষমতায় যান, তাঁরা ভুলে যান, তাঁরাও সাধারণ মানুষ হিসেবে ছিলেন এবং একটা সময় পর তাঁদেরও ক্ষমতা থেকে ফিরে সাধারণ মানুষের কাতারে দাঁড়াতে হবে। তাঁদেরও ক্ষমতাধরদের কাছ থেকে এ ধরনের নিপীড়ন ও সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। তাঁরা ভুলেই যান, ঢাকা শহরে যানজট হতে পারে। তাঁরা ভুলে যান, আন্দোলনে নামলে সরকারি দলের পুলিশ দ্বারা নির্যাতিত হতে হবে। আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগের নাসিম ভাইয়ের মাথা ফেটে রক্ত বের হয়, আবার বিএনপির সাদেক হোসেন খোকারও মাথা ফেটে রক্ত বের হয়। ক্ষমতায় গেলে সব দলের নেতারা ভুলে যান যে একটা সময় পর তাঁদেরও বিরোধী দলে আসতে হবে। আমরা দুই দলের কাছে জোর দাবি করছি, এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে। আপনারা যখন সাংসদ হয়ে সংসদে যান, তখন মনে রাখতে হবে, জনগণ তাঁদের জন্য কাজ করার লক্ষ্যে ভোট দিয়ে আপনাদের নির্বাচিত করেছেন। আপনাদের দায়িত্ব দিয়েছেন দেশ পরিচালনার জন্য। সংসদে গিয়ে জনগণের পক্ষে কথা বলবেন—এটি ভুলে গেলে চলবে না। জনগণ আপনাদের সুযোগ দিয়েছেন সংসদের মতো জায়গায় একত্র হওয়ার এবং আলোচনা করার। সে সম্মানবোধকে কেন আপনারা ভুলে যান। আপনারা কি নির্বাচনকে নিজেদের জনপ্রিয়তার অংশ হিসেবে দেখেন, নাকি আর কোনো কাজ থাকে না নির্বাচনের পর। আমাদের ট্যাক্সের টাকায় যে নির্বাচনে আপনারা প্রতিযোগিতা করেন, এমনকি প্রাণপাত করেন, সেই নির্বাচনকে আপনারা সবচেয়ে বেশি অবমূল্যায়ন করেন। সে নির্বাচনের আর কোনো শ্রদ্ধা, মূল্য রাখেন না। আপনারা যে অঙ্গীকার করে সংসদে গিয়ে বসেন, তা ভুলে যান। আপনাদের মানুষ এত শ্রদ্ধা করে, ১৪ কোটি মানুষ আপনাদের ওপর আস্থা রাখছে, আপনাদের দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিচ্ছে। সে জায়গায় যদি আপনারা এ ধরনের আচরণ করেন, তখন জনগণ যদি আপনাদের বিরুদ্ধে কথা বলে তার প্রতিবাদ করার কোনো ন্যায়ত অধিকার আছে বলে মনে হয় না। রূপগঞ্জে সেনা আবাসন নিয়ে দিনের পর দিন মানুষ আন্দোলন করল—এই জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না, তাদের উচ্ছেদ করা যাবে না, সেখানে কেন প্রাণপাত হবে। যেখানে কয়লা নিয়ে ভালোভাবে কথাবার্তা চলছে, সেখানে জনগণের স্বার্থে কীভাবে কয়লা ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়গুলো তুলে ধরতে হবে। গাজীপুর ও মুন্সিগঞ্জে যে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, সাধারণ মানুষের কথা শুনে তারপর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
নাগরিক সমাজকে কেন কথায় কথায় ষড়যন্ত্রকারী বলা হবে। কেন তাদের নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। সুশীল নাগরিক সমাজে বেশির ভাগই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষ। দেশের মঙ্গল চিন্তা করে তাদের নিয়ে সন্দেহ করা ঠিক নয়। আজকে টিআইবি যখন প্রতিবেদন পেশ করল, তখন তাদের কীভাবে হয়রানি করা হলো। সেখানে আবার আরেক রহস্য। যাঁরা মামলা করলেন, তাঁদের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। আবার সরকারদলীয় আইনজীবীদের পক্ষ থেকে টিআইবিকে চিঠি পাঠানো হলো, আপনাদের হয়রানি করার ব্যাপারে তাদের হাত নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন নীরব ছিল? যে বিচারক সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত, তাঁর মনে কি এ প্রশ্নটি এল না, কী কারণে এই মামলা করা হচ্ছে। অন্যদিকে সাংসদ শাওনের গাড়ির ভেতরে তাঁরই গুলিতে একজন লোক নিহত হলেন, তখন তাঁর কোনো খবরই নেই। তাঁকে খুঁজে পায় না পুলিশ। এ ধরনের ঘটনা যখন ঘটে, তখন সবার মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে, আসলে কী হচ্ছে। আমরা জাতি, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ সমান অধিকার ভোগ করব। যেখানে অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেখানে কেন এখনো অর্পিত সম্পত্তির মতো অদ্ভুত আইন এ দেশে থাকবে, কিছুতেই এর কোনো সংশোধন করতে পারব না। কারাগার-পরিস্থিতির কেন উন্নয়ন হবে না। দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের বিচার হয়নি, যাঁরা বন্দী অবস্থায় আছেন। যাঁদের বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি; কিন্তু বন্দী অবস্থায় দীর্ঘদিন আছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের অনেকেই আবার নিরপরাধ। তাঁরা যদি অপরাধ করেও থাকেন, তাঁদের বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। তাঁদের অনেকের কথা পুলিশ ভুলেও গেছে। এই যে অমুকের সঙ্গে আরও অনেকজন। ওই অনেকজন সন্দেহে অনেককে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তাঁদের অনেকে আছেন যাঁরা অপরাধ করেছেন, বিচারে হয়তো ছয় মাসের শাস্তি হতো, কিন্তু তাঁরা বছরের পর বছর জেলে পড়ে আছেন। এগুলোর জবাবদিহি আমাদের জাতি হিসেবে করতে হয়। কেন আমাদের ‘ক্রসফায়ার’ নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলতে হয়? আজ থেকে ৫০ বছর পর ইতিহাসে লেখা থাকবে বাংলাদেশে ক্রসফায়ার হতো। তখন কেউ জানবে না এটি কোন সরকারের, কার কারণে হয়েছে। কেন জাতি হিসেবে আমরা এ ধরনের অপরাধের দায়দায়িত্ব নেব? এই দেশের ভালো-মন্দ সবকিছুর দায়দায়িত্ব তো আমাদের। আপনারা একটু অনুগ্রহ করে নাগরিক সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ান। নাগরিক সমাজের মধ্যেও ভালো-মন্দ আছে, দলীয়করণ আছে। কিন্তু শুরুটা শুরু হতে হবে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে। আপনাদের যে এত বৈরিতা, অশ্রাব্য ভাষায় কথাবার্তা বলা, তাহলে আমরা কী শিখব? আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কাউকে অনুসরণ করার কথা বলতে পারব না। রাজনীতিবিদদের রাজনীতির বাইরের কাউকে দরকার হয় না হেয় করতে। আপনারা সংসদের মতো জায়গায় যে ভাষায় কথা বলেন, তাঁদের হেয় করতে আর কাউকে দরকার হয় না। রাজনীতিকে কলুষিত করা, দুর্বৃত্তায়িত করা, রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতার জন্য রাজনীতিবিদেরা নিজেরাই দায়ী।

এ কে আজাদ
২০০৯-১০ অর্থবছরে আমাদের দেশে মোট বিনিয়োগ হয়েছে এক হাজার ৫২৪টি প্রজেক্টে ২২ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশি বিনিয়োগ ছিল এক হাজার ৩৯৫ প্রজেক্টে ১৮ হাজার ১৩২ কোটি টাকা এবং বিদেশি বিনিয়োগ ছিল সরাসরি ও যৌথ অংশীদারিত্বের মাত্র ১২৯টি প্রজেক্টে চার হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১০ অর্থবছরে আমাদের বিনিয়োগ-পরিস্থিতির পুরো চিত্র বদলে গেছে। প্রথম ১১ মাসে আমাদের বিনিয়োগ হয়েছে ৬২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা, যার দেশি বিনিয়োগ ৪০ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা আর বিদেশি বিনিয়োগ ২১ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। ২০০৯ সালের জুলাই-অক্টোবরে ক্যাপিটাল মেশিনারি রপ্তানি হয়েছে ৪৪৮ মিলিয়ন ডলার। ঠিক একই সময়ে ২০১০ সালে তা দাঁড়িয়েছিল ৬১০ মিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরে আমরা রপ্তানি করেছি ১৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে রপ্তানি দাঁড়াবে ৩২-৩৫ বিলিয়ন ডলারে, যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জ্বালানিসংকটের চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়। আমাদের জুলাই-অক্টোবর মাসে আমদানি বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। আর সবচেয়ে আশার আলো যেটি, তা হলো এত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শিল্প-কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ৬৮ শতাংশ। ২০১৩ সালে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হারের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ শতাংশ। এ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আমাদের আরও ২৮-৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ দরকার। এই লক্ষ্য অর্জনে আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জ্বালানিসংকট নিরসন করা। গতকালও প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরও দুই হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হবে। সরকার যে রোডম্যাপটি অনুসরণ করছে, তার মধ্যে ৮০ শতাংশও যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে সরকারের জন্য এটি একটি বিরাট সাফল্য অর্জন হবে। কিন্তু পেট্রোবাংলা এক বছর আগে গ্যাসের ব্যাপারে যে আশ্বাস আমাদের দিয়েছিল, তারা তা পূরণ করতে পারেনি। তারা বলেছিল, তাদের গ্যাসের কোনো স্বল্পতা নেই, শুধু পাইপলাইন বসাতে হবে।
সিলেট থেকে কিংবা অন্যান্য জায়গা থেকে শুধু গ্যাসলাইনের মাধ্যমে ঢাকায় স্থানান্তর করলে দুই বছরের মধ্যে গ্যাসের কোনো সমস্যা থাকবে না। কিন্তু এক বছরের মধ্যে পেট্রোবাংলা গ্যাসের সমস্যা সমাধানে সফল হতে পারেনি। আগামী দুই বছরেও এই সমস্যা সমাধান হবে বলে আমরা কোনো ইতিবাচক লক্ষণ দেখতে পাইনি। এই জায়গায় সরকারের আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার। চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে ঢাকার একমাত্র রাস্তায় আগে সাড়ে চার ঘণ্টায় মালামাল আনা-নেওয়া যেত। এখন ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে যানজটের কারণে। আমরা শুনেছি, সরকার এখানে চার লেনের একটি রাস্তা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু কত দিনের মধ্যে এই কাজটি শুরু হবে এবং কবে শেষ হবে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ বা প্রস্তাব এখনো পাইনি সরকারের কাছ থেকে। পাশাপাশি যোগাযোগের জন্য পদ্মা সেতু অত্যন্ত জরুরি। এটির কাজ শুরু করার ব্যাপারে ইতিবাচক উদ্যোগ দরকার। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, গত বাজেটে পিপিতে তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও এর বাস্তবায়নে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। এই পিপিপি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কার মতো দেশ তাদের অবকাঠামোগত সুবিধা পেয়ে উন্নয়ন করেছে। এই পিপিপির টাকা যদি সঠিকভাবে ব্যয় করা হয়, তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরকারের যৌথ অংশীদারির মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা সম্ভব।
বর্তমান সরকারের জরিপমতে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা দুই কোটি ৭০ লাখ। এর মধ্যে শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত লোকই বেশি। প্রতিবছর ২০ লাখ লোক যুক্ত হয় কর্মসংস্থানের খোঁজে। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলো ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান করতে পারে। বাকি ১০ লাখ লোকের বেশির ভাগই বেকার থেকে যায়। বেকারত্ব কমানোর জন্য মধ্য আয়ের দেশে যেতে হলে আমাদের জিডিপি ১০ শতাংশে যেতে হবে। বর্তমানে আমাদের জিডিপি হচ্ছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। আমাদের এই মুহূর্তে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ অতি নগণ্য। মূলত দেশি উদ্যোক্তারা বেশি বিনিয়োগ করছেন। বিনিয়োগের জন্য অবশ্যই ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। গত দুই বছরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল বিধায় বিনিয়োগ বাড়ছে। কিন্তু আমরা দেশি বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করছি, আগামী তিন বছর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকবে কি না। সে অনুযায়ী চিন্তিত পদক্ষেপ নিয়ে এগোচ্ছি। যখন আমরা দেশি বিনিয়োগকারীরা চিন্তিত, তখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কীভাবে উৎসাহিত হবেন, সে প্রশ্নটি থেকে যাচ্ছে। আমরা ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো চেষ্টা করছি সবার কাছে যাওয়ার, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছি। কৃষিতে চার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে বর্তমান সরকার সফল হয়েছে। মানুষের কাছে স্বল্পমূল্যে সার পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে উৎপাদনমূল্য কমে গেছে। পাট আমাদের সোনালি আঁশ। বর্তমান সরকার পাট রপ্তানিকে এগিয়ে নিয়ে আসছে। আগে যদি কেউ রপ্তানি করত, তার রপ্তানি বেনিফিট ছিল ৭ শতাংশ, তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে গত চার মাসে এ খাতে ৪৪ শতাংশ রপ্তানি আয় বেড়েছে, যা বছর শেষে এক বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। পাটের মূল্য আজ দুই হাজার ৪০০ টাকা। আগে পাটের উৎপাদনমূল্য না পেয়ে কৃষক পাটে আগুন ধরিয়ে দিতেন। সেই পাট থেকে এখন এক বিলিয়ন ডলার আয় হচ্ছে। এটি সরকারের সফল কর্মসূচি। আজ ২৩০টি শিল্পকারখানায় যাঁরা ১০০-১৫০ কোটি টাকার মেশিন বিদেশ থেকে এনেছেন, তাঁরা পেট্রোবাংলা ও তিতাস গ্যাসকে টাকা জমা দিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ করে তাঁরা জানতে পারলেন, গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হবে না। একজন বিনিয়োগকারীকে এক বছর ধরে কাজ করতে হয় প্রক্রিয়াধীন ব্যাংকঋণের জন্য। তিনি বিদেশ থেকে মেশিন এনে ব্যাংকে ১৩-১৪ শতাংশ সুদ দিচ্ছেন। কিন্তু দেড় বছর যাবৎ গ্যাসের সংযোগ পাচ্ছেন না। ছয় মাস আগে যদি জানাতেন, আপনারা গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ দেবেন না, তবে এই লোকগুলো পথে বসতেন না। সরকারের গ্যাসসংযোগের ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সরকার যদি নীতিমালা গ্রহণের আগে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে সরকারের ভুল করার আশঙ্কা কম থাকে।
এসব সমস্যার সমাধানে সরকার ও বিরোধী দলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সব দলকে বলতে চাই, একটি হরতালে কত লোকের কর্মসংস্থান হবে, দেশের অর্থনীতি কতটুকু এগিয়ে যাবে, যদি এ ধরনের লাভজনক কিছু দেখাতে পারে, তবে আমরা নিজেরাই হরতালে যোগ দেব। যে কর্মসূচি দেশের মানুষকে কর্মসংস্থান থেকে বিরত রাখে, অর্থনীতিকে পিছিয়ে দেয়, বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে, সে ধরনের কর্মসূচি কোনো দলের রাজনীতিবিদদের কাছে প্রত্যাশিত নয়। গত বছর আমরা, ব্যবসায়ীরা ট্যাক্স বাবদ সরকারকে ৬২ হাজার কোটি টাকা দিয়েছি। এ বছর আমাদের ওপর ৭২ হাজার কোটি টাকা ধার্য করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, এর চেয়ে আরও ২৫ শতাংশ বেশি অর্জন হতে পারে। সাংসদেরা শুল্কমুক্ত গাড়ি নিচ্ছেন, বিদেশ ভ্রমণ করছেন কিন্তু সংসদে যাচ্ছেন না। সাংসদ হিসেবে সব সুবিধা ভোগ করা সত্ত্বেও তাঁরা কেন সংসদে যাওয়া থেকে বিরত থাকছেন। হরতালের বিকল্প ব্যবস্থার কথা যখন এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে বলা হলো, তখন সরকারই বিরোধিতা করে বলল, হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার। হরতাল যদি গণতান্ত্রিক অধিকার হয়, তাহলে সবাই মিলে কেন হরতাল করি না। একটি বাচ্চাকে কেন শেখানো হবে না, আজ স্কুলে যেতে পারবে না, তোমাকে স্কুলে যেতে দেওয়া হবে না—এটি গণতান্ত্রিক অধিকার। হরতালের বিকল্প ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। দেশ স্বাধীন করার জন্য যে প্রেক্ষাপট ছিল, তখনকার সময় আর বর্তমান প্রেক্ষাপট এক নয় যে হরতাল করতেই হবে। নাগরিকেরাই কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোকে ক্ষমতায় আনে। সরকার যখন মানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়, তখন মানুষ পরিবর্তন চেয়ে বিরোধী দলকে ভোট দেয়। আদালতে পরিচয় হয় এটি কোন দলের কোর্ট—বিএনপি, না আওয়ামী লীগের? মামলার জামিন বলেন আর মামলার রায় বলেন, সেই ধারাতেই রায় পাওয়া যায়। এটি যদি হয়, তাহলে সহজেই অনুমেয়, জাতি হিসেবে আমরা কোথায় যাচ্ছি। সমাজের সর্বোচ্চ আদালতে যদি বিচারপ্রার্থীরা সঠিক বিচার না পান, তবে তা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অতি দ্রুত এই ব্যবস্থার বিলুপ্তি দরকার।

আব্দুল কাইয়ুম
বিএনপির প্রতিশ্রুতিশীল নেতা হিসেবে পরিচিত জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বলার জন্য অনুরোধ করছি।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
আজকের আলোচনায় বাংলাদেশের অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। যেহেতু রাজনীতিতে মাঠকর্মী হিসেবে আছি, সেহেতু বিষয়গুলো আমাকে ব্যক্তিগতভাবে উপকৃত করবে।
বর্তমানে যে বিষয়টি আমি পর্যবেক্ষণ করেছি, তরুণ প্রজন্মের ভেতরে রাজনীতির প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। আমার বাড়ি যেহেতু সৈয়দপুরে, যাতায়াতের জন্য আমি ট্রেনেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। উত্তরায় যেহেতু আমার বাড়ি, তাই এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে আমি উঠি। একদিন সকালে একা বসে আছি স্টেশনে, ট্রেনের অপেক্ষায়। একজন তরুণ এসে প্রশ্ন করে, ‘আপনি বিএনপির নেতা না? আপনি একা কেন? আপনার আশপাশে তো অনেক নেতা-কর্মী থাকার কথা।’ আমি তাকে উত্তর দিই, আমি একাই যাতায়াত করি। তখন সে আমাকে সরাসরি বলে, ‘আমি রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের পছন্দ করি না।’ আমি প্রশ্ন করি, কেন করো না। সে বলে, ‘রাজনৈতিক নেতারা যা বলেন, তাঁরা তা করেন না। মিথ্যা কথা বলেন।’ আমি তাকে প্রশ্ন করি, তুমি ভোট দিয়েছ কি না। উত্তরে সে জানায়, সে ‘না’ ভোট দিয়েছে। আমি তাকে প্রশ্ন করি, তুমি কোন পত্রিকা পড়ো। উত্তরে বলে, বেশির ভাগ সময়ই সে প্রথম আলো পড়ে। অর্থাৎ প্রথম আলো তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই বোধ সৃষ্টি করতে পারছে—কোনটি ভালো, কোনোটি মন্দ। এটি আশঙ্কার কারণ যে এই তরুণ প্রজন্ম রাজনীতির প্রতি একটি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে, যা দেশ ও জাতির জন্য কোনোভাবেই কল্যাণকর নয়। ২০-২২ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ছাত্রসংসদগুলোর নির্বাচন হচ্ছে না। আজকে রাজনীতির যে বন্ধ্যত্ব সৃষ্টি হচ্ছে, রাজনীতিতে প্রকৃত রাজনীতিবিদেরা আসছেন না, ব্যবসায়ীরা আসছেন, সেনা-আমলাদের প্রাধান্য বেড়ে যাচ্ছে; এর প্রধান কারণ, যেখানে সচেতন রাজনৈতিক নেতা তৈরি হওয়ার কথা, সেখানে প্রকৃত নেতা তৈরি হচ্ছে না। ফলে যোগ্যতাসম্পন্ন নেতা তৈরি হতে পারছে না।
বর্তমান সরকার যখন বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এল, যদিও আমাদের দলে এ নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন আছে। তার পরও বলব, সরকারের সামনে দুটি চ্যালেঞ্জ ছিল। একটি রাজনৈতিক, অন্যটি অর্থনৈতিক। রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জটি ছিল এক-এগারোর পরে রাজনীতিতে যে শূন্যতা কিংবা জটিল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকে ফিরিয়ে রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করার জন্য একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা। দেশে একটি গণতান্ত্রিক আবহাওয়া সৃষ্টি করা, যাতে ভয়ভীতির বাইরে থেকে দলমত-নির্বিশেষে সবাই মতামত দিতে পারে, সে পরিবেশ সৃষ্টি করা। এক-এগারোর পর দেশে অর্থনৈতিক যেসব সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল, সেখান থেকে দেশকে একটি সচল অর্থনৈতিক অবস্থায় নিয়ে যাওয়া।
আমি খুব খুশি হতাম, যদি বলতে পারতাম, গত দুই বছরে আমাদের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার সামান্য হলেও এগিয়ে যেতে পেরেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলতে হচ্ছে, আমরা যাঁরা রাজনীতি করি, তাঁরা অত্যন্ত অস্বস্তির মধ্যে আছি। আমি জানি না, সারা দিন কাজ করার পর বাসায় ফিরে যেতে পারব কি না। আমি জানি না, আমার একজন কর্মী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করে সুস্থভাবে বাসায় ফিরে যেতে পারবে কি না। আজকে খবরের কাগজে এসেছে, পিরোজপুরে ছাত্রদলের এক ছেলেকে ইটভাটায় নিয়ে শরীরে লোহার রড ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় উদ্ধারের পর সে মারা যায়। এটি করেছে আওয়ামী লীগের পরিচয়ধারী একজন সন্ত্রাসী। স্বাভাবিক কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রতিটি জেলায় সভা হয়েছে। আমাদের দপ্তর সম্পাদক রিজভী আহমেদ রাজশাহীতে গিয়েছিলেন। সেখানে পুলিশ তাঁকে লাঠিপেটা করেছে। এটি হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক চিত্র। ছয় মাস আগে নিখোঁজ হওয়া চৌধুরী আলমের কোনো খবর আমরা জানি না। একজন সাংসদকে ধরে নিয়ে তাঁর পায়ের নখ তুলে ফেলা, রক্তাক্ত করা—তাঁর বিরুদ্ধে যতই অভিযোগ থাকুক, এটি কোন ধরনের সভ্যতা। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, লাশ গুম করা, রিমান্ডে অমানুষিক নির্যাতন যে পরিমাণ বেড়েছে, তা অতীত ইতিহাসে আর কখনো দেখিনি।
বিএনপি-সমর্থিত উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সানাউল্লাহকে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমরা খুব আশান্বিত হয়েছিলাম এ কারণে যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে এসব হত্যাকারীকে চিহ্নিত করে বিচারের সম্মুখীন করা হবে। কিন্তু তার পরই আমাদের সব আশা শেষ হয়ে গেল, যখন প্রধানমন্ত্রী বললেন, এটি তাঁদের নিজ দলের কাজ কি না, এ কথা শুনে। সঙ্গে সঙ্গে এ কর্মের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তারা প্রশ্রয় পেয়ে গেল এবং এ ধরনের কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকল।
আজকে হরতালের কথা উঠছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এক করে দেখলে হবে না। এর আগে আওয়ামী লীগ দুবারে ১৭৩ দিন ও ১৩০ দিন হরতাল করেছিল। আমরা এই দুই বছরে মাত্র তিন দিন হরতাল করেছি। আমি কিন্তু হরতালকে সমর্থন করছি না। কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে আমরা হরতালে গেছি। আমরা যখন মানববন্ধনের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করতে গেছি, তখন পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে নির্যাতন করা হয়। আমাদের যখন সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হয় না, এমনকি একটি মিছিল করতেও দেওয়া হয় না, তখন বাধ্য হয়ে হরতাল দেওয়া ছাড়া আমাদের সামনে বিকল্প কোনো পথ খোলা থাকে না। আমাদের নেত্রী বিদেশে যাওয়ার সময়েও বিমানবন্দরে দলের মহাসচিব ও সাংসদদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক দেখা করতে দেওয়া হয় না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের দায়িত্ব বা শুরুটা করতে হবে সরকারকে। সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে সবাইকে ডেকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কীভাবে সমস্যাগুলো সমাধান করা যায়। কিন্তু সরকার আজ পর্যন্ত এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
আমরা অত্যন্ত চিন্তিত, সর্বোচ্চ আদালতে গিয়েও সুবিচার পাচ্ছি না। আগে অন্তত হাইকোর্টে গিয়ে সুবিচার পাওয়া যেত। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করার প্রবণতা শুরু হয়েছে। দলীয় লোকজনকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। দলীয়করণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে প্রকাশ্যে মন্ত্রী বলছেন, পুলিশে ৯০ জন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে ৮৮ জনই আওয়ামী লীগের। কয়েকজন মন্ত্রী প্রকাশ্যে বলছেন, আমরা যে নিয়োগ দেব, তা অবশ্যই দলীয় লোকদের দেওয়া হবে। বিরোধী দলের রাজনীতিকে দমন করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে—মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। যেখানে দলীয় নেতা-কর্মীদের ছয় হাজার ৬০০ মামলা সরকার তুলে নিয়েছে, সেখানে বিরোধী দলের একজন আছেন, তিনি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তা ছাড়া আর কোনো মামলা নেই। কয়েক দিন আগে আবার নতুন করে বিরোধী দলের নেতাদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দলের মহাসচিব, যিনি সংসদের চিফ হুইপ ছিলেন এবং ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, যিনি স্পিকার ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে এত দিন পর নতুন করে মামলা দেওয়া হচ্ছে। এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করে রাখার অপচেষ্টা, যে কারণে সরকার এসব দমনমূলক কার্যক্রম করছে।
এই সরকারের কাছে জনগণ ব্যাপক প্রত্যাশা করেছিল। আমি স্বীকার করব, সরকারের কৃষি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনেক ভালো কাজ করেছে। কিন্তু বাকি মন্ত্রণালয়গুলো বিশেষ করে, জ্বালানি মন্ত্রণালয়, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ বিনা টেন্ডারে কাজ পাওয়ার যে আইনটি করা হয়েছে, সেটি বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বিনিয়োগ অর্থনীতি নির্ভর করবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। আমরা সবাই বাংলাদেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে চাই। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে এসব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাইনি। আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন, এই সরকার আগে যে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করেছিল, সেই সময় রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ ও পত্রিকা বন্ধ করে অধিকার খর্ব করা হয়েছিল। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সরকার আবার সেই একদলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে কি না, যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।
তাদের ইদানীং যে কর্মকাণ্ড, পরমতসহিষ্ণুতা বলতে কিছু নেই। কারও কোনো কথা তারা সহ্য করছে না। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো ব্যক্তিকে অপমান করতে তাদের এতটুকু বাধছে না। টিআইবির মতো প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করা হচ্ছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে চায়, তারা স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারছে না। সংবাদমাধ্যমের ২৯৮ জন সাংবাদিকের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। মাহমুদুর রহমান জেলে আছেন। চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করা হয়েছে। এভাবে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে। দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে। এ বিষয়গুলো আমাদের অত্যন্ত ভাবিয়ে তুলছে। আমরা অত্যন্ত চিন্তিত, আগামী বছরগুলো কীভাবে যাবে। আমরা সব সময়ই সহযোগিতা করতে চাই। প্রথমবারের মতো আমরা, বিরোধী দল, প্রথম অধিবেশনে সংসদে যোগ দিয়েছি। নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনের রায় আমরা মেনে নিয়েছিলাম। বিরোধীদলীয় নেত্রী সংসদে বলেছিলেন, সরকারের প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য আমরা সহযোগিতা করতে চাই। তারই ধারাবাহিকতায় কোপেনহেগেন সম্মেলনের আগে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনি মতামত তুলে ধরেছিলেন। ভারত সফরের আগেও প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে আমরা বিরোধী দল কী ভাবছি, তা উল্লেখ করেছিলেন। বাজেটের আগে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বাজেট-ভাবনা নিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী এসেছিলেন। তাঁর ভাবনার কথা তিনি বলেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা আমরা পাইনি। টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে আমরা টিম দিতে চেয়েছিলাম। সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। আজকে দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে।
বর্তমান দেশে স্বাধীন মতপ্রকাশের পরিবেশ এখনো বিরাজ করছে না। আমি কোনো এক টেলিভিশন চ্যানেলে টক শোতে গিয়েছি, তখন সেখানে আমাকে বলা হয়, কিছু কিছু বিষয়ে আপনি কথা বলতে পারবেন না। আমি বললাম কেন। তারা জানাল, এ ব্যাপারে বিশেষ বাহিনীর নির্দেশ রয়েছে।
বিভিন্ন জায়গা থেকে গোয়েন্দা বাহিনী গণমাধ্যমের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে। গণতন্ত্র বিকাশের জন্য মুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন। বাংলাদেশকে যদি অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিতে হয়, তবে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।

আল মাসুদ হাসানুজ্জামান
দুটি দলের নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে, যাতে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো যায় কীভাবে, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দুটি দলেরই তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার পর্যালোচনা করা দরকার। তারা তাদের অঙ্গীকার পূরণে কতটুকু কাজ করছে, সে ব্যাপারে আত্মসমালোচনা করা দরকার। সরকারি দলের উচিত, নির্বাচিত হওয়ার পর জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ক্রমান্বয়ে কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছে, সে বিষয়ে পর্যালোচনা করা। তেমনি বিরোধী দলেরও উচিত, জনগণের কাছে জবাবদিহির জায়গায় গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে কতটুকু ভূমিকা পালন করছে, তা দেখা।
আজকে আলোচনায় বেরিয়ে এসেছে, সংসদের কী করণীয়। কিন্তু সংসদকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে হবে না। কারণ, সংসদ ও দলীয় রাজনীতি একই সূত্রে গাঁথা। সম্প্রতি একটি অর্জন হচ্ছে আরপিও। অর্থাৎ, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, যেটি পরবর্তী সময়ে আইনে পরিণত হয়েছে, যার প্রাপ্তি হলো রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহি অর্জন। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর বাধ্যতামূলক নিবন্ধন ও তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রদানে স্বচ্ছতা এসেছে। কিন্তু আরপিও প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রশ্ন রয়েছে। নিবন্ধন করা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহি আসেনি। তাদের আয়-ব্যয়ের যে হিসাব তারা দিয়েছে, তা যথেষ্ট প্রশ্নসাপেক্ষ। নবম জাতীয় সংসদের প্রাপ্তি ছিল সংসদীয় কমিটিগুলো হয়েছিল, বিরোধী দল সংসদে গিয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী সময় এগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইআইইউ সংস্থা বাংলাদেশকে ১৬৮টি দেশের মধ্যে ৮৩তম অবস্থান দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যে পাঁচটি সূচক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে একটি ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের যে ত্রুটিগুলো আছে, তা সারিয়ে তোলার জন্য কাজ করতে হবে। আমাদের দেশে যে এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে নির্বাহী বিভাগে অতিমাত্রায় ক্ষমতা প্রয়োগের চর্চা করা হচ্ছে। সেখানে ক্ষমতার কোনো ভারসাম্য নেই। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সাংসদ, বিচার বিভাগ ও স্থানীয় সরকারের ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনা অত্যন্ত জরুরি। আমি প্রশাসনের কাঠামোগত সংস্কারের দিকে ইঙ্গিত দিতে চাই। সংস্কারটি হবে সর্বত্র। সংসদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলেরও দায়িত্বশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের জন্য আচরণবিধি যেন তৈরি করতে পারি, সেটি আগামী তিন বছরের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

খন্দকার মাহবুব হোসেন
বিচার বিভাগ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিচারপ্রার্থী মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার শেষ আশ্রয়স্থল। সেই বিচার বিভাগ যদি আজকে ভেঙে পড়ে, সেই বিচারব্যবস্থার ওপর যদি মানুষের আস্থা না থাকে, তাহলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার থাকতে পারে না। আজকে কেন বিচারব্যবস্থার এ দুরবস্থা, বিশেষ করে, এই দুই বছর। আপনারা যা কিছুই করুন, বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করবেন না। তাহলে আপনাদেরও এ সমস্যার ভোগান্তিতে পড়তে হবে। তার পরও সর্বোচ্চ আদালতে চরমভাবে দলীয়করণ করা হচ্ছে। বর্তমানে তৃতীয় বিভাগ পাওয়া ব্যক্তিকেও বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আপনারা যদি দলীয়করণ করেনও, তবে যোগ্যতার ভিত্তিতে যোগ্য লোককে সেখানে নিয়োগ দিন। আমরা বিশ্বাস করি, যদি সৎ ও যোগ্যতাসম্পন্ন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়, তবে এতটা দলীয়করণ দেখা যাবে না। দুজন বিতর্কিত বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হলো। এর মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, আরেকজনের বিরুদ্ধে রয়েছে ভাঙচুরের অভিযোগ। আমরা বারবার অনুরোধ করেছিলাম, এ দুজনকে যদি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে নিয়োগ দেওয়া হয়, তবে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে অনুরোধ করলাম, তাঁদের নিয়োগ না দেওয়ার জন্য। তার পরও সাংবিধানিক দায়দায়িত্ব হিসেবে তাঁদের শপথ করানো হয়। সেখানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের যে ভাবমূর্তি ছিল, তা কেন বিনষ্ট করা হলো? আমরা বারবার বলেছি, সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগের ব্যাপারে একটি বিধিমালা করেন। তা না করে দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য লোকদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তখন মানুষের মনে প্রশ্ন উঠছে, বিচার বিভাগের স্বচ্ছতার ব্যাপারে। এখন হাইকোর্টের বারান্দায় গেলে জানা যাবে, কোন বিচারক কোন দলের, কোন কোর্টে মামলা পড়লে সুফল পাওয়া যাবে। একজন প্রধান বিচারপতি প্রকাশ্যে বলেন, কয়েকজন জেলা জজ অবৈধভাবে অর্থ নেন। নাম জানার পরও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। তিনটি মাস ধরে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে বারবার তাঁকে বলেছি, এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিন। তিনি বলেছেন, দুজনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তাঁর কাছে আছে। তিনি তাঁদের নামও প্রকাশ করলেন না, কোনো ব্যবস্থাও নিলেন না। ফলে সব নিম্ন আদালতে যেসব সৎ ও যোগ্য বিচারক আছেন, তাঁদের ভাবমূর্তি নষ্ট করা হলো। এভাবে যদি পুরো বিচারব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়ে দেশে শাসনকাজ পরিচালনা করা হয়, তাহলে দেশে গণতন্ত্র থাকবে না, আমাদের মৌলিক অধিকারও রক্ষা হবে না। রাজনৈতিক কারণেই হোক, আর ন্যায্য কারণেই হোক, মামলা হওয়ার পর রিমান্ডের নামে যে অকথ্য নির্যাতন করা হয়, তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি নিজে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী যদি খুব খারাপ লোকও হন, তিনি যদি অপরাধীও হন, কিন্তু তাঁর মতো একজন সাংসদকে এমনভাবে নির্যাতন করা হয়েছে যে তাঁর পায়ের নখ তুলে ফেলা হয়েছে, সমস্ত শরীর ব্লেড দিয়ে কাটা হয়েছে। এটিই হচ্ছে আমাদের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের চিত্র। এ ছাড়া বিরোধী দলের অসংখ্য নেতাকে দিনের পর দিন রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। তাদের কিছু স্লোগান আছে—একটি হচ্ছে বিডিআর বিদ্রোহ, অন্যটি হচ্ছে গ্রেনেড হামলার মামলা। আপনি যদি কিছু বলেন, তবে এসব মামলার সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। গ্রেনেড হামলার মামলাটি কয়েক বছর হয়ে গেছে, অথচ এখনো পর্যন্ত এর চার্জশিট চূড়ান্ত করা হয়নি। একবার মামলাটির তদন্ত শেষে চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল, পরে ৬৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যও নেওয়া হয়েছিল। আবার পরে নতুন করে মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্য পাঠানো হলো। তখন সেখানে নতুন করে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার নাম সম্পৃক্ত করা হলো। আজকে যদি বিচার বিভাগকে ধ্বংস করে দেন, তবে যাঁরা সরকারি ও বিরোধী দলে আছেন, সবারই কিন্তু সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো অবস্থা হতে পারে। মানুষের যদি বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা না থাকে, তবে তারা তখন আইন নিজের হাতে তুলে নেবে। তাই অনুরোধ করব, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করেন, যোগ্যতার ভিত্তিতে বিচারক নিয়োগ দেন। সেখানে মানুষ যেন আশা নিয়ে আসে, ন্যায়বিচার পায়, এ বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগ পৃথক্করণ করেছেন, এর ফলে বিচার বিভাগ আলাদা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির অধীনে আনার পর নিম্ন আদালতগুলো তদারকির জন্য যে জনশক্তি ও অন্যান্য সুবিধার প্রয়োজন হয়, তা কিন্তু দেওয়া হয়নি। বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পর উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সেগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। ইচ্ছাকৃতভাবে এগুলো করা হচ্ছে না এবং দলীয়করণ করে সাময়িকভাবে সুবিধা লাভের চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রতিহিংসার রাজনীতি করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করছেন, কিন্তু ভবিষ্যতে তো আপনাদেরও একই অবস্থা হতে পারে। তাই আবারও অনুরোধ করব, বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে কার্যকর করার জন্য আপনারা উদ্যোগ নিন।

নুরুল ইসলাম নাহিদ
আজ যেসব বিষয়ে আলোচনা হলো, আমি সেসব বিষয় আমার দলের ও সরকারের কাছে তুলে ধরব। আমার কেউ সমালোচনা করলে সেটিকে স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করি। যদি কেউ ভ্রান্ত ধারণা থেকে সমালোচনা করেন, সেগুলোও আমি যুক্তিসহকারে গ্রহণ করার চেষ্টা করি। আমি আমাদের কাজের ক্ষেত্রে শুধরানোর জন্য সমালোচনাকে গুরুত্বসহকারে নিই। আমাদের দেশে যে পটভূমিতে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে, তা সবারই জানা। তার আগে যে সরকার ছিল, সে সময় এখানে সুশাসন ছিল না। সে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ে বাড়তি দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বোঝা বহন করতে হয়েছে। সেটিও খুব সুখকর ছিল না। নির্বাচন হয়েছিল, সেখানে জনগণের ব্যাপক জনমত প্রকাশ পেয়েছে। শুধু ভোট দেওয়ার জন্যই বাক্সের মধ্যে মতপ্রকাশ করা হয়নি, সেখানে জনগণের একটা মনোভাব বা প্রত্যাশা প্রকাশ পেয়েছে। জনগণ একটা পরিবর্তন চেয়েছিল—এ ধরনের মনোভাব সবার মধ্যেই ছিল। আমাদের জনগণকে সম্পৃক্ত না করে আমরা যা কিছুই অর্জন করতে চাই না কেন, তা কখনো পূরণ করা সম্ভব নয়। আমাদের সরকার মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পর অর্থাৎ, ২০২১ সালে দেশের মধ্যে একটা পরিবর্তন আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এ সময়ের মধ্যে দেশের মানুষের দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, বেকারত্বসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে চায় বর্তমান সরকার। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিয়ে আসা, যাতে মানুষের জীবন আরও সহজ হতে পারে—এদিকটায় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আগে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার পর ফল প্রকাশের জন্য তিন মাস সময় লেগে যেত। আমি এসে দেখলাম, তিন মাস অনেক সময়। ফলাফল প্রকাশ ৬০ দিনের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। আমরা সর্বশেষ এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল মাত্র ৫৭ দিনে প্রকাশ করেছি। অষ্টম শ্রেণীর যে পরীক্ষা হলো, সেখানে ১৫ লাখ পরীক্ষার্থীর ফলাফল মাত্র ৩৭ দিনে দিয়েছি। শিক্ষকদের বেশি পরিশ্রমের ফলে এটি সম্ভব হয়েছে। আমরা এসএসসি, এইচএসসিসহ সব পরীক্ষার ফলাফল মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে দিয়েছি। ভর্তি-বাণিজ্য বন্ধের জন্য অনলাইনে ভর্তি-প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে শুধু এসএমএসের মাধ্যমে। আমরা শিক্ষকদের পরীক্ষা নিচ্ছি, তাঁরা আবেদনপত্র ও প্রবেশপত্র অনলাইনে পূরণ করতে পারছেন। আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযুক্তির এসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারছি। আমরা বিদ্যালয়গুলোতে কম্পিউটার দিচ্ছি, কিন্তু কম্পিউটারের আলাদা প্রশিক্ষক দিতে পারছি না। কারণ, নিয়োগ দেওয়ার আলাদা পদ নেই, অর্থও নেই। কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি, সব শিক্ষকেরই যেন কম্পিউটার বিষয়ে ধারণা থাকে। শিক্ষকদের কম্পিউটার বিষয়ে সামান্যতম প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যাতে তাঁরা কম্পিউটার চালাতে পারেন। কোনো এক সরকারের আমলে লাইব্রেরিয়ানের পদটি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা এখন চেষ্টা করছি, লাইব্রেরিয়ানের পদটি বাড়াব, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে করতে পারছি না। আমাদের মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেব, তার জন্য প্রথমে যেতে হবে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে, তারপর আইন মন্ত্রণালয়ে এটি বৈধ হলো কি না, তারপর যেতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। এটিই হচ্ছে আমাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। সরকারের মূল লক্ষ্য—সমাজকে পরিবর্তনের জন্য নিরক্ষরতা, দুর্নীতি ও দারিদ্র্য থেকে দেশকে বের করে আনা। তা যদি না করতে পারি, তবে এই দুষ্টচক্র থেকে আমরা বের হতে পারব না। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সামনে নিয়ে আসতে হবে এই পরিবর্তনের জন্য। আমরা বলছি, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে এ পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তাই আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। তাই আমরা সে রকমভাবে নতুন শিক্ষানীতি তৈরি করেছি। আমরা চাই, নতুন প্রজন্মকে আধুনিক ও মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। যুগোপযোগী শিক্ষা, যা আমাদের বাস্তবজীবনে কাজে লাগবে, সে শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তি আয়ত্ত ও প্রয়োগ করতে না পারলে সে শিক্ষা কোনো দেশে কাজে লাগবে না। সে জন্য এ ধারায় নতুন সিলেবাস তৈরি করা হচ্ছে।
আমাদের এত সমস্যার যে কথাগুলো এল, তার মূল হচ্ছে সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। নৈতিকতার অবক্ষয়ের ফলে জেনেশুনে অন্যায় কাজ করেও লজ্জাবোধ হয় না। সে জন্য আমরা বলছি, আধুনিক শিক্ষা ও প্রযুক্তির পাশাপাশি নৈতিক মূল্যবোধে পরিবর্তন আনতে চাই, যেন সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেমে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে পারি। মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করে বিদেশে চলে যায়। আমরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে জনগণের অর্থে পড়ালেখা করি, কিন্তু আমরা জনগণের কাছে মোটেও দায়বদ্ধ নই। সে ধারণাটি আমাদের মধ্যে আনা হয় না।
দুর্নীতি আমাদের একটি বড় সমস্যা। আমাদের মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি কমেছে। আমি বুঝেছি, এটি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন কাজ। মানুষের মনের বিপর্যস্ত নৈতিকতার পরিবর্তন খুবই দরকার। আমরা সবাই যদি নিজ অবস্থান থেকে কাজ করি, তবেই কেবল দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব। যদি দুর্নীতি বন্ধ করা না হয়, তাহলে স্কুলঘর নির্মাণের জন্য যে ১০০ টাকা দেওয়া হচ্ছে, সেখান থেকেও ৫০ টাকা চুরি করা হবে। ফলে আমরা পাচ্ছি অর্ধেক ঘর, যা সহজে ভূমিকম্প বা ঝড়ে পড়ে যাবে। তাই দুর্নীতি বন্ধ এবং অর্থের সাশ্রয় করতে হবে। কারণ, আমরা দরিদ্র দেশ ও দরিদ্র জনগণের অর্থ ব্যয় করি। আমি দুর্নীতি করি না, তাতে কী আসে যায়। সরকারি সম্পত্তি অপচয় হলে আমার কী। ‘সরকারি মাল দরিয়ায় ঢাল’ আমাদের এই মনোভাব পরিবর্তন করার নির্দেশ দিয়েছি মন্ত্রণালয়কে। দুর্নীতি যিনি করবেন বা যাঁর সামনে দুর্নীতি হচ্ছে, তিনি যদি তা প্রতিহত না করেন, তাঁকেও শাস্তি পেতে হবে। জনগণের অর্থ অপচয় করার ক্ষমতা কারও নেই। দুর্নীতি হতে দেখলে প্রতিহত করা উচিত।
আমাদের নিজেদের মধ্যে আগে পরিবর্তনটি আনতে হবে। আমাদের স্বার্থপরতা, দলীয়করণ—এসব থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের উদার মানসিকতা ও নৈতিক মূল্যবোধে পরিপূর্ণ মানুষ গড়তে হবে। আমাদের ট্যাক্সের পরিমাণ বেড়েছে। করের পরিধি না বাড়ালে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নিজস্ব সম্পত্তি বাড়বে না। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে তাদের স্বার্থরক্ষার বিষয়ে তর্ক করতে করতে দিন গড়িয়ে যায়, অন্যদিকে যদি ঋণের সুদ দিতেই থাকি, তাহলে আমরা এগোতে পারব না।
আমাদের জাতীয় মতৈক্য দরকার এগিয়ে যাওয়ার জন্য। দুই দলের মধ্যে মতৈক্যে পৌঁছানোর জন্য পারস্পরিক আস্থার প্রয়োজন। আজকে আমাদের সুশীল সমাজেও দলীয়করণ হয়েছে। আমাদের যদি একটি নিরপেক্ষ সুশীল সমাজ গড়ে না ওঠে—যাদের মতামত সব দল গুরুত্বসহকারে নেবে—তবে তা জাতির জন্য আশঙ্কাজনক। আমাদের মতৈক্যে পৌঁছানোর জন্য সব পক্ষের মধ্যে আলোচনা করা দরকার। আমাদের কথা বলার জন্য সংসদ ও সংসদীয় কমিটিগুলো আছে। সংসদে যাওয়া বিরোধী দলের অধিকারের মধ্যে পড়ে। বিরোধী দলের নেত্রী সংবাদ সম্মেলনে যে বাজেট দিয়েছেন, তা অর্থহীন। তিনি যদি সংসদে দাঁড়িয়ে বলতেন, আমি সরকারের বাজেট মানি না, আমি পাল্টা বাজেট দিলাম, এটি আপনারা গ্রহণ করেন। তবে সেখানে এটি যদি পাস হতো। জনগণ বলত, বিরোধীদলীয় নেত্রী সঠিক বাজেটই দিয়েছেন। যদি গৃহীত না হতো, জনগণ বলত, তিনি ভালো একটা বাজেট দিয়েছিলেন, কিন্তু সরকার তা গ্রহণ করল না। সংসদে যা বলবেন, তা দেশবাসী সবাই রেডিও-টিভিতে দেখে। সাংসদেরা তাঁদের নিজেদের স্বার্থ দেখেন না। এ কথাগুলো দুই দলকেই বলছি, বিরোধী দলে গেলে ছকবাঁধা রুটিন আছে, কী করতে হবে। তা-ই তাঁরা করেন। সুতরাং, এখানে আমাদের পরিবর্তন আনতে হবে। বর্তমান সরকার ভুলত্রুটি থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সেখানে বিরোধী দলের সহযোগিতা বা মতৈক্য থাকলে অথবা সংসদে পাল্টা যুক্তিতর্কের মাধ্যমে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা থাকলেও সরকার সতর্ক হবে। আমি মনে করি, একটা রাজনৈতিক সমঝোতা ও আলোচনার মাধ্যমেই জাতীয় ঐক্যে পৌঁছানো দরকার গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য।
আমরা তো তৃতীয় বিভাগ পাওয়া ব্যক্তিদের বিচারক নিয়োগ দিয়েছি, কিন্তু বিগত সরকারের আমলে সার্টিফিকেট ছাড়াই বিচারক হয়েছেন, এমন উদাহরণও আছে। আমাদের দেশে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

মতিউর রহমান
এতক্ষণ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সবাইকে একটি করে বক্তব্য বা পরামর্শ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।

সুলতানা কামাল
আজকের আলোচনায় যেসব বিষয় উঠে এসেছে, রাজনীতিবিদেরা একে অপরের সম্পর্কে যা বললেন, সেগুলো সরকারি ও বিরোধী দলের উভয় পক্ষের ওপরই কখনো না কখনো বর্তাবে। তাই রাজনীতিবিদদের অনুরোধ করব, এগুলো যেন তাঁদের বিবেচনায় আনেন, তাহলেই তা আমাদের উপকারে আসবে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
২০১১ সালটি বাংলাদেশের বিচারে খুবই কঠিন বছর। আরেকভাবে দেখলে বছরটিতে ২০২১ সালের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাউন্ট ডাউন শুরু হলো। ফলে সব বিষয়কে বড় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য যদি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকতে চান, তবে অবশ্যই সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগী হয়ে কাজ করতে হবে।

ইফতেখারুজ্জামান
আমি আশাবাদী। সামনে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। আমাদের নাগরিকেরা আমাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে ক্রমান্বয়ে অনেক বেশি সচেতন হতে পেরেছেন। আমরা যাঁদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠাই, তাঁদের সমালোচনা করা নাগরিকদের অধিকার ও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। রাজনৈতিক নেতাদের বলব, তাঁদের ধরে নেওয়া উচিত, তাঁদের সমালোচক তাঁদের বন্ধু।

আল মাসুদ হাসানুজ্জামান
সরকার ও বিরোধী দল দুই পক্ষেরই আত্মসমালোচনা করার সময় এসেছে। নিজস্ব বক্তব্য সামনে রেখে দলগুলোর মধ্যে কীভাবে দূরত্ব কমিয়ে আনা যায়, সে ব্যাপারে নেতারা মনোনিবেশ করবেন। বিশেষত, রাষ্ট্রের মৌলিক বিষয়ে কীভাবে মতৈক্যে পৌঁছানো যায়, সে ব্যাপারেও উদ্যোগ নিতে হবে।

খন্দকার মাহবুব হোসেন
বিচার বিভাগকে যদি স্বাধীন না রাখেন, দলীয়করণ বন্ধ না করেন, তাহলে দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। অতীতের সরকার সার্টিফিকেট ছাড়া নিয়োগ দিয়েছিল বলে আপনারা তৃতীয় বিভাগ পাওয়া ব্যক্তিদের নিয়োগ দেবেন—এটি ঠিক নয়। অতীতের সরকার যে ভুলগুলো করেছিল, তার জন্যই তো সরকারের পরিবর্তন এসেছে। আপনারাও যদি একই রকম ভুল করেন, তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোথায় থাকে।

এ কে আজাদ
আমি সরকারি ও বিরোধী দলকে অনুরোধ করব, দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কর্মসংস্থান ব্যাহত হতে পারে এবং দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত হয়ে বিনিয়োগ থেকে সরে যেতে পারেন—এ ধরনের সংকটাপূর্ণ কোনো কর্মকাণ্ড যেন দেশে না হয়, সেদিকে আপনারা দৃষ্টি রাখবেন।

দিলারা চৌধুরী
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের আরও বেশি সহিষ্ণু হতে হবে। সহিষ্ণুতার অভাব সরকারি ও বিরোধী উভয় দলের পক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে যে দলই সরকারে যায়, তার দায়িত্ব অনেক বেশি থাকে।

আসিফ নজরুল
বাংলাদেশের তরুণসমাজ অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। এর প্রতিফলন একসময় রাজনীতিতে অবশ্যই পড়বে। আমি বিশ্বাস করি, সব ক্ষেত্রে যদি এগিয়ে থাকি, তবে তার প্রভাব আজ অথবা কাল অবশ্যই রাজনীতিতে পড়বে।

মতিউর রহমান
দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ সত্যিই খুব কঠিন। এক-দুই বছর সময় কিছুই নয়। যদিও সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা খুব দরকার। আমাদের কাছে মনে হয়, এখন আর এই সম্ভাবনার বাস্তবতা আছে কি না। এই হতাশার মধ্যেও বলতে হয়, আমাদের ঘুরেফিরে একটি জাতীয় মতৈক্যে পৌঁছানোর জন্য চেষ্টা করতেই হবে। সে জন্য আমাদের নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও বিশিষ্টজন যাঁরা আছেন, তাঁদের সাহস করে উদ্যোগী হয়ে কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ইতিমধ্যে আমাদের নাগরিক ও সুশীল সমাজের মধ্যে বেশ ভয়ভীতি দেখা দিয়েছে। নাগরিক ও সুশীল সমাজের ভূমিকা রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা দেখেছি, ষাট, সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকের ইতিবাচক রাজনৈতিক পরিবর্তনে সুশীল সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আমরা সরকারি ও বিরোধী দলকে অনুরোধ করব, আমরা যেন সাহসের সঙ্গে আমাদের দায়িত্ববোধ থেকে কাজ করতে পারি, সে পরিবেশ যেন থাকে। তা না হলে ভবিষ্যতে আমাদের জন্য আবারও সংকট দেখা দেবে। আজকে আওয়ামী লীগ সরকারের যতই সফলতা আসুক না কেন, বিরোধী দল যতই সমালোচনা করুক, যদি দেশের মধ্যে একটি সমন্বয়, সমঝোতা, মতৈক্য না হয়, তাহলে সেই সংকটের দিকে আমরা আবারও এগিয়ে যাব। এ বছর আমরা স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছি। বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে অগ্রসর হয়েছে। আমরা চাই, এ বিজয়ের সাফল্য ধরে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাব। আপনাদের সবাইকে আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

No comments

Powered by Blogger.