এই লজ্জা কোথায় রাখি!

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সবসময়ই তাদের যৌক্তিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এবং দেশের স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে জাতীয় রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবেও স্বীকৃত ও সম্মানিত। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃজনশীল শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও জাতীয় পর্যায়ের সংগ্রামকে শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে সনি্নহিত করেছেন বিভিন্ন সময়ে। ফলে সঙ্গীত ও নাটক কেবল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নয়, সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের অসামান্য অবদানের ধারাবাহিকতা আজকের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তি এবং তাদের দোসরদের কোনো ঠাঁই নেই। এই অর্জনের জন্য বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবদান-আত্মদানকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক হিসেবে আমাদের অহঙ্কার করার মতো অনেক কিছুই আছে। আবার এমন অনেক ঘটনাও ঘটেছে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত ঘটনাকে পুঁজি করে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার যে কোনো প্রয়াসই নিন্দনীয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ পরিপন্থী যে কোনো কার্যক্রমকেই আমরা সংঘবদ্ধভাবে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত।
গত ২৫ এপ্রিল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি প্রফেসর মোঃ আলী আকন্দ একই বিভাগের কতিপয় শিক্ষকের হাতে নির্মমভাবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। প্রফেসর আকন্দকে মারধরের আগে বিভাগে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় এবং অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হয়। সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে প্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের বাধা দেওয়া হয় এবং তাদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করা হয়। বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তা তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করেও বাধার সম্মুখীন হন। গুরুতর আহত প্রফেসর মোঃ আলী আকন্দ বর্তমানে সাভারের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এ ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। যিনি লাঞ্ছিত হয়েছেন তিনি আমাদের সহকর্মী এবং যাদের হাতে এই বর্বরোচিত ঘটনাটি ঘটেছে তারাও এ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারেরই 'সম্মানিত সদস্য'। এ লজ্জা কোথায় রাখি! আমাদের হারাবার আর কী বাকি আছে! আমাদের দাঁড়াবার আর কোনো জায়গাই তো আমরা আর নিরাপদ রাখছি না। মানুষ গড়ার কারিগর যখন মানুষ মারার পাশবিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, তখন কোন মুখ নিয়ে শিক্ষার্থীদের নৈতিক ভিত্তি রচনায় অবদান রাখবে এই শিক্ষক সমাজ! লজ্জায়-ঘৃণায় আমাদের বিবেক বিক্ষত। ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীস্বার্থ কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির চেয়েও বড়!
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমাদের জোর দাবি, অনতিবিলম্বে দায়ী শিক্ষকদের দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তি বিধান করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলাবিধি অনুয়ায়ী সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে আমরা দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানাই। এ ঘটনা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত একটি গোষ্ঠীর ধারাবাহিক প্রক্রিয়ারই সুপরিকল্পিত প্রয়াস। এ ব্যাপারে আমরা রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট উচ্চ মহলসহ সুশীল সমাজ, মানবাধিকার সংগঠন ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের সহযোগিতা কামনা করছি।

লেখকবৃন্দ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক 

No comments

Powered by Blogger.