সেপটিক ট্যাংক থেকে ‘খুনি’ বন্ধুরাই বের করল নাদিমের লাশ

রাজশাহী মহানগরের একটি ছাত্রাবাসের সেপটিক ট্যাংক থেকে একাদশ শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) হাতে ধরা পড়ে অভিযুক্ত বন্ধুরাই সেপটিক ট্যাংকের ঢাকনা সরিয়ে লাশ বের করে।


খুন হওয়া শিক্ষার্থীর নাম নাদিমুজ্জামান (সাদ)। সে নগরের মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। বাবার নাম আমিনুল ইসলাম, মা নাদিরা বেগম। তাঁরা মহানগরের লক্ষ্মীপুর এলাকার প্যারামেডিকেল সড়কের একটি বাসায় থাকেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রোহনপুরে।
নাদিমুজ্জামান খুনের ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলো: চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর গ্রামের মাসুদ ইবনে আলী (শাওন), রাজশাহী নগরের রামচন্দ্রপুর-বাশার সড়ক এলাকার রাশিদুল ইসলাম (বিপু) ও নগরের টিকাপাড়ার কায়ছার আহমেদ (অনিক)। অভিযুক্তরা সবাই নগরের বরেন্দ্র মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ২০১২ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থী।
এর আগে গত ২২ এপ্রিল রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ক্যানটিনের পেছনের নালা থেকে একইভাবে হত্যা করে পুঁতে রাখা মাহবুবুল আলম (রাসেল) নামের এক তরুণের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী তাঁর দুই বন্ধু জ্যোতির্ময় সরকার ও সাব্বির হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। এদের মধ্যে জ্যোতির্ময় গ্রেপ্তার হয়েছেন। সাব্বির উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৭ জানুয়ারি রাত আটটার দিকে বন্ধুরা ফোন করে নাদিমুজ্জামানকে ডেকে নেয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তার ফোন থেকে মায়ের কাছে ফোন আসে। এতে বন্ধু পরিচয় দিয়ে একজন জানায়, নাদিমুজ্জামান কাল সকালে বাসায় ফিরবে। সকালেও ছেলে না ফেরায় বাবা-মা বিচলিত হয়ে পড়েন। ১৯ জানুয়ারি বাবা আমিনুল ইসলাম নগরের রাজপাড়া থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। গত সোমবার তিনি অপহরণ মামলা করেন।
র‌্যাব-৫-এর একটি সূত্র জানায়, ১৮ জানুয়ারি ভোরে নাদিমুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। সারা দিন কাঁথা, কম্বল ও চাদর দিয়ে লাশ জড়িয়ে রাখা হয়। সন্ধ্যার পরে লাশ সেপটিক ট্যাংকে ঢুকিয়ে ঢাকনা লাগিয়ে তার ওপর বালি রাখা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনের বরাত দিয়ে র‌্যাব আরও জানায়, অভিযুক্ত পাঁচজন বন্ধু মিলে এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। তারা হলো বরেন্দ্র মহাবিদ্যালয়ের ২০১২ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থী কায়সার আহমেদ, মাসুদ ইবনে আলী, রাশিদুল ইসলাম, সুইট ও কোয়েল।
সূত্র জানায়, সুইট ও কোয়েলের বাড়িও গোমস্তাপুরের রোহনপুর গ্রামে। একসময় নাদিমুজ্জামানসহ অভিযুক্তরা সবাই রোহনপুরের স্কুলে একসঙ্গে পড়াশোনা করত। সুইট ও কোয়েল মাস খানেক আগে মহানগরের শিরোইল মঠপুকুর এলাকার ৫১৫ নম্বর বাড়ির নিচতলা ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করে। এ বাড়ির সেপটিক ট্যাংক থেকেই নাদিমুজ্জামানের লাশ উদ্ধার করা হয়। ছাত্রাবাস থেকে রক্তমাখা চাদর, একটি লাঠি ও বেশ কিছু আলামতও জব্দ করা হয়।
বাড়িটির মালিক মাহমুদা বেগম দোতলায় থাকেন। মাহমুদা জানান, ঘটনার দিন তাঁরা বগুড়ায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে নিচতলায় তালা লাগানো দেখতে পান।
র‌্যাব-৫ জানায়, গতকাল বিকেল পৌনে চারটার দিকে র‌্যাবের গাড়িতে করে রাশিদুল, কায়ছার ও মাসুদকে ৫১৫ নম্বর বাড়ির সামনে আনা হয়। কায়ছার ও মাসুদকে লাশ বের করতে বলা হলে তারা সেপটিক ট্যাংকের ওপরের বালু সরিয়ে ঢাকনা ওঠাতেই ভেতরে কাঁথায় জড়ানো নাদিমুজ্জামানের মাথা বেরিয়ে আসে। এ সময় চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, লাশ উদ্ধারের পর কায়ছার ও মাসুদকে র‌্যাবের গাড়িতে ওঠানোর সময় নাদিমুজ্জামানের ক্ষুব্ধ স্বজনেরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। র‌্যাব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনে। এ সময় নাদিমুজ্জামানের স্বজনেরা বারবার মহানগরের রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোকাররম হোসেনকে গালি দিতে থাকেন। চাচা ওয়াসিম রেজা বলেন, তাঁরা মুঠোফোনের কল লিস্টের সূত্র অনুযায়ী রাশিদুলকে ধরার জন্য ওসিকে বারবার অনুরোধ করেছেন। ওসি পাত্তা দেননি।
ওয়াসিম রেজা বলেন, তাঁরা হন্যে হয়ে ছেলেকে খুেঁজ বেড়াচ্ছেন বুঝতে পেরে খুনিরা একটি মেয়েকে দিয়ে বাসায় ফোন করায়। মেয়েটি ফোনে জানায়, সে নাদিমুজ্জামানের স্ত্রী। তারা বিয়ে করেছে। ভালো আছে।
র‌্যাব-৫-এর সহকারী পরিচালক লেফটেন্যান্ট নূর মোহাম্মদ জানান, তাঁরা গত সোমবার নাদিমুজ্জামানের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আসামিরা ওই রাতে এ বাসায় নাদিমুজ্জামানকে গাঁজা, ফেনসিডিল ও কোমল পানীয় পান করিয়ে দুর্বল করে। পরে হত্যা করে।’ তিনি জানান, খুনিরা হয়তো মুক্তিপণ আদায় করতে চেয়েছিল। কিন্তু অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারায় হত্যা করেছে। নূর মোহাম্মদ আরও জানান, গত মঙ্গলবার রাতে প্রথমে রাশিদুলকে আটক করা হয়। পরে মাসুদ ও কায়ছারকে আটক করা হয়। লাশ উদ্ধারের পর তাদের মহানগরের বোয়ালিয়া থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।
নাদিমুজ্জামানের চাচার অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজপাড়া থানার ওসি মোকাররম হোসেন দাবি করেন, তিনি নাদিমুজ্জামানের স্বজন ও র‌্যাবকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.