পরিবর্তন-যুবশক্তিই হোক তৃতীয় শক্তি by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রতি অনেকেরই আস্থা নেই। কিন্তু নানা কারণে নির্বাচনে জয়লাভ করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই এই দুই দল পালা করে সরকার পরিচালনা করছে। বর্তমানে সরকারের দুর্নীতি, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, অদক্ষতা ও নানামুখী ব্যর্থতার কারণে আগামী নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করতে পারে বলে অনেকেই আলোচনা করছেন। এমনকি আওয়ামীপন্থী অনেক ব্যক্তিও এ ব্যাপারে হতাশ।


বিএনপি-জামায়াত জোট ছাড়া আওয়ামী লীগের মতো বিশাল দল বা মহাজোটকে ভোটে পরাস্ত করার জন্য বিকল্প কোনো শক্তি এ দেশে এখনো তৈরি হয়নি। কাজেই বিএনপিই ভরসা।
কিন্তু বিএনপির অতীত রেকর্ড, বিশেষ করে তাদের সর্বশেষ শাসনামলের রেকর্ড পর্যালোচনা করলে অনেকে বিএনপির প্রতিও আস্থা রাখতে পারছেন না। তাঁদের জামায়াতপ্রীতি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা অনেককে, বিশেষ করে তরুণসমাজকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ভবিষ্যতে যদি বিএনপি সরকার গঠন করে, তাহলে দেশের প্রধান সমস্যাগুলোর কী সমাধান দেবে, সে ব্যাপারে বিএনপি কোনো লিখিত কর্মকৌশলের কথা দেশবাসীকে জানায়নি। বর্তমান সরকারের নানা ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বিএনপি যদি নিজেদের বদলাতে পারে, তাহলে হয়তো তাদের পক্ষে কিছুটা সুশাসন ও দক্ষতার পরিচয় দেওয়া সম্ভব হতে পারে। বিএনপি-জামায়াত জোট নিজেদের কতটা বদলাতে পারবে, তা তারা সরকার গঠন করার পরই শুধু বোঝা যাবে।
আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপিকে বড় সুবিধা করে দিয়েছে। সরকারের দুর্নীতি, ব্যর্থতা ও দলীয়করণ বিএনপিকে ভোটে জিততে বড় রকমের সহায়তা করবে। বিএনপিকে তেমন কিছু অঙ্গীকারও করতে হবে না। মানুষ বর্তমান সরকার থেকে বাঁচার জন্যই বিএনপিকে ভোট দেবে। আওয়ামী লীগ যে এভাবে বিএনপির ‘উপকার’ করবে, তা বিএনপির নেতারা স্বপ্নেও ভাবেননি।
বাংলাদেশের বহু মানুষ আওয়ামী লীগ-বিএনপির এই খেলায় বিরক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে এই দুই দলের সঙ্গে কেউ পেরে উঠছে না। মাঝে মাঝে ‘তৃতীয় শক্তির’ কথা উঠে আসে। কিন্তু সেই তৃতীয় শক্তি গত দুই দশকেও দানা বাঁধতে পারেনি। শুধু কয়েকটি সেমিনার ও কলাম লেখার মধ্যেই তৃতীয় শক্তির জন্য হা-হুতাশ সীমাবদ্ধ।
গত ২৯ অক্টোবর ঢাকায় ‘প্রগতিশীল শক্তির জাতীয় কনভেনশন’ নামে এক সেমিনারে আবার তৃতীয় শক্তি গড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। সভায় বক্তারা বলেছেন, বর্তমান সরকার বিগত দুই বছরে মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। দেশের এই পরিস্থিতিতে তৃতীয় শক্তি গঠনের বিকল্প নেই। বক্তারা দেশের সব বামপন্থী, প্রগতিশীল, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে একজোট হয়ে একটি উদার, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। (ইত্তেফাক, ৩০ অক্টোবর)
এ রকম আহ্বান নতুন কিছু নয়। মাঝেমধ্যেই বামপন্থী, অবসরপ্রাপ্ত নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা সভা-সেমিনারে এ রকম আহ্বান জানান। এসব আহ্বানের কোনো মূল্য আছে বলে আমার মনে হয় না। যদি মূল্য থাকত, তাহলে গত দুই দশকে এই লক্ষ্যে কিছু না কিছু কাজ হতো। দুঃখের বিষয়, তেমন কোনো কাজ হয়নি। বড় দুই দলের বাইরে যেসব নেতা রাজনীতির মাঠে রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র ড. কামাল হোসেন ছাড়া আর কারও প্রতি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে বলে আমার মনে হয় না। বাকিরা সবাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পকেট-নেতা ও অতীত রোমন্থনকারী। রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু মহাজোটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সম্ভাব্য তৃতীয় শক্তির কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। আর নেতা কোথায়? শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াও সূচনাতে বড় নেতা ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের আছে পারিবারিক ক্যারিশমা। সেটাই তাঁদের প্রধান মূলধন। তা ছাড়া দুই বড় দল তাঁদের ব্যাক করেছে। ৫০ শতাংশ পিতা বা স্বামীর উত্তরাধিকার, ৫০ শতাংশ বড় দলের ব্যাকিং, ইজিক্যাল টু বড় নেতা। পরে প্রধানমন্ত্রী। এত সহজ অঙ্ক তো অন্য নেতাদের বা সামাজিক ব্যক্তিত্বদের কপালে জোটেনি। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এখন এই অঙ্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে পারিবারিক উত্তরাধিকার হিসেবে এখনই দু-তিন প্রজন্ম লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। দুই দলের বহু নেতা এই উত্তরাধিকারদের বরণ করার জন্য প্রস্তুত। তৃতীয় শক্তির জায়গা কোথায়?
‘প্রগতিশীল শক্তি’ তাদের কনভেনশনে যে ‘তৃতীয় শক্তির’ কথা বলেছে, তা একটা কথার কথা। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। আমার ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে তারা যদি সত্যি সত্যি ‘তৃতীয় শক্তি’ প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং নির্বাচনে জেতাতে পারে, তাহলে আমি আমার বক্তব্য প্রত্যাহার করে তাদের অভিনন্দিত করব। আমি সেই শুভ দিনের প্রতীক্ষায় থাকলাম।
আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটি ‘তৃতীয় শক্তির’ কথা চিন্তা করেছি। এই সুযোগে এটা পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। আমার এই কল্পনার তৃতীয় শক্তিকে আমি ‘যুবশক্তি’ নামে অবহিত করব। আমার চিন্তা হলো, বাংলাদেশে যুবকদের নেতৃত্বে একটি নতুন ধরনের রাজনৈতিক দল সৃষ্টি হবে। ২০১২ সালেই এর সূচনা হতে পারে সমমনা যুবকদের গ্রুপ গঠনের মাধ্যমে। ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী যুবকেরাই এর সদস্য হবেন। প্রবাসেও এর সদস্য সংগ্রহ করা হবে। যুবকদের এই গ্রুপ প্রতি মাসে গ্রুপভিত্তিক মিটিং করবে। এই সম্মেলনে তারা আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে বাংলাদেশের ২৫টি জাতীয় সমস্যা, জেলাভিত্তিক (জেলা গ্রুপ) ২৫টি স্থানীয় সমস্যা ও এর সমাধান চিহ্নিত এবং লিপিবদ্ধ করবে। প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণেরাও ই-মেইল, ফেসবুক, ব্লগ ও স্কাইপের মাধ্যমে এসব গ্রুপ আলোচনায় অংশ নেবেন ও মতামত দেবেন। এভাবে দুই বছর আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে তাঁরা দেশের জাতীয় ও স্থানীয় সমস্যা চিহ্নিত এবং সমাধানের প্রস্তাব করবেন।
এই ‘যুবশক্তি’ তাদের পছন্দমতো (ভোটের মাধ্যমে) একটি ‘জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন’ করবে। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত (বা সাবেক) ব্যক্তি এই উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পাবেন না। সব টেকনিক্যাল, অভিজ্ঞ ও পেশাদার ব্যক্তি এই উপদেষ্টা পরিষদে থাকবেন। যুবশক্তি তাদের প্রস্তাবিত সমস্যা ও সমাধান নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে ইস্যুভিত্তিক মতবিনিময় করবে। প্রবাসী বাংলাদেশি কিছু বিশেষজ্ঞও এই পরিষদে থাকবেন। উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর তাঁরা এই কর্মসূচি চূড়ান্ত করবেন। এবং এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় কনভেনশন ও অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য আহ্বায়ক কমিটি গঠন করবেন। আহ্বায়ক কমিটি পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে দলের গঠনতন্ত্র রচনা করবে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় ও জেলা কমিটি গঠন করা হবে।
আগামী সংসদ নির্বাচন এই দলের লক্ষ্য হবে না। এর পরের সংসদ নির্বাচনই এই দলের লক্ষ্য হবে। তবে আমার অনুমান, সেই নির্বাচনে এই দলের অনেকে জিতলেও সরকার গঠন করার মতো সিট পাবে না। সে ক্ষেত্রে তার পরের নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি তাদের থাকতে হবে। তখন এই দলের নেতাদের অনেকের বয়স ৪৫ থেকে ৫৫-এর মধ্যে থাকবে। উদ্যোক্তা তরুণদের জন্য বয়স কোনো বাধা হবে না। তবে প্রাথমিক সদস্য হওয়ার জন্য ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সের সীমা কড়াকড়িভাবে মানতে হবে। এটা তরুণদের দল। যুবশক্তি।
বর্তমানের দূষিত রাজনীতির কোনো যুব বা ছাত্রসংগঠনের সদস্য এই যুবশক্তির সদস্য হতে পারবেন না। তাঁদের উপস্থিতি ও প্রভাব নতুন দলকে কলুষিত করতে পারে। মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের (চার ফার্স্ট ক্লাস) বিভিন্ন কমিটিতে রাখার ব্যাপারে গঠনতন্ত্রে বিশেষ ধারা রাখতে হবে।
এই ‘যুবশক্তি’ বছরব্যাপী নানা গঠনমূলক কর্মসূচি পালন করবে। হরতাল, মিছিল কখনো তাদের কর্মসূচি হবে না। নির্বাচনের সময় ছাড়া কখনো জনসভা করবে না। টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রের মাধ্যমেই তাদের বক্তব্য প্রচার করা হবে। সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীদের চাঁদা দিয়েই দল পরিচালিত হবে। দলের প্রত্যেক সদস্যকে ‘স্বেচ্ছাসেবী’ মনোভাবের অধিকারী হতে হবে।
যুবক ও তরুণেরাই এ দেশের ভবিষ্যৎ। এ দেশকে রক্ষা করার জন্য তাঁদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। ‘বড় দুই দল বা দুই নেত্রীর কাছে দেশ জিম্মি হয়ে আছে’—এসব হা-হুতাশ করে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। দুই নেত্রীর উত্তরাধিকারীরাও তৈরি হচ্ছেন। কাজেই তাঁদের হাত থেকে সহসা মুক্তি নেই। একমাত্র বড় মাপের সংগঠন করে ভোটের লড়াইয়ে দূষিত ও পারিবারিক রাজনীতিকে পরাস্ত করতে হবে। এই দুই দল ও দুই নেত্রী রাজনীতিতে প্রকৃত গণতন্ত্র ও গুণগত পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু ভোট তাঁদের প্রধান সহায়। সেই ভোটে ভাগ বসাতে হবে। আর সেটা করতে পারেন কেবল তরুণেরাই। যদি তাঁরা সংগঠিত হন। একটা আধুনিক, উন্নত, প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ গঠন করতে পারেন তরুণ ও শিক্ষিত নেতৃত্ব। দেশের উপযুক্ত ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ নিয়ে তাঁরাই সরকার পরিচালনা করতে পারেন। আমি মনে করি, কেবল এভাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা সম্ভব।
সেমিনার করে যাঁরা ‘তৃতীয় শক্তি’র কথা বলছেন, তা কথার কথা মাত্র। পাঁচ বছর আগেও এই সেমিনার হয়েছে, পাঁচ বছর পর আবার একই সেমিনার হবে। ‘তৃতীয় শক্তি’ কিন্তু হয়নি। হওয়ার সম্ভাবনাও আমি দেখি না।
ভিন্ন কোনো গণতান্ত্রিক পথের কথা সবাইকে ভাবতে হবে। আমি একটা পথের কথা বলেছি। এর চেয়েও লাগসই ও বাস্তবসম্মত পথের কথাও কেউ বলতে পারেন। বিশেষ করে তরুণদের এই আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য আমি আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। দুই দলের ব্যর্থতা নিয়ে হা-হুতাশ করে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। সুচিন্তিত প্রস্তাব দিন—মুক্তি কোন পথে?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.