মধ্যপ্রাচ্য-গাদ্দাফি হত্যাকাণ্ড, সিরিয়ার চোখে by রবার্ট ফিস্ক

গাদ্দাফি খুন হওয়ার দুই দিন আগে বৈরুতে বেশির ভাগ কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় অবিস্মরণীয় এক সংবাদ দেখলাম। গাদ্দাফি যখন সির্তে লুকিয়ে ছিলেন, সেই সময়টায় খোদ লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে দাঁড়িয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, ‘আশা করছি, দ্রুতই তাঁকে ধরা যাবে এবং হত্যা করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যাতে আপনারা আর তাঁর ভয়ে ভীত না হন।


’ খুবই বিরল বিবৃতি বিধায় আমি সংবাদটা কেটে রাখলাম, ‘দ্রুতই তাঁকে ধরা যাবে এবং হত্যা করা হবে।’ তারপর ন্যাটো তাঁর পলায়মান গাড়িবহরে বোমা ফেলল এবং বৃদ্ধ বালককে আহত অবস্থায় নর্দমার পাইপের ভেতর থেকে ধরে যা করার করা হলো।
এমন এক যুগে, যে যুগে যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবে শত্রুনিধন করে চলেছে, সে সময় হিলারি ক্লিনটনের এই উক্তি লক্ষণীয়। অবশেষে তারা সত্য স্বীকার করল। প্রায়ই আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তর অথবা হোয়াইট হাউস থেকে বাখোয়াজি করা হয় যে কীভাবে তারা গাদ্দাফি বা বিন লাদেন বা অমুক-তমুককে ‘বিচারের মুখোমুখি’ করবে। তখনো আমরা জানি যে এর মানে কী। ব্যক্তিগতভাবে সাধু ওবামাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, কেউ এমন পরিণতি চায় না, কিন্তু গাদ্দাফির মৃত্যু দুনিয়ার ‘সব স্বৈরশাসকের জন্য একটা শিক্ষা’। এবং আমরা জানি যে তিনি কী বুঝিয়েছেন। মূলত এটা বলা হয়েছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের উদ্দেশে।
অতএব, আমি হাজির হলাম দামেস্কে এবং সিরীয়দের জিজ্ঞেস করলাম, পুরো ব্যাপারটা নিয়ে তারা কী ভাবছে। আমি যখন বললাম যে গাদ্দাফি বাতিকগ্রস্ত মানুষ, তারা পুরোদমে একমত হলো। কিন্তু সরাসরি সিরীয় নেতৃত্বের হয়ে কাজ করেন এমন এক খুবই উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা কিছুটা ভিন্ন সুরে জবাব দিলেন, ‘আমরা কোনো তুলনা করা পছন্দ করি না।’ কিন্তু গাদ্দাফি হত্যাকাণ্ডের গুরুতর দিকটা এই যে, ভবিষ্যতে পাশ্চাত্য বলতে থাকবে: ‘দেখো, লিবীয়দের এ কেমন আচরণ! দেখো, আরবরা কেমন! দেখো, মুসলিমরা কী করে!’ এটাকে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। এটা গাদ্দাফির জন্য যতটা না, তার থেকে বেশি অপমানকর লিবীয়দের জন্য। সে জন্যই আমার ভয়, ভবিষ্যতে এই ঘটনাকে আমাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। এটাই আমার মূল দুশ্চিন্তা।
এ সপ্তাহেই সিরীয় টেলিভিশনে আমি বললাম যে গাদ্দাফি উন্মত্ত ছিলেন এবং—আর যা-ই ভাবুন না কেন—আসাদ তা নন। (স্বাভাবিকভাবেই) উপস্থাপক সোৎসাহে একমত হলেন। এর কিছু পরে যে সাংবাদিক আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, তাঁকে একটু ঝাড়লাম। হায় হায়, তিনি বললেন, তিনি ভেবেছিলেন শনিবারের রাতে প্রচারিতব্য ওই অনুষ্ঠানের সাবটাইটেল ও অনুবাদ করানো যায়নি, তাই হয়তো দেখানো যায়নি। হয়তো তিনি আবার আমার সাক্ষাৎকার নেবেন।
আরেকটি ঘটনায় সিরীয় ফার্স্ট লেডির ব্যক্তিগত সহকারী জানিয়েছেন, ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার একটি সংবাদে বাশার আল-আসাদের স্ত্রী কতটা ‘মর্মাহত’ হয়েছেন। কয়েক সপ্তাহ আগে প্রকাশিত ওই সংবাদে জানানো হয়েছিল, সিরীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে নাকি ফার্স্ট লেডি ‘নীরব’ থাকেন। সেই খবরে দামেস্কের এক সাহায্য-কর্মকর্তার বরাত দেওয়া হয়েছিল; তিনি ফার্স্ট লেডির সঙ্গে সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে যখন তাঁকে হতাহতদের বিষয়ে বলা হয়, তখন ‘কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি’।
বলা বাহুল্য, আরব মিডিয়া খবরটি গোগ্রাসে তুলে নেয়, এর মধ্যে আসাদের চক্ষুশূল আল-জাজিরাও আছে। আর এখন সিরীয় আরব রেড ক্রিসেন্টের (সার্ক) সঙ্গে সেই বৈঠকের আরবি বিবরণ আমাকে দিলেন আসমা আল-আসাদের ব্যক্তিগত সহকারী। সেটা পড়া খুব দারুণ অভিজ্ঞতা। সার্কের স্বেচ্ছাসেবীরা আসমাকে বলেন যে সিরিয়াজুড়ে চেকপয়েন্টগুলোতে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে তারা ভালো আচরণ পেয়েছে, কারণ ‘তাদের নির্দিষ্ট নেতৃত্ব ছিল’। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থা ‘মুহাবাররাত’-এর নির্দিষ্ট নেতৃত্ব বা নীতি আছে বলে মনে হয়নি তাদের কাছে। তা ছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যানবাহনের অপব্যবহারও হয়েছে তাদের দ্বারা। ‘তাদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এবং এর জন্য নাগরিকদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হয়েছে।’ মিসেস আসাদকে বলা হয় সার্কের পক্ষে বিপজ্জনক এলাকায় কাজ করা এবং আহতদের নিয়ে আসা কতটা কঠিন কাজ।
সার্কের প্রতিবেদন বলছে, ‘মিসেস আসমা আমাদের কর্মীদের সমস্যাগুলো বুঝলেন বলে পরিষ্কারভাবে মনে হলো।’ এবং ‘মানবতা ও ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য সার্ক-কর্মীদের সেবামূলক প্রচেষ্টার সঙ্গে তিনি একাত্মতাও বোধ করেন...একই সঙ্গে তিনি তাঁদের কিছু কিছু দাবিকে কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিলেন।’ মিসেস আসাদের ওই সাক্ষাৎকারটি ছিল ‘অনানুষ্ঠানিক’ এবং আলোচনাটি হয়েছিল ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ মনোভাবে।
সেই দিনের পরে সার্ক প্রতিবেদন বলছে, নিরাপত্তা চৌকিগুলোতে সার্ক-কর্মীদের প্রতি আচরণের উন্নতি দেখা গেছে। এর পরপরই সাপ্তাহিক সিরিয়াতে মিসেস আসাদকে উদ্ধৃত করে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি রেড ক্রিসেন্টের কর্মীদের বলেছেন যে তাঁরা যেন ‘এই সময়টাতে অবশ্যই নিরপেক্ষ ও স্বাধীন থাকেন, এবং বিশেষ করে মানবিক প্রয়োজনগুলোতে মনোযোগী হন।’
সুতরাং বলা যায় না যে ফার্স্ট লেডি নির্বিকার ছিলেন। তিনি সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর কণ্ঠ থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কোনো নিন্দাবাদ উচ্চারিত হয়নি। অবশ্যই আসমা আল-আসাদের সমস্যা আমি দেখতে পাচ্ছি। যদি তিনি বেসামরিক নাগরিক হত্যার প্রতিবাদ করেন, তাহলে দুনিয়ার সংবাদপত্র ও টেলিভিশনগুলো অবশ্যই বলবে না যে মিসেস আসাদ মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তাদের বিরাট শিরোনামগুলো হবে রাজনৈতিক এবং সেখানে হয়তো লেখা থাকবে: ‘স্ত্রীর আক্রমণের মুখে সিরীয় প্রেসিডেন্ট’। আমার ভয় এটাই যে যুদ্ধের সময় সবার আগে সত্য পরাজিত হয়। তাই আপনি জিতবেন না, এমনকি যদি হন কোনো প্রেসিডেন্টের স্ত্রী।
ব্রিটিনের দি ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক, মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.