চিকিৎসাসেবা-স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিএমডিসির ভূমিকা by এ কে আজাদ খান ও ফরিদ কবির

বাংলাদেশে চিকিৎসাব্যবস্থায় বেশ উন্নতি হলেও চিকিৎসকদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার উন্নতি বেশিঘটেনি। এর প্রমাণ, চিকিৎসাধীন কেউ মারা গেলে কখনো কখনো দেখা যায় যে রোগীর ক্ষুব্ধ আত্মীয়স্বজন হাসপাতালে ভাঙচুর করেন, অনেকে চিকিৎসককে শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত করেন, অনেককে চিকিৎসক বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করতেও দেখা যায়।


এ ধরনের ঘটনা তখনই ঘটে, যখন রোগীর আত্মীয়স্বজনের মনে ধারণা জন্মায় যে চিকিৎসক চিকিৎসায় যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন না। উন্নত বিশ্বে হাসপাতালে বা চিকিৎসাকেন্দ্রে এ ধরনের ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে না। রোগীর স্বজনেরা যদি মনে করেন, চিকিৎসায় কোনো রকম অবহেলা হয়েছে বা রোগীকে ভুল চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, তবে তাঁরা চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ‘ল অব টর্ট’-এর অধীন এই মামলায় চিকিৎসায় কোনো অনিচ্ছাকৃত ভুল প্রমাণিত হলে চিকিৎসকেরা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হন। উন্নত বিশ্বে চিকিৎসকদের ইনস্যুরেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। এ কারণে সেখানে চিকিৎসকদের ফি বা চিকিৎসা খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি।
বাংলাদেশে অধিকাংশ চিকিৎসকই চিকিৎসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রোগীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ করেন না, যে কারণে ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ থেকে যায়। চিকিৎসাকালে কোনো রোগী মারা গেলে আত্মীয়স্বজন কখনো কখনো ধরে নেন, চিকিৎসক বা সেবিকারা হয়তো সঠিকভাবে চিকিৎসা দেননি অথবা চিকিৎসায় অবহেলা করেছেন! উন্নত দেশগুলোতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যে রোগীর মৃত্যু হয় না, তা নয়। কিন্তু যেসব চিকিৎসক রোগীর চিকিৎসা আন্তরিকভাবে করেন এবং রোগীর আত্মীয়স্বজনকেও চিকিৎসার ব্যাপারে খোলাখুলি জানান, সেসব ক্ষেত্রে বরং মৃতের আত্মীয়স্বজনকে বলতে শোনা যায়, রোগী মারা গেলেও চিকিৎসক চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি! চিকিৎসকেরাও মানুষ। তাঁদেরও ভুলত্রুটি ঘটতে পারে। কিন্তু অবহেলার ঘটনা কেন ঘটবে!
আইনের প্রতি যখন মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে, তখন মানুষের মধ্যে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। কিন্তু এমন ঘটনা আমাদের কারোরই কাম্য নয়। চিকিৎসা একটি মহান পেশা। এই পেশার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও আস্থা ফিরিয়ে আনার নৈতিক দায়িত্বটা তাই নিতে হবে চিকিৎসকদেরই। তবে এই দায়িত্ব যে সংগঠনটির ওপর আইনত ন্যস্ত, তার নাম ‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল’, সংক্ষেপে বিএমডিসি।
বাংলাদেশে মেডিকেল ও ডেন্টাল ইনস্টিটিউশনগুলোর মান পর্যালোচনার মাধ্যমে এগুলোকে সনদ প্রদান অথবা প্রয়োজনে প্রদত্ত সনদ বাতিলের পাশাপাশি বিএমডিসির উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে—মেডিকেল বা ডেন্টাল কলেজ থেকে পাস করার পর চিকিৎসকদের যোগ্যতা বিচার করে নিবন্ধন দেওয়া, রোগীর সঙ্গে অসদাচরণকারী, অবৈধভাবে আর্থিক সুবিধা গ্রহণকারী অথবা ভুয়া পদবি বা ডিগ্রি ব্যবহারকারী চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া ইত্যাদি।
গত কয়েক দশকে এ দেশে মূল্যবোধের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। চিকিৎসকেরাও এর বাইরে নন। কিন্তু অন্য শ্রেণী-পেশার মানুষের যতটুকু জবাবদিহি আছে, চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে তা তেমন একটা দেখা যায় না। চিকিৎসকেরা ভুল বা অন্যায় করতে পারেন না, তা নয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ভুলের জন্য বা কোনো অন্যায় কাজের জন্য কোনো চিকিৎসকের সাজা বা নিদেনপক্ষে সনদ বাতিলের কথাও আমরা শুনিনি।
বিএমডিসি চিকিৎসকদের কোনো অ্যাসোসিয়েশন বা ইউনিয়ন নয় যে তারা চিকিৎসকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। কিন্তু এই সংস্থা গঠিত হওয়ার পর আজ পর্যন্ত উপরিউক্ত কোনো কারণে কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে তারা কোনো আইনগত বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বলে শোনা যায়নি। অথচ এটা তাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। তাহলে কি আমরা ধরে নেব, আজ পর্যন্ত কোনো চিকিৎসক কোনো রোগীর সঙ্গে অসদাচরণ (মিস-কনডাক্ট) করেননি? তাঁরা কোনো ভুল বা অন্যায় করেননি? অনেক চিকিৎসক ভুয়া পদবি বা ডিগ্রি ব্যবহার করলেও আমরা বিএমডিসিকে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কখনো কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি। আইন থাকা সত্ত্বেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হলে অপরাধ বাড়বে বৈ কমবে না। যেসব ক্ষেত্রে বিএমডিসির সক্রিয় ভূমিকা রাখার কথা ছিল, সেসব ক্ষেত্রে আমরা বিএমডিসিকে নীরব থাকতেই দেখেছি। এতে করে বিএমডিসির মর্যাদা বাড়েনি, বরং কমেছে।
কোনো শ্রেণী-পেশার লোক যদি দেখেন যে তাঁকে কারোর কাছে জবাবদিহি করতে হয় না, তখন সেই শ্রেণী-পেশার কারও কারও মধ্যে অপরাধপ্রবণতা জেগে ওঠা অস্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন বা বিএমএ নামে চিকিৎসকদের একটি সংগঠন আছে। অনৈতিক কোনো কাজ (আনএথিক্যাল প্র্যাকটিস) কোনো চিকিৎসক করলে তাঁর সদস্যপদ বাতিলের ক্ষমতা বিএমএর আছে। কিন্তু বিএমএরও এমন কোনো কর্মকাণ্ড আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি।
সম্প্রতি কিডনি ও লিভার বেচাকেনা নিয়ে বিভিন্ন কাগজে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত এক ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ঘটনায় কোনো কোনো চিকিৎসকও জড়িত। এসব প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত জড়িত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের কথা হচ্ছে, আদালতকে কেন বিএমডিসির প্রতি নির্দেশ দিতে হবে? কোনো চিকিৎসক এ ধরনের হীন কাজে জড়িত থাকলে বিএমডিসি তো নিজে থেকেই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। অন্তত তারা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল করতে পারে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আমরা শুনিনি। নিলে বিএমডিসির মর্যাদা বাড়ত বৈ কমত না।
অতীতে যা-ই ঘটুক, এখন থেকে বিএমডিসি তার কার্যকর ভূমিকা পালন করুক। শুধু মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সনদ দেওয়া বা চিকিৎসকদের নিবন্ধন দেওয়ার মধ্যেই যেন তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সীমাবদ্ধ না থাকে। দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং এই সংস্থার মর্যাদার জন্যও তাদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করা দরকার।
অধ্যাপক এ কে আজাদ খান: চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও সমাজকর্মী। সভাপতি, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি।
ফরিদ কবির: কবি ও প্রাবন্ধিক। যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি।

No comments

Powered by Blogger.