আইএমএফের খবরদারি-কবে ছিন্ন হবে এই শর্তের জাল?

দাতা সংস্থার শর্তের জাল থেকে বেরিয়ে আসা যাচ্ছে না। দাতাদের শর্ত পূরণের চাপ সরাসরি গিয়ে পড়ছে জনগণের ওপর। একদিকে যেমন সরকারকে বাধ্য হয়েই এই চাপ দিতে হচ্ছে, তেমনি জনগণকেও মেনে নিতে হচ্ছে এই চাপ। তবে শর্তের চাপাচাপির আসল খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকেই।


বাংলাদেশকে যতই উন্নয়নশীল কিংবা উন্নয়নগামী দেশ বলা হোক না কেন, মূলত দেশটি বিদেশি সাহায্যনির্ভর। এই সাহায্য আসে ঋণ আকারেও। কিন্তু এই ঋণ নেওয়ার জন্যও সরকারকে অনেক শর্ত পূরণ করতে হয়। শর্ত পূরণ করা অনেকটাই ঋণ নেওয়ার প্রাক-যোগ্যতার মতোই। শর্ত মানলেই প্রাক-যোগ্যতা অর্জন করা যায়। শর্ত না মানা হলে প্রতিশ্রুত ঋণের অর্থ অনেক সময় পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলো দাতা সংস্থার শর্ত পূরণে তাই সব সময় সচেষ্ট থাকে। বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে এমনই একটি অর্থসাহায্য পাবে এমন কথা ছিল, যাকে বলে ইসিএফ বা বর্ধিত ঋণসহায়তা। টাকার পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। এই অর্থের ব্যবহার নিয়ে দাতা-গ্রহীতা, অর্থাৎ আইএমএফ ও বাংলাদেশের মধ্যে শুরু থেকেই মতপার্থক্য ছিল। আইএমএফ চেয়েছিল, বাজেট সহায়তা হিসেবে এই অর্থ ব্যয় করা হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ চেয়েছিল, অর্থ ব্যয় হবে লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য। শর্ত ছিল, এই অর্থ পেতে হলে বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে রাখতে হবে, কর আইন করতে হবে, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করতে হবে, ভর্তুকি কমাতে হবে। আইএমএফ প্রতিশ্রুত সেই অর্থ এখনো ছাড় হয়নি। এখন সেই অর্থ ছাড় করাতে গেলে বাংলাদেশকে ভর্তুকি কমাতে হবে। তার ফল অনিবার্যভাবেই পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। ভর্তুকি কমাতে গেলে বেড়ে যাবে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম। বাড়তি দামের চাপ পরিশোধ করতে হবে সাধারণ মানুষ তথা ভোক্তাকেই। অর্থমন্ত্রী যদিও জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের কোনো প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে না বলে জানিয়েছেন। সুষ্ঠু অর্থ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি রোধ করা সম্ভব হবে_এমন অভয়ও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁর এই অভয়বাণীতে নিশ্চিত হওয়া হওয়া যায়_আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা কি সে নিশ্চয়তা দিচ্ছে? এর পাশাপাশি রয়েছে ভোগের নিশ্চয়তার বিষয়টিও। দাম বাড়লেও ভোক্তা পর্যায়ে এটা কি নিশ্চিত করা যাবে? নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ যেমন নিশ্চিত করা যাবে না, তেমনি সৃষ্টি করা যাবে না জ্বালানির নিশ্চয়তাও_যদিও এটা দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
আইএমএফের শর্ত পূরণের এই বাধ্যবাধকতা থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছি না। এমনকি বিদেশি ঋণ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমাদের স্বাধীনতা নেই। দাতাদের ইচ্ছার প্রতিফলন না ঘটলে ঋণের অর্থ ছাড় করতেও তাদের আপত্তি। এ অবস্থায় পরনির্ভরশীলতা কমানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু পরনির্ভরশীলতা সহজে এবং চটজলদি কমানো যায় না। এর জন্য প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। শর্তের জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসা কবে সম্ভব হবে? আদৌ হবে কি?

No comments

Powered by Blogger.