লিবিয়া : যুদ্ধে হতাহতদের সঠিক পরিসংখ্যান নেওয়া উচিত by জনাথন স্টিল

বিজয়ের কাছাকাছি সময়ে গত বৃহস্পতিবার ক্যামেরন ও সারকোজির ত্রিপোলি সফর ছিল খুবই আনন্দদায়ক। সেখানকার শাসক বদলের লড়াইয়ে গত ছয় মাসে ন্যাটো বাহিনীর একজন সেনাও মারা যায়নি। স্বাভাবিক কারণেই বিজয়ের উল্লাস ছিল ব্যাপক। কিন্তু এই দুই ইউরোপীয় নেতা নিশ্চয়ই বুশ প্রশাসনের ইরাক ও আফগানিস্তান মিশনের কথা ভুলে যাননি। তাঁদের উপদেষ্টারাও নিশ্চয়ই তাঁদের সাবধান করে দিয়েছিলেন।


নিশ্চয়ই বলেছিলেন, এই স্বাধীনতাও কিন্তু স্বল্পকালীন হয়ে যেতে পারে। এমনকি সাদ্দাম হোসেন-পরবর্তী বাগদাদে যেমন বেশুমার লুটপাট হয়েছিল, মুয়াম্মার গাদ্দাফি-পরবর্তী ত্রিপোলিতে কিন্তু তেমন লুটপাট হয়নি। এটা ঠিক, সাবেক শাসকের সমর্থকদের কিন্তু অধিক হারে প্রাণ হারাতে হয়েছে এখানে। ডেভিড ক্যামেরন ও নিকোলা সারকোজি উভয়েই সেখানে নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে নজর দিয়েছেন। উভয়েই সেখানে চিকিৎসাসহায়তা বাড়ানোর ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন। তাঁদের ফিরে যাওয়ার পর নিশ্চয়ই তাঁরা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাপারটি ভালো করে ভাবতে শুরু করেছেন।
তাঁদের সফরের দিনই লন্ডনে আরেকটি উদ্যোগের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। অন্তত তিন ডজন বেসরকারি সাহায্য সংস্থা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার কথা বলেছে। অঙ্ফোর্ড রিসার্চ গ্রুপ সেখানে সশস্ত্র সন্ত্রাসের কারণে যে পরিমাণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার সঠিক তালিকা তৈরি করার কথা বলেছে। আর এ তালিকা থেকে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যই নয়, বেসামরিক জনগণও যেন বাদ না যায়, এই তালিকা যেন গোপনে না করা হয়, প্রত্যেক মানুষ যাতে জানে, সেই ব্যবস্থাও করতে হবে।
হতাহতদের প্রত্যেককে তালিকাভুক্ত করতে হবে। যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র তালিকাও থাকতে হবে। ইরাকে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যে অভিযান পরিচালনা করেছিল, সেই থেকে প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের নাম-ঠিকানা অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য পদ্ধতিতে গণনা করা হচ্ছে। সারায়েভোর গবেষণা ও তথ্যকেন্দ্র এমন একটি তালিকা প্রণয়ন করেছে বসনিয়া যুদ্ধে। তারা নিয়মিত এ তালিকা নবায়ন করেছে। বাড়তে বাড়তে সেই তালিকাভুক্তির সংখ্যা এখন ৯৯ হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। বেলগ্রেড ও প্রিস্টিনার হিউম্যানিটারিয়ান ল সেন্টার কসোভো মেমোরি বুক প্রণয়ন করেছে। বইটিকে অত্যন্ত নিরপেক্ষ জরিপের ফল হিসেবে উল্লেখ করতে হবে। কসোভোয় ১৯৯৮ সালে দুই হাজার ৪৬ জনের প্রাণহানির তথ্য সংযোজিত হয়েছে এ বইয়ে এবং ১৯৯৯ সালের কাজ এগিয়ে চলেছে। এ তালিকায় সাম্প্রদায়িক পরিচিতি পর্যন্ত উল্লেখ থাকছে। আসলে এর উদ্দেশ্য বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা নিয়ে যে বিতর্ক আছে, তা নিরসন করা। এ তালিকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, সেখানে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদেরও একই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে সম্প্রতি যেভাবে সনাতন ধারার বাইরে যুদ্ধ হচ্ছে, তাতে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও বেসামরিক ব্যক্তিদের পৃথক করা কষ্টকর বৈ কি। এটা প্রমাণিত হয় শিশু-কিশোরদের বন্দুকযুদ্ধে অংশ নিতে দেখার পর এবং এটা প্রমাণিত হয় যখন মহিলাদেরও সমানভাবে যুদ্ধে অংশ নিতে দেখা যায়। সিরিয়ায় মানবাধিকার সংগঠন ইনসান ভুক্তভোগীদের তালিকা তৈরি করতে গিয়ে নিজেরাই জীবনের ঝুঁকিতে পড়ে যায়। মার্চ মাসের পর থেকে এ পর্যন্ত তারা তিন হাজার চারজনের তালিকা করতে পেরেছে, যাদের মধ্যে ছিল ৯২ জন বালক আর ৫৬ জন বালিকা। তাদের প্রত্যেককে শরীরের ওপরের অংশে গুলি করা হয়েছে।
স্বজন হারানো পরিবারগুলো যে কিভাবে তাদের প্রিয়জনকে স্মরণ করে, তার একটি প্রমাণ পাওয়া গেছে নিউ ইয়র্কে। তারা নাইন-ইলেভেনে নিহতদের স্মরণে একত্র হয়েছিল। এক দিন ইরাক ও আফগানিস্তানেও লাখ লাখ মানুষ একত্র হবে তাদের প্রিয়জনদের স্মরণ করতে, যারা আমেরিকানদের কারণে জীবন দিতে বাধ্য হয়েছে।
যেসব দেশে বেসরকারিভাবে এ তালিকা প্রণীত হচ্ছে, তারা খুবই ভালো কাজ করছে। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে, এ কাজ করার মূল দায়িত্ব হওয়া উচিত দেশগুলোর সরকারের। তবে এসব ক্ষেত্রে বেসামরিক জনগণের ক্ষয়ক্ষতিও হয় বেশ। তবে লিবিয়ার ব্যাপারে দেখা যায়, সেখানে বেসামরিক জনগণকে রক্ষা করার চেষ্টা প্রয়োজন অনুযায়ী হয়নি। যেহেতু শাসক বদল করাই সেখানে উদ্দেশ্য ছিল, তাই ওখানে বেসামরিক মানুষের প্রাণহানির বিষয়টি ওইভাবে হয়েছে। জাতিসংঘ চেষ্টা করলেও তেমন একটা সফল হয়েছে বলে মনে করা যায় না।
সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, গাদ্দাফি-সমর্থকরা ত্রিপোলিসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পিছু হটার সময় সাধারণ মানুষকেও খুন করে গেছে। অনেকে আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলে মৃত্যুবরণ করেছে বিদ্রোহীদের হাতেও। তাদের মৃত্যু হয়েছে সরাসরি কিংবা নির্যাতনের মাধ্যমে। ইনসানের পরিচালক উইসাম তারিফ বলেছেন, সিরিয়ায় আসাদ-প্রশাসন হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে যত তথ্য আছে, সেগুলো যাতে কেউ জানতে না পারে, সে জন্য সর্বতো চেষ্টা করছে। সেখানে গবেষকদের অপহরণ করে নিয়ে যায়, যাতে কেউ কাজ করতে না পারে। টেলিফোন লাইন কেটে দেয়। ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে তারা। ব্রিটেন ও ফ্রান্স এসব বিষয়ে সুদৃষ্টি দিক_এটাই প্রত্যাশিত।

লেখক : সাংবাদিক
দ্য হিন্দু থেকে ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন

No comments

Powered by Blogger.