জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রশ্নবিদ্ধ চিঠি-যুদ্ধাপরাধের বিচার by রোকেয়া কবীর

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে ৩০ লাখ শহীদ হওয়ার পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালনকারী দেশি-বিদেশি অপরাধীদের বিচার যে স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪০ বছরেও হলো না, সে ব্যাপারে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কোনো উচ্চবাচ্য নেই কেন গত ১৫ জানুয়ারি 'নিজামীদের অবস্থা জানতে চেয়ে সরকারকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের চিঠি' শীর্ষক সংবাদ একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে।


এতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় থেকে 'ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্রেরি ডিটেনশন'-এর নামে ১২ সেপ্টেম্বর জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনপ্রধানের মাধ্যমে ৬০ দিনের মধ্যে ৩৫ দফার সুস্পষ্ট জবাব চেয়ে সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে কমিশন। চিঠিটি বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাত হয়ে বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও বাংলাদেশ পুলিশের কাছে রয়েছে। প্রয়োজনে ওয়ার্কিং গ্রুপকে জানিয়ে এক মাস সময় বাড়িয়ে নেওয়া যাবে বলে চিঠিতে একটি শর্ত যুক্ত ছিল। চিঠিতে উলিল্গখিত ৩৫ দফার মধ্যে রয়েছে তখন পর্যন্ত আটককৃত ৬ যুদ্ধাপরাধীর আটকের কারণ, আইনের ভিত্তি ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন।
সংবাদটি থেকে জানা গেল, আটককৃতদের নিয়োগকৃত আইনজীবীরা জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কাছে যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগ জানিয়ে পিটিশন জমা দেয়, যার ভিত্তিতে কমিশন এই চিঠি দিয়েছে। এটা আমরা বিভিন্ন সময়ে নানা উৎস থেকে শুনেছি ও দেখেছি যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চলমান উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করা, বিচার প্রক্রিয়ায় বাধা দান, এমনকি বিচারের সমুদয় আয়োজন পণ্ড করার জন্য দেশের ভেতরে নানাভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির অপচেষ্টার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক অর্থ বিনিয়োগ করে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও লবিংয়ের কাজ চলছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিং নিয়ে এতদিন ধরে শোনা কথাগুলো যে মোটেই উড়োকথা নয়, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের এই চিঠিটিই তার প্রমাণ। যে চিঠির ভেতর দিয়ে আটককৃত যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি মানবাধিকার কমিশনের একটি উদ্বেগই প্রকাশিত হয়েছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন যে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় অভিযোগ জানানোর জন্য প্রশস্ত ক্ষেত্র, যা সবার জন্যই উন্মুক্ত। সে বিচারে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে এ রকম পিটিশন সেখানে জমা পড়তে পারে না, তা নয়। কাজেই এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে শহীদ ৩০ লাখ নারী-পুরুষ, হেনস্তা ও ধর্ষণের শিকার চার লাখ নারী, এক কোটিরও বেশি মানুষের শরণার্থী হতে হওয়ার বিপরীতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালনকারী দেশি-বিদেশি অপরাধীদের বিচার যে স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪০ বছরেও হলো না, সে ব্যাপারে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কোনো উচ্চবাচ্য নেই কেন? কমিশনের কাছে কি এসব তথ্য নেই? যদি থাকে তাহলে প্রশ্ন জাগে যে, অপরাধীর মানবাধিকারের দেখভাল করার আগেই কি অপরাধের শিকার নারী-পুরুষের মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি কমিশনের কাছে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়ার কথা নয়?
সম্প্রতি জাতিসংঘের হাইকমিশনার বান কি মুন সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের প্রতি তার নিজের দেশের জনগণকে হত্যা করার তৎপরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য জোর দাবি জানিয়েছেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীও এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় নিজ দেশের জনগণকেই হত্যা করেছিল। ওদিকে গত ফেব্রুয়ারিতে তাহরির স্কয়ারে অনুষ্ঠিত বিদ্রোহী মিসরবাসীর এক জমায়েতে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ায় মিসরের স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্টের এখন বিচারকার্য চলছে। প্রায় ৮৫০ জন মানুষকে হত্যার নির্দেশদান ও অন্যান্য অপরাধে তার ফাঁসি পর্যন্ত হতে পারে বলে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এর কয়েক হাজার গুণ বেশি মানুষের মৃত্যুর ঘটনা এবং নানা ভোগান্তির শিকার মানুষের বিচার পাওয়ার দাবি বছরের পর বছর উপেক্ষিত হচ্ছে দেখে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কোনো উদ্বেগ নেই।
এখানে হয়তো বলা হবে যে, কমিশনের উদ্বেগ নির্ভর করে অভিযোগের ভিত্তিতে। যেহেতু অপরাধীদের পক্ষ থেকেই অভিযোগ জমা পড়েছে, কাজেই তারা তাদের পক্ষেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে আমার জিজ্ঞাস্য এই যে, যেহেতু জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন যন্ত্রচালিত নয় বরং মনুষ্যচালিত প্রতিষ্ঠান, কাজেই সংস্থাটির এ ধরনের কার্যকলাপ কি তার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না? সরকারের কাছে কমিশনের জানতে চাওয়ার তালিকায় এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের 'আটকের কারণ' পর্যন্ত যুক্ত হওয়াকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়। ভাবতে হয় যে, যুদ্ধাপরাধীদের আটকের কারণ হয়তো তাদের জানা নেই। কিন্তু এ রকম একটি বড় গণহত্যার ঘটনার তথ্য তাদের কাছে না থাকা রীতিমতো অবিশ্বাস্য।
দরিদ্ররাই মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার বেশি হয়। একাত্তরে হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠন ও অগি্নকাণ্ডের শিকার এবং শরণার্থীর জীবনযাপনে বাধ্য হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সিংহভাগই ছিল দরিদ্র। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারপ্রার্থী হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইন পরিচালনার সামর্থ্য ও সক্ষমতা দরিদ্রদের থাকে না। এই দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের পক্ষে যদি জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে না দাঁড়ায়, তাহলে এই শ্রেণীর মানুষের মানবাধিকারবঞ্চিত হয়েই জীবন অতিবাহিত করতে হবে।
আমরা জানি, আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি ও ছোট-বড় অনেক মানবাধিকার সংগঠন কাজ করে। তার মধ্যে কয়েকটি মাত্র সংগঠন তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করাসহ অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে সহায়তা করছে। কিন্তু মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যারা কর্মরত, তারা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনসহ আন্তর্জাতিক অপপ্রচারের বিষয়ে কী ভূমিকা পালন করছেন, তার কোনো নমুনা আমরা কোথাও দেখছি না। তারা কেন এতদিনেও দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে সহায়তা প্রদানের জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনে কোনো পিটিশন দাখিল করেননি? তাদের কাজ নিশ্চয়ই কেবল প্রকল্প বাস্তবায়ন নয়। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার কার্যকর করায় তাদের ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের জানতে ইচ্ছা করে।

রোকেয়া কবীর, মুক্তিযোদ্ধা ও নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ

No comments

Powered by Blogger.