কালান্তরের কড়চা-বাংলাদেশে ব্যর্থ ক্যু এবং পাকিস্তানে 'সফট ক্যু' by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

বাংলাদেশে যখন একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা হচ্ছিল, তার আগেই পাকিস্তানে একটি সফট ক্যু (Soft coue) ঘটে গেছে। এই সফট ক্যু পাকিস্তানে যারা ঘটিয়েছে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা তাদের জঙ্গি মৌলবাদী অনুসারীরাই দেশের গণবিরোধী রাজনৈতিক চক্রের সহায়তায় বাংলাদেশেও আসল ক্যু ঘটাতে চেয়েছিল। তারা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানে সফট ক্যু ঘটার পরিণতি এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।


ফলে দেশটিকে এখন বলা হচ্ছে deadliest country বা ভয়াবহ মৃত্যুপুরী। পাকিস্তানে এখন একটি নির্বাচিত সরকার আছে। যেমন_ইরাকে এবং আফগানিস্তানে আছে। মার্কিন সেনাদের পাহারায় বাগদাদ, কাবুল এবং ইসলামাবাদের গ্রিন জোনের মধ্যেই তাদের রাজত্ব সীমাবদ্ধ। পাকিস্তানেও প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি 'নামের খসম আজিজ মিসির'। গোটা দেশ চালায় সামরিক বাহিনী এবং তাদের ঘাতক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। পাকিস্তানের বিখ্যাত কূটনীতিক মিলিটারি অ্যান্ড মস্ক্ গ্রন্থের লেখক হোসেইন হাক্কানির স্ত্রী ফারাহ নাজ ইস্পাহানি ওয়াশিংটনে পালিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, �I am scared. The government can't even protect itself.� (আমি আতঙ্কিত। বর্তমান সরকার নিজেকে পর্যন্ত রক্ষা করতে অক্ষম।)
আইএসআইয়ের চক্রান্তে গুপ্তহত্যার শিকার হবেন এই ভয়ে কিছুদিন আগে প্রেসিডেন্ট জারদারি পর্যন্ত বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। অজুহাত দেখিয়েছিলেন, তিনি অসুস্থ হওয়ায় চিকিৎসার জন্য গেছেন। পাকিস্তানে সরব গুজব, তিনি আমেরিকার কাছ থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস পাওয়াতেই দেশে ফিরে এসেছেন।
পাকিস্তানে সফট ক্যু ঘটেছে_এই খবরটা পশ্চিমা পত্রপত্রিকায় এখন প্রায়ই গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হচ্ছে। ২২ জানুয়ারির সানডে টাইমস পত্রিকায় পাকিস্তানে আইএসআই যে হত্যা ও গুপ্তহত্যার তাণ্ডব চালিয়েছে, পৃষ্ঠাব্যাপী সচিত্র বিবরণ ছেপে তার হেডিং দিয়েছে '...Pakistan's soft coue'। 'টাইমস'সহ লন্ডনের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পাকিস্তানে আইএসআইয়ের নির্যাতনের যে খবর ছাপা হচ্ছে, তা পড়লে নাৎসি জার্মানিতে হিটলারের গেস্টাপো, ইরানে শাহের আমলে সাভাক নামের গোয়েন্দা সংস্থা দুটির অত্যাচার ও নির্যাতনের বা চিলিতে পিনোচেটের গুপ্ত গোয়েন্দা সংস্থার বন্দি হত্যা ও বর্বরতার বিবরণের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না।
গত রবিবার 'সানডে টাইমস' ক্রিস্টিয়ানা ল্যাম্বের যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আইএসআই একের পর এক পাকিস্তানি সাংবাদিক হত্যা করে চলেছে। অনেক সাংবাদিক আমেরিকায় পালিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন। পাকিস্তানে তাঁদের আখ্যা দেওয়া হয়েছে 'সিআইএর চর'। আইএসআইয়ের লেটেস্ট ভিকটিম বেতার সাংবাদিক মুকাররাম খান আতিক। গত মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) পেশোয়ারে এক মসজিদে তিনি মাগরিবের নামাজ পড়ছিলেন। দুজন বন্দুকধারী মসজিদে ঢোকে এবং তাঁকে বাইরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এই বেতার সাংবাদিক 'ভয়েস অব আমেরিকার' জন্য কাজ করতেন এবং তাঁর বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। পশ্চিমা কাগজগুলোতে স্পষ্টই বলা হয়েছে, 'it was the latest killing... by the country's military intelligence arm (ISI). (এটা আইএসআইয়ের লেটেস্ট হত্যাকাণ্ড)।
নিউ ইয়র্কের 'কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস' সংস্থা জানিয়েছে, পাকিস্তান থেকে অসংখ্য সাংবাদিক আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন এবং অনেকে পালিয়ে আসছেন। ইতিমধ্যে কত সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা বোঝা যায়, বেলুচিস্তানের একটি অনলাইন সংবাদপত্রের মালিক সিরাজ আকবর গত নভেম্বর মাসে প্রাণভয়ে আমেরিকায় এসে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন।
সিরাজ আকবর জানিয়েছেন, আইএসআইয়ের চরেরা তাঁকে ২৪ ঘণ্টা অনুসরণ করত। তাঁর টেলিফোন টেপ করা হতো। তাঁকে এবং তাঁর ছেলেমেয়েকে হত্যার হুমকি দেওয়া হতো। একদিন তিনি সেলুন থেকে বেরিয়ে আসছেন, সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন বেজে ওঠে এবং অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি তাঁকে টিজ করে বলে, 'বাহ্, সুন্দর চুল কেটেছেন তো।' আকবর বলেছেন, রিপোর্ট যা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি সাংবাদিককে হত্যা করা হচ্ছে। গত বছর কমপক্ষে আমার আটজন সাংবাদিক বন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে।
শিশু অপহরণ, তাদের জিম্মি করে রাখা, কোনো কোনো সময় হত্যা করা আইএসআইয়ের একটি নিষ্ঠুর কৌশল। এক বছর আগে একজন সাংবাদিকের অল্প বয়সী ছেলেকে স্কুল থেকে অপহরণ করে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। সাংবাদিককে বলা হয়েছে, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করা হলে ওই শিশুকে হত্যা করা হবে। তারা তাই এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। আইএসআই ওই শিশুর মাকে রোজ ১০ মিনিটের জন্য দেখতে দেয়।
পাকিস্তানে বিন লাদেন হত্যার পর আইএসআই সেলিম শাহজাদ নামের ৪০ বছর বয়সের এক সাংবাদিককে হত্যা করে। তিনি তিন সন্তানের বাবা। তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ নর্দমায় ফেলে রাখা হয়। তিনি পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে আল-কায়েদার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন।
পাকিস্তানের প্রভাবশালী সংবাদপত্র 'ফ্রাইডে টাইমস'-এর সম্পাদক নিজাম শেঠি, তাঁর স্ত্রী এবং সহযোগী সম্পাদক জুগলু মহসিন গত বছর ওয়াশিংটনে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আইএসআইয়ের বর্বরতা সম্পর্কে ওয়াশিংটনে পেঁৗছে বলেন, 'আগে ভিন্নমত পোষণকারীদের আইএসআই ধরে নিয়ে যেত, কয়েক মাসের জন্য জেলে ঢোকাত, কিছু মারধরও করত। কিন্তু এখন তা আর নেই। যাকে ধরে নেওয়া হয়, তার আর কোনো খোঁজই পাওয়া যায় না। কারো কারো লাশ কিছুদিন পর ড্রেনে পড়ে থাকতে দেখা যায়। বেশির ভাগের লাশই পাওয়া যায় না।'
মাসখানেক আগে এই শেঠিরা লাহোরে ফিরে এসেছেন। আইএসআই থেকে মিডিয়ায় প্রচার চালানো হচ্ছে, নজম শেঠি এবং তাঁর মেয়ে সিআইএয়ের চর। ফ্রাইডে টাইমসের মালিকরা তাঁর বাড়িতেই তাঁর জন্য দুর্ভেদ্য অফিস বানিয়ে দিয়েছেন, যাতে তাঁকে বাইরে বেরোতে না হয়। তাতেও শেঠি পরিবার নিজেদের নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত নয়। তিনি বলেছেন, তিনি স্টেট, নন-স্টেট অ্যাক্টরস এবং এক্সিট্রিমিস্টদের কাছ থেকে আক্রান্ত হতে পারেন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে সর্বক্ষণ পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করেছে।
শুধু দেশের সেক্যুলারিস্ট সাংবাদিক, লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরাই নন; শীর্ষ রাজনীতিক, সরকারি নেতা, কূটনীতিক এবং সর্বস্তরের মানুষই এখন পাকিস্তানের আর্মি এবং এর গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের অবাধ হত্যা ও নির্যাতনের শিকার। দেশটির প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত তাদের ভয়ে ভীত। মার্কিন পাহারা ও হুমকি না থাকলে তাদের অবস্থা এত দিনে কী হতো তা অনুমান করা কষ্টকর নয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালে আইসেন হাওয়ার অভিযোগ করেছিলেন, তাঁর দেশে একটি ইনভিজিবল গভর্নমেন্টের অস্তিত্ব রয়েছে। পাকিস্তানে বর্তমানে আর্মির তালেবানপন্থী অংশ, আইএসআই এবং জঙ্গিরা মিলে এ রকমই একটি ইনভিজিবল সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। তারাই দেশটির প্রকৃত শাসক। মার্কিন তাঁবেদার জারদারি সরকার একটি শিখণ্ডী সরকার মাত্র।
এই সরকারের অবস্থা বুঝতে হলে তথাকথিত মেমোগেট কেলেঙ্কারির ব্যাপারটি সবাইকে জানতে হবে। মনসুর এজাজ নামে এক পাকিস্তানি ব্যবসায়ী দাবি করেন, তিনি এবং ওয়াশিংটনে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হোসেইন হাক্কানি একটি মেমো তৈরি করেন, যাতে আইএসআইকে দমনের জন্য মার্কিন সাহায্য চাওয়া হয়েছে। এই মেমো নাকি আর্মির হস্তগত হয়। এমনিতেই হাক্কানি 'মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি' বইটি লিখে সামরিক বাহিনীর চক্ষুশূল ছিলেন। এবার তাঁকে দেশদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। হাক্কানি অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য দেশে ফিরে আসেন। এখন ঘাতকদের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রধানমন্ত্রী গিলানির বাড়িতে পালিয়ে আছেন।
প্রধানমন্ত্রীও তাঁকে রক্ষা করতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে। কারণ সেনা কর্তাদের ইঙ্গিতে বিচার বিভাগ আদালত অবমাননার দায়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভিযুক্ত করেছেন। আদালতের অভিযোগ, বর্তমান প্রেসিডেন্ট জারদারির অতীতের দুর্নীতির অভিযোগগুলো রিওপেন করার জন্য আদালত যে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী তা পালন না করে আদালত অবমাননা করেছেন। অন্যদিকে হাক্কানি-পত্নী ফারাহ নাজ ইস্পাহানি ওয়াশিংটনে পালিয়ে গিয়ে বলেছেন, আইএসআই তাঁকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করছিল। উদ্দেশ্য, স্ত্রীকে জিম্মি করে রেখে হাক্কানিকে দিয়ে প্রেসিডেন্টকে অভিযুক্ত করার মতো হলফনামায় স্বাক্ষর করানো।
পাকিস্তানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জারদারির পরিণতি কী হবে তা দেশটির কেউ জানে না। তিনিও কি স্ত্রী বেনজিরের মতো ঘাতকের শিকার হবেন, না মার্কিন অনুকম্পায় সে দেশে পালাবেন_তা এখনো পরিষ্কার নয়। তিনি যদি প্রেসিডেন্ট পদে থাকেনও, তাহলে কাবুলের কারজাইয়ের মতো মার্কিন পাহারায় তাঁকে শিখণ্ডী প্রেসিডেন্ট হয়ে হয়তো থাকতে হবে। পাকিস্তানে আর্মির তালেবান সমর্থক অংশ কত শক্তিশালী, তার প্রমাণ তারা দিয়েছে গত বছর পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসির এবং মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিকে প্রকাশ্যে হত্যা করে। গত আগস্ট মাসে নিহত গভর্নরের ছেলে শাহজাদকেও তারা অপহরণ করে। এখন পর্যন্ত শাহজাদ নিখোঁজ।
হাক্কানি-পত্নী দেশ থেকে পালানোর পর সাংবাদিকদের কাছে সাশ্রু নয়নে বলেছেন, �What we are seeing is the systematic killing or silencing of anyone stands up to the institutionalisations of militarised Islamist sate.� (যারা সামরিকীকৃত ইসলামিক রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিকতাকরণের বিরোধিতা করছে, তাদেরই নির্বাক অথবা হত্যা করা হচ্ছে।) বাংলাদেশেও এদের দোসররা সাম্প্রতিক ক্যু-চক্রান্তটি সফল করতে পারলে দেশটিকে কোন পথে ঠেলে দেওয়া হতো, তা ভাবতে শিউরে উঠতে হয়।
লেখাটি শেষ করার আগে একটি মজার কথা না লিখলে লেখাটি অসমাপ্ত থেকে যাবে। পশ্চিমা একটি কাগজেই এই খবরটি বেরিয়েছিল। কিছুদিন আগে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে এক মার্কিন কর্মকর্তা আইএসআইয়ের এট্রোসিটিস সম্পর্কে প্রশ্ন এনেছিলেন। আইএসআইয়ের কর্মকর্তা নাকি তাঁকে বলেছেন, 'সত্তরের দশক থেকে কমিউনিস্ট দমনের নামে তোমরা আমাদের যা শিখিয়েছ, আমরা তো এখন তা-ই করছি। অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে করছি। তাতে কি তোমরা গর্বিত নও?
লন্ডন ২৩ জানুয়ারি, সোমবার, ২০১২

No comments

Powered by Blogger.