ডিসিদের কার্যপরিধির সংস্কার by এ এম এম শওকত আলী

ডেপুটি কমিশনার, সংক্ষেপে ডিসিদের কার্যপরিধি অধিকতর বিস্তৃত করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়াকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ প্রশাসনিক সংস্কার বলে দাবি করেছে। ব্রিটিশ শাসনের প্রথমভাগেই জেলাভিত্তিক এ পদের প্রাথমিক নাম ছিল সুপারভাইজার, অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক। একমাত্র ভূমি রাজস্ব আহরণের জন্যই এ ভূমিকা সীমিত ছিল। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৭৮১ সালে এ পদবির নাম হয় কালেক্টর।


ওই সময় পশ্চিমবাংলা ও পূর্ববাংলা মিলে সর্বমোট কালেক্টরের সংখ্যা ছিল ১৬। ওই সালে কলকাতা গেজেটে ১৬ জেলার কালেক্টরদের বদলি ও নিয়োগসংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ১৯৪৭ সালের পর ১৭টি জেলা নিয়ে ছিল তৎকালীন পূর্ববাংলা প্রদেশ। ১৯৬১ সালে এ প্রদেশের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে জেলা শব্দটি ব্যবহার করা হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের পর। এর আগে ব্রিটিশ শাসনের কম্পানির আমলে প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে এর স্বীকৃতি ছিল না। একাধিক থানা নিয়ে ক্রমান্বয়ে জেলার অংশ হিসেবে মহকুমা সৃষ্টি করা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধিমালায় (১৮৫৮) মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের উল্লেখ রয়েছে। ১৯৮২ সালে উপজেলা প্রথা প্রবর্তনের পর মহকুমা প্রথার বিলুপ্তি হয়। স্বল্পসংখ্যক থানাসহ সব মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। তখনো বলা হয়েছিল প্রশাসনিক সংস্কার। সংস্কারের উপাদান যে একেবারেই ছিল না, তা নয়। কারণ, উপজেলা পদ্ধতির আওতায় সরাসরি নির্বাচন প্রথায় উপজেলা চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টি করা হয়। নির্বাচিত চেয়ারম্যানকেও যথেষ্ট প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উপজেলায় কর্মরত সব সরকারি কর্মকর্তার বার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন লেখার ক্ষমতা চেয়ারম্যানকে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৯১ সালের পর উপজেলা প্রথার বিলুপ্তি হয় এবং ২০০৯ সালে এ প্রথা পুনর্জন্ম লাভ করে। জেলা পর্যায়ে এ ধরনের সংস্কারের সুপারিশ থাকলেও ১৯৭২-পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত জেলা পরিষদ গঠনের কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ দেখা যায়নি। ফলে স্থানীয় সরকার সংস্কারের বিষয়টি এখনো অসম্পূর্ণ। ডিসিদের সম্পর্কে সাধারণ ধারণা হলো, ব্রিটিশ আমলে কালেক্টর মূলত ভূমি রাজস্ব ও ব্যবস্থাপনাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও সীমিত বিচারিক কাজ করতেন। অর্থাৎ কার্যপরিধি ছিল অত্যন্ত সীমিত। এ ধারণা সঠিক নয়। ব্রিটিশ আমলের মধ্যবর্তী সময়েই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় সরকারসহ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। প্রথমোক্ত বিষয়টি এখন অত্যন্ত সীমিত। শেষোক্তটি নয়। প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত বেঙ্গল ফ্যামিন কোড ও ম্যানুয়ালে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই সময়ই এ সব কোড ও ম্যানুয়ালে বলা হয়েছিল, জেলার অধিক্ষেত্রভুক্ত বাসিন্দাদের সাধারণ কল্যাণের জন্য তিনি কাজ করবেন। বর্তমান উদ্যোগে নতুনভাবে এ বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত। এতে সংস্কার হলো কী? বর্তমান উদ্যোগে বলা হচ্ছে, ১৯৮৩ সালের আগে ডিসিদের কোনো কার্যপরিধি ছিল না। ১৯৮৩ সালে যে কার্যপরিধি প্রণীত হয়, তার কোনো সংস্কারই হয়নি। কার্যপরিধির বিস্তৃতি বা সম্প্রসারণ সময়ের প্রয়োজনে করতেই হবে। এর নাম সংস্কার নয়। কারণ, এটি একটি চলমান প্রশাসনিক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় যে বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে তা হলো, সার্বিক উন্নয়নসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে একজন কর্ণধার প্রয়োজন। না হলে চলে আসবে বিক্ষিপ্ত শাসনব্যবস্থা, যার ফল ভয়াবহ। অন্তত উন্নয়নসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য। সার্বিক নির্বাচিত শাসন কাঠামোতেও এর উদাহরণ দৃশ্যমান। যেমন সংসদ পরিচালনার ক্ষেত্রে স্পিকার। বিচারব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি। নির্বাহীবিষয়ক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী। এ সব পদে সমাসীন ব্যক্তিদের সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। প্রয়োজনবোধে তাঁরা সে ক্ষমতা প্রয়োগও করে থাকেন। এই ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাঁরা যদি ইচ্ছাকৃত ভুল করেন, তাহলেই আসে শাসনব্যবস্থায় বিপর্যয়। ক্ষমতা প্রয়োগ আইনসিদ্ধ হতে হবে। সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি দৃশ্যমান। তিন বাহিনীর প্রধানদের অধিক্ষেত্র সুস্পষ্ট। তবে তাঁরা সবাই একে অপরের কর্মকাণ্ডের পরিপূরক। দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাঁদের কেউ অন্য অধিক্ষেত্রে অযাচিত অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করেন না। কিন্তু যখন কোনো বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্তবাহিনী কর্মকাণ্ডের সমন্বয়ের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী হয়, তখন সেনাপ্রধানের নেতৃত্বেই এ সমন্বিত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রেই এ ধরনের আন্তবাহিনী কর্মকাণ্ডের সমন্বিত পরিচালনার বিষয়টি অন্তত প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশসহ যে সব দেশের সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা রয়েছে, এ সব ক্ষেত্রেও আন্তবাহিনী সমন্বয়ের প্রয়োজন হয়। তবে উভয় ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী প্রধানের সিদ্ধান্তই কার্যকর করা হয়। এখন দৃষ্টি দেওয়ার সময় এসেছে মাঠ প্রশাসনের সমন্বিত কর্মকাণ্ড পরিচালনার বিষয়টিতে। ব্রিটিশ আমলেই এ বিষয়টি ১৯৪৪ সালের জেলা প্রশাসন সংস্কার কমিটি অনুধাবন করে কয়েকটি সুপারিশ প্রণয়ন করেছিল। এতে ডিসির সমন্বয়কের ভূমিকা অধিকতর শক্তিশালী করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে জেলায় ডিসির ভূমিকার বিষয়ে বলা হয় যে ডিসি হবেন দলনেতা। অর্থাৎ জেলা পর্যায়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সব বিভাগের কার্যক্রম তিনি দলনেতা হিসেবে সমন্বয় করবেন। কিন্তু তখনো এ কথাও বলা হয়েছিল যে তাঁকে অন্যান্য দপ্তরের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করার কোনো ক্ষমতা দেওয়া হবে না। পরবর্তী কোনো সময়ে এ ক্ষমতা দেওয়াও হয়নি। এর আগে ২৭টি নতুন দায়িত্বের অল্প কয়েকটি যে একেবারেই নতুন নয়, তা উল্লেখ করা হয়েছে। এর সঙ্গে আরো কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। পত্রিকায় প্রকাশিত তালিকার শীর্ষে রয়েছে নারী ও শিশু উন্নয়ন। মূলত এ বিষয়টিতে এ-সংক্রান্ত মন্ত্রণালয় গঠিত হওয়ার পরপরই ডিসিরা সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছেন। এর পর উল্লেখ করা হয়েছে সার ব্যবস্থাপনা ও কৃষি উন্নয়ন। সার তথা কৃষি উপকরণ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি কৃষি উন্নয়নের অংশবিশেষ। ১৯৯৪-৯৫ সালে ভয়াবহ ইউরিয়া সার সংকটের পরই জেলা পর্যায়ে বেসরকারি সার ডিলারদের সার সরবরাহ পরিবীক্ষণের দায়িত্বসংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে এর নামকরণ করা হয় বীজ ও সার পরিবীক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কমিটি। ২০০৯ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় সার ব্যবস্থাপনা নীতি প্রণয়ন করে। এ নীতিতে একই কমিটির উল্লেখ রয়েছে। কৃষি উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি পাকিস্তান আমলেই ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও একই কমিটি ডিসির নেতৃত্বে কাজ করে আসছে। এটা কি কোনো নতুন দায়িত্ব? এর পর উল্লেখ করা হয়েছে বাজারমূল্য পরিস্থিতি পরিবীক্ষণের বিষয়। বলা প্রয়োজন ব্রিটিশ আমল থেকে, বিশেষ করে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় থেকেই ডিসি তাঁর পাক্ষিক ও মাসিক গোপনীয় প্রতিবেদনে মূল্য পরিস্থিতির বিষয়টি উল্লেখ করতেন। এখন পর্যন্ত একই প্রথা বিদ্যমান। একে নতুন দায়িত্ব বলা যাবে না। এর পর তালিকায় রয়েছে ভোক্তার অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি। ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার আইন প্রণয়নের পর এ দায়িত্বে নিয়োজিত কমিটির প্রধান হিসেবে ডিসি কাজ করে আসছেন। একেবারেই যে নতুন, তা বলা সঠিক নয়। পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্বটি নতুন। মুক্তিযোদ্ধাসংক্রান্ত দায়িত্বও নতুন। ধর্মবিষয়ক কার্যাদি নতুন নয়। এর কিছু কাজ ডিসি আগেও করতেন। এর পর যে বিষয়টির কথা বলা হয়েছে, তা একেবারেই নতুন। তাহলে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নির্ধারিত অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প। তবে এ বিষয়টি কাঠামোগত রূপ বর্তমানের হলেও অতীতে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের আমলেও এ কাজ আংশিকভাবে ডিসি করতেন। বৃক্ষরোপণের কাজটিকেও নতুন দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিগত দুই দশকের বেশি সময় ধরেই জাতীয় বৃক্ষরোপণের উদ্যোগের আওতায় প্রতিটি জেলায় এ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এখনো হচ্ছে। এতে নতুনত্বের কিছু নেই। তা ছাড়া বিষয়টি বছরে একবারই হয়। বছরজুড়ে এ কাজটি হয় না। এনজিওদের বিষয়টিকেও নতুন কাজ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি এনজিওর আবির্ভাব ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের জন্য সরকারের পাশাপাশি এনজিওরাও কাজ করে। এ দেশের সর্ববৃহৎ এনজিও হিসেবে চিহ্নিত ব্র্যাক ওই সময় থেকেই তৎকালীন বৃহত্তর সিলেট জেলা বা সুনামগঞ্জ মহকুমার দিরাই ও সাল্লায় কাজ শুরু করে। ওই সময়ও তৎকালীন ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জেলা পর্যায়ে ডিসি এনজিওদের সহায়তা করতেন। পরবর্তী সময়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে উন্নয়নসংক্রান্ত কিছু কমিটিতে এনজিওর প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করার নিয়ম ছিল। এটাকে কি একেবারেই নবসৃষ্ট দায়িত্ব বলা যায়? তবে তালিকায় উলি্লখিত অনিবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণের কাজটিকে নতুন বলা যেতে পারে। এর পর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত যেসব দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে, যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ম্যাজিস্ট্রেসির কাজ, জেলা প্রশাসন ইত্যাদি ব্রিটিশ আমল থেকেই ছিল এবং এখনো আছে। নতুনত্বের বিষয়ে বলা যায় যে ডিসির দায়িত্বপরিধি প্রধানত দুই ধরনের_এক. আইন ও বিধিভুক্ত বিষয়াবলি এবং দুই. উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সমন্বয়। এসব বহুমুখী দায়িত্ব লিপিবদ্ধ করাই বর্তমান উদ্যোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সময় সময় এর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে হবে। না হলে তালিকা অসম্পূর্ণ থাকবে। সেদিকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ সচেষ্ট হবে বলে আশা করা যায়।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.