নিত্যজাতম্-রানার, রানার ভোর তো হয়েছে! by মহসীন হাবিব

শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর বহু জাতির মধ্যযুগীয় ও প্রাচীন রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ছিল ডাক বিভাগ। গত শতাব্দীতে বাংলায় ডাক বিভাগ শুধু একটি সরকারি সার্ভিসমাত্র ছিল না, মানুষের জীবনের সঙ্গে, নাটক, উপন্যাস, গান ও সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে জড়িয়ে ছিল। এ বিভাগ নিয়ে বরাবরই ছিল ক্ষোভ, আবেগ ও ভালোবাসা।


কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর বিখ্যাত রানার কবিতায় লিখেছিলেন_
রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে।
এ কবিতাতেই তিনি মানুষকে সার্ভিস দেওয়া রানারের দুঃখ দেখে জিজ্ঞেস করেছেন_
রানার রানার এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে
রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে?
সলিল চৌধুীরর সুরে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে এ কবিতা অসাধারণ জনপ্রিয় এক গান হয়ে উঠেছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত লম্বা বর্শা ও হ্যারিকেন হাতে ঘণ্টা বাজিয়ে ছুটে যাওয়া রানার আমরা দেখিনি। কিন্তু সুকান্তের ওই কবিতা হেমন্তের কণ্ঠে শুনে আমাদের দরদ জেগে উঠেছে অতীতের রানারদের জন্য।
ডাক বিভাগের প্রতি মানুষের একটি আস্থাও ছিল অন্য রকম। সমাপ্তির নায়িকা মৃন্ময়ীর কথাই ধরুন : 'বাপের কাছে যাইতে হইলে কোনপথ অবলম্বন করিতে হইবে মৃন্ময়ী তাহার কিছুই জানিত না। কেবল তাহার মনে বিশ্বাস ছিল, যে পথ দিয়া ডাকের পত্রবাহক 'রানার'গণ চলে, সেই পথ দিয়া পৃথিবীর সমস্ত ঠিকানায় যাওয়া যায়।'
সমাপ্তির রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ অথবা নায়িকা মৃন্ময়ীর এখন আর জানার উপায় নেই যে শত শত বছর ধরে, ধীরে ধীরে যে ডাক বিভাগ গড়ে উঠেছিল, তা আর মাত্র ১০০ বছর না যেতেই পৃথিবীর 'সমস্ত ঠিকানায়' এক নতুন গতির কাছে, এক নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিলুপ্তির পথে হাঁটতে শুরু করেছে। আমরা আর কতদিন এ ডাক বিভাগকে ধরে রাখতে পারব, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ সব কিছুর সঙ্গে শক্তি প্রয়োগ করা যায়, যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে নয়। তার প্রমাণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও যান্ত্রিক শক্তির পাশাপাশি ডাক বিভাগকেও করে তুলেছিল শক্তিশালী। সেই যুক্তরাষ্ট্রেই এখন ভয়ানক হুমকির মুখে পড়েছে এ বিভাগ। সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্টে ধারণা করা হয়েছে, ইউএস পোস্টাল সার্ভিস এখন মৃত্যুপথযাত্রী। কারণ ডাক বিভাগের এখন প্রায় কোনো আয় নেই। এক সময়ের এই শক্তিশালী বিভাগ এখন ৫৫০ কোটি ডলার দেনার দায়ে পড়েছে এবং তা এ মাসেই পরিশোধ করতে হবে। তাই এ বিভাগ যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের জরুরি পদক্ষেপ আশা করছে। যদি কংগ্রেস কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে এই বিভাগ ডিফল্টার হয়ে যাবে। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এই ডাক বিভাগের মহাসংকটের পেছনে মূল কারণ নাকি ই-মেইল এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্ক। অন্তত আমাদের দেশে আরো একটি কারণ কিন্তু ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহারের আগেই আমরা শুরু হতে দেখেছি। সেটা হলো, পুঁজিবাদী চরিত্র (এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী বলে গালি দিচ্ছি না) অনুসারে সরকারের প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশে দেশে দেওয়া হয়েছে সেবা খাতে ব্যবসার অনুমতি। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন ফেডএঙ্, ইউপিএস নামক প্রতিষ্ঠানগুলো শুরু হয়েছে ডাক বিভাগের কাউন্টারের মতো, তেমনি আমাদের দেশেও অনেক কুরিয়ার সার্ভিসের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এসব কুরিয়ার সার্ভিস মূলত সরকারি প্রতিষ্ঠানকে পেছনে ফেলার প্রতি লক্ষ্য রেখে এগিয়েছে। সফলও হয়েছে। সরকারের ডাক বিভাগ যেখানে একটি চিঠি পেঁৗছে দিতে সাত দিন সময় নিয়েছে, ঠিক তখন একটি কুরিয়ার সার্ভিস ২৪ ঘণ্টায় নিরাপদে চিঠি পেঁৗছে দিয়েছে। টাকাপয়সা এবং মালামাল প্রেরণের বেলাতেও তাই। ফলে এক সময় আমরা দেখলাম, পোস্ট অফিসগুলোতে কোনো ভিড় নেই। সারা দিন ডাক বিভাগের কর্মীরা অলস দুপুরের মতো সময় কাটাচ্ছেন।
তাই বলছি, সময় পার হতে থাকে। সেই সঙ্গে পাল্টাতে থাকে সমাজ, চারপাশ এবং অবকাঠামো। আরো অধিক গতিতে পাল্টাতে থাকে মানুষের মানসিকতা। এ এক অমোঘ নিয়ম। এতে হতাশ বা ক্ষুব্ধ হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু তার পরও অনেক পরিবর্তন হৃদয়ের কোথায় যেন খোঁচা দিয়ে যায়। ডাক বিভাগের পিছিয়ে পড়া এবং বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া দেখে তেমনি খোঁচা লাগে মনের গভীর কোনো অদৃশ্য তন্ত্রীতে। শুধু 'আধুনিকতা'র স্বার্থে তা মুখে স্বীকার করি না।
কৈশোরে প্রথম প্রেমে কিশোরীর কাছ থেকে যে চিঠি পেতাম, সেটা আসত এক টাকা দামের হলুদ একটি খামে। হাতে আরো অনেক চিঠি, কারো মায়ের জন্য মানি অর্ডারের টাকা, কারো জরুরি টেলিগ্রাম_এসব নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন ডাক বিভাগের খাকি জামা গায়ে নুরুভাই। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ছোটখাটো এ মানুষটাকে দূর থেকে দেখলেই মনে হতো_
'ভাগ্যিস আছিল নদী জগৎ সংসারে
তাই লোকে কড়ি দিয়ে যেতে পারে ওপারে।'
নস্টালজিয়া শুধু এ কারণেই নয়। ডাক বিভাগের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। ডাক বিভাগের বিবর্তনের সঙ্গে সমাজ জড়িয়ে ছিল ওতপ্রোতভাবে। অনেকটা মানব সভ্যতার শুরু থেকেই। বার্তা প্রেরণের প্রাচীন খবরটি পাওয়া যায় অথর্ব বেদ-এ। রামায়ণ এবং মহাভারতেও বার্তা প্রেরণের ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ আছে। সেসব তো আসলে পোস্টাল সার্ভিসেরই একেবারে প্রাথমিক অবস্থা। পরে রাজা, বাদশাহ, সুলতানরা এ সার্ভিসকে নিজেদের মতো করে উন্নয়ন সাধন করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ সালে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যে বার্তা প্রেরণের ব্যবস্থা করেছিলেন, তা ইতিহাসে লেখা আছে। উপমহাদেশে মুহাম্মদ বিন কাশেম সিন্ধু বিজয়ের পর দিওয়ানি বারিদ বা ডাক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকেই। মরক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা ভারতে সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলকের ডাকবার্তার কথা যত্নের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন। এরপর শের শাহ সুরীর সময় ডাকের ব্যাপক সংস্করণ করা হয়। এ সময় ডাক বিভাগের কিছু রানারের জন্য পায়ে চলার বদলে ঘোড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন সুরী। ডাক বিভাগ পেয়েছিল এক ধাপ গতি। বাংলা থেকে সিন্ধু পর্যন্ত যে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড রয়েছে, তা তখনো ছিল। সুরী এই পথে বার্তা প্রেরণের জন্য দুটি ঘোড়া সবসময় প্রস্তুত রাখতেন। পরে মোগল শাসকরাও যথেষ্ট উন্নয়ন সাধন করেন। সম্রাট আকবর পায়ে চলা রানার এবং ঘোড়ার পাশাপাশি উটের ব্যবস্থা করেছিলেন।
ডাকবার্তা তখন রাজা-বাদশাহদের জন্য ছিল, তাঁদের রাজ্য রক্ষায় বার্তা প্রেরণের ব্যবস্থা হতো। এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে দূত পাঠিয়ে বা বার্তাবাহক পাঠিয়ে সংবাদ আদান-প্রদান করা হতো। তবে এই মধ্যযুগের শাসকরা ব্যবসায়ীদের জন্য ডাক বিভাগের সুবিধা গ্রহণের ব্যবস্থা করেন। পয়সার বিনিময়ে এ বিভাগের সেবা ব্যবসায়ীরা গ্রহণ করতেন। পরে ১৭৭৪ সালে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস সাধারণ মানুষের জন্য এ বিভাগকে মুক্ত করে দেন। তখন প্রতি ১০০ মাইলের জন্য দুই আনা ফি দিতে হতো। সত্যি কথা বলতে কি, ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির হাত দিয়েই একটি ব্যাপক বিস্তৃত ডাক বিভাগের দেখা পায় ভারতবাসী। তারা প্রবেশ করতে না করতেই ১৬৮৮ সালে বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) এবং কিছুদিনের মধ্যে কলকাতা এবং মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই) পোস্ট অফিস তৈরি করে। প্রাসঙ্গিক একটি সত্য উচ্চারণ না করে পারছি না। ব্রিটিশরা অত্যাচার করেছে, পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে সেবা দেওয়ার একটি প্রবণতাও ছিল। পক্ষান্তরে দেশীয় জমিদার-রাজারা ছিলেন কিল মারার গোসাই। যা হোক, ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ যে রেজল্যুশন করেছিলেন, সেই রেজল্যুশন অনুসারে রানার বা ডাক হরকরা দূরত্ব ও কাঁধে বোঝার ভার অনুসারে ভাতা পাবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। সে নিয়মই প্রচলন করেন তিনি।
এসব কথা থাক। বাংলাদেশে বর্তমান ডাক বিভাগে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণের চেষ্টা চলছে। টাকা পাঠানোর আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। দ্রুত চিঠি পাঠানোর এঙ্প্রেস মেইল সার্ভিসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে ফেডএঙ্, ডিএইচএলের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, ইন্টারনেট সার্ভিস, দেশের প্রাইভেট ক্যুরিয়ার সার্ভিসের সঙ্গে বেশি না হোক, সমান গতিতে আগাতে না পারলে ভর্তুকির কোনো সীমা থাকবে না। সে ভর্তুকি আমরা গরিব দেশ চালাব কী করে? তাই প্রস্তাব করি, হয় দ্রুত এ বিভাগকে সার্বিকভাবে আধুনিক করে তোলা হোক, অথবা সম্পূর্ণ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়ে বিশালসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অন্যান্য বিভাগে আত্তীকরণ করা হোক। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখনই সময়।
লেখক : সাংবাদিক, mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.