জিয়ার নাম মুছে ফেলার দুঃসাহসের পরিণতি হবে ভয়াবহ by ড. মাহবুব উল্লাহ্

বাংলাদেশ থেকে অসূয়া-বিদ্বেষ অবসানের কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। বরং উত্তরোত্তর তা বেড়েই চলেছে। এ রকম পরিস্থিতি যে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে অভিপ্রেত নয়, তা বলাই বাহুল্য। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো এসব অসূয়া-বিদ্বেষ ও হানাহানির সুড়ঙ্গপথে তৃতীয় শক্তির অভ্যুদয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
ফলে গণতন্ত্র হয় বিপন্ন, মানবাধিকার হয় ভূলুণ্ঠিত। বিগত ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮’র জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সংসদে ব্রুট মেজরিটি অর্জন করে। ১৯৭০’র নির্বাচন, ১৯৭৩’র নির্বাচন ছাড়া আর কোনো নির্বাচনে একটি পক্ষের এত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সম্ভব হয়নি। ১৯৫৪’র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ও অনুরূপ ছিল; কিন্তু সেই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অন্তর্গত বিভিন্ন দলের মধ্যে শক্তির একটি ভারসাম্য ছিল। যার ফলে কোনো দলের পক্ষে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে শুধু একটি দলের সরকার গঠন সম্ভব ছিল না। এবারের নির্বাচনে যে ফলাফল হয়েছে, তাতে আওয়ামী লীগ নির্বিঘ্নে মহাজোটের অন্য শরিকদের উপেক্ষা করে নিজস্ব একটি সরকার গঠন করতে পারত। তাই বলা যায়, এবারকার ক্ষমতাসীন দলটি ক্ষমতার মসনদে বসে অপ্রতিহত ক্ষমতার মালিক হয়েছে। এর বিপরীতে চারদলীয় জোটের পরাজয়ও ঘটেছে অত্যন্ত মারাত্মকরূপে। ভোটের বিচারে না হলেও সংসদ সদস্যের সংখ্যার বিচারে চারদলীয় জোট বিশেষ করে বিএনপির পরাজয় যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিশ্লেষণে উপেক্ষা করার মতো নয়। এই নির্বাচনে বিজয়ীদের পক্ষে নানা কায়দায় কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। কারচুপির পক্ষে পরিস্থিতিগত সাক্ষ্যও (ঈরত্পঁসংঃধহঃরধষ বারফবহপব) অঢেল। বিশেষ করে দেশের অগণিত কেন্দ্রে এবং সাধারণভাবে দেশব্যাপী প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা এতই বেশি যে ভোট প্রদানের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে এত সংখ্যক ভোট প্রদান রীতিমত বিস্ময়কর। নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব এতই প্রকট ছিল যে, তা অনেকেরই দৃষ্টি কেড়েছে। নির্বাচন কমিশন এমনভাবে নির্বাচনটি পরিচালনা করেছে যার ফলে একটি পক্ষের অনায়াসে বিজয় লাভ করা সম্ভব। সম্প্রতি ভোলা ও টাঙ্গাইলের দুটি আসনের নির্বাচনে অনিয়মের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রায় প্রমাণ করে নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করেনি। বিচারপতি আজিজের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনের যে ব্যর্থতার কথা বলা হয়েছিল এখন দেখা যাচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন তার তুলনায় অধিকতর ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সাংবিধানিক রীতিনীতির প্রতি তোয়াক্কা না করে প্রায় দুই বছর ধরে ভোটার আইডি তৈরির পর নির্বাচন কমিশন যে নির্বাচন উপহার দিল তা কার্যত প্রহসনে পরিণত হয়েছে। যতই ভোটার আইডি করা হোক না কেন যদি একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত নেয় বিশেষ একটি দলকে জিতিয়ে আনতে হবে, তাহলে কৌশলের অভাব হয় না। চারদলীয় জোট হয়তো পরাজয় এড়াতে পারত না; কিন্তু জয় ও পরাজয়ের মধ্যে ব্যবধান এত দুস্তর হওয়ার কথা ছিল না। যারা ১১ জানুয়ারির ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশকে চরম বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে তারাই আত্মরক্ষার প্রয়োজনে হয়তো এমন ধরনের একটি নির্বাচনই চেয়েছিল।
যাই হোক, এতসব ঘটনার পরও নির্বাচনের পর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সংযত। তারা সংসদের প্রথম অধিবেশনে যোগ দিয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে বড় রকমের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বিএনপি নেতৃবৃন্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন যে, একটি অনির্বাচিত সরকারের চেয়ে নির্বাচিত সরকারই শ্রেয়। গণতন্ত্রহীন অবস্থার চেয়ে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র কাম্য। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের প্রতি সহযোগিতার হাতও বাড়িয়ে দিয়েছে বিএনপি। সরকার কোনো ক্ষেত্রে সহযোগিতা নেয়ার প্রয়াস না নিলেও বিএনপি এখনও সহযোগিতার সুরেই কথা বলছে। বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া পুনর্বার সহযোগিতার মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। অথচ শাসকদল একের পর এক এমন সব উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে, সহযোগিতার মনোভাব বজায় রাখা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। সর্বশেষ যে উস্কানিটি দেয়া হয়েছে সেটি হলো জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পাল্টে ফেলার জন্য মন্ত্রিসভায় নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়া শাহাদাত্ বরণ করার পর তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির নামকরণ করা হয় জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেই থেকে আন্তর্জাতিকভাবে এই বিমানবন্দরটি বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করতে চেয়েছিল; কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে সেই সময় আওয়ামী লীগ সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়; কিন্তু এবার তারা জিয়ার নাম-নিশানা মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর। এমনকি পবিত্র সংসদে দাঁড়িয়ে বলা হচ্ছে জিয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেননি। জিয়া পরিবারকে প্রতিহিংসামূলক হয়রানির শিকারে পরিণত করা হচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়াকে তার বাসস্থান থেকে উচ্ছেদের আয়োজন করা হয়েছে। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার ফলে তারা এই কাজটি করতে পারছে না। সেই বাসস্থানের জমিতে নানা প্রকল্প করার কথাও আমরা শুনেছি। কীভাবে এই পরিবারটিকে সর্বস্বান্ত করা যায় তার জন্য হেন পন্থা নেই, যা অবলম্বন করা হচ্ছে না।
বিমানবন্দর বা অন্য কোনো স্থাপনা থেকে জিয়ার নাম মুছে ফেললেই কি দেশের জন্য জিয়ার অবদানের কথা দেশের মানুষ অত সহজে ভুলে যাবে? বরং এ ধরনের প্রতিহিংসাপরায়ণ কর্মকাণ্ডের ফলে জিয়াউর রহমানের স্মৃতি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে। কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ ৫২’র শহীদদের উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘বুলেট শুধু রক্ত ঝরাতে পারে, প্রাণ অথবা এমন কিছু নয়’, ৫২’র শহীদদের বুলেটের নির্মম আঘাতে হত্যা করা হয়েছিল; কিন্তু তাদের নাম এদেশের কোটি কোটি মানুষের অন্তরে চিরদিনের জন্য প্রোথিত হয়ে গেছে। কোনো শাসক সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, এ দেশের মানুষের অন্তর থেকে তাদের নাম মুছে ফেলতে পারবে না। জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা করে এ দেশের মানুষের অন্তরে যে আসনে প্রতিষ্ঠিত, দেশকে ভালোবেসে দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়ে যে স্মৃতির মিনার স্থাপন করে গেছেন তাও কারোর পক্ষে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। তাহলে এই হঠকারিতা কেন করা হচ্ছে? কাকে সন্তুষ্ট করার জন্য করা হচ্ছে? জিয়ার প্রতি রাষ্ট্রঘাতী শক্তির প্রতিহিংসা এতই প্রবল যে, দু’চারটি স্থাপনায় যেখানে জিয়ার ম্যুরাল ছিল তাও গাঁইতি শাবলের নির্মম আঘাতে ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হয়েছে। এ যেন গোটা বাংলাদেশকে ক্ষত-বিক্ষত করা। এ যেন বাংলাদেশের হৃিপণ্ডকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করা। মানুষটি আজ বেঁচে নেই। তিনি তো কোনো মামুলি মানুষ ছিলেন না। সাধারণ মামুলি মানুষের মৃত্যুর পর তার চরম শত্রুরাও এমন বর্বর আচরণ করে না, যা জিয়ার মতো একজন মহান মানুষের প্রতি করার স্পর্ধা তারা দেখাচ্ছে। এতে লোকান্তরিত জিয়ার কোনো ক্ষতি হবে না। ক্ষতি হবে তাদেরই যারা এসব ঘৃণ্য প্রয়াসে লিপ্ত।
বিগত জোট সরকারের আমলে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে যেসব বিশাল প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছিল সেসব প্রতিষ্ঠানের নাম জোট সরকার পরিবর্তন করেনি একটি ব্যতিক্রম বাদে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা হয়নি। শুধু বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারের নাম পরিবর্তন করে ভাসানী নভোথিয়েটার করা হয়েছিল। সেটিও আওয়ামী লীগ সরকার এ যাত্রা ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে পরিবর্তন করে আবারও বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার করেছে। এ ক্ষেত্রে জোট সরকারের পদক্ষেপটি যেমন অনভিপ্রেত ছিল ঠিক একই রকম অনভিপ্রেত হয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পদক্ষেপ। একজন পরলোকগত মহান ব্যক্তির প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে আরেকজন পরলোকগত মহান ব্যক্তিকে দাঁড় করানোর এই কালচার অত্যন্ত আপত্তিকর। কবরে শুয়ে তারা হয়তো এসব দেখে কাত ফিরবেন; কিন্তু তাদের কিছুই করার থাকবে না। শেখ মুজিবুর রহমান মওলানা ভাসানীর পদযুগলের পাশে বসেই জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে নিজেকে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে যাচ্ছিলেন তখন মওলানা ভাসানী ১৯৬৯’র ১৬ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, আমরা ফরাসি বিপ্লবের মতো জেল ভেঙে ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাকে মুক্ত করে আনব। মওলানা ভাসানীর সেই হুঙ্কারে তত্কালীন শাসকদের তখেত তাউসে আগুন জ্বলেছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন। মওলানা ভাসানীর প্রতি অন্তত এটুকু কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে ভাসানী নভোথিয়েটারের নাম পরিবর্তন করা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয় ছিল; কিন্তু সেই শ্রেয়বোধ আজ বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। শ্রেয়বোধের অভাবেই প্রতিষ্ঠানের নাম বদলের সঙ্কীর্ণ চোরাগলিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে এ দেশের রাজনীতি। ভুলে গেলে চলবে না, এ দেশের রাজনীতি থেকে দুই নেত্রীকে অপসারণ করার সূত্র যেসব পরাশক্তি বাতলে দিয়েছিল তারা এখনও খবধফবত্ংযরঢ় পযধহমব্থর ধারণা থেকে সরে এসেছে কিনা সন্দেহ। কূটনৈতিক অঙ্গনে ইশারা-ইঙ্গিতে এই ফর্মুলা এখনও উচ্চারিত হচ্ছে বলে যারা খোঁজ-খবর রাখেন তাদের ধারণা, এমন কথাই ইথারে ভেসে বেড়াচ্ছে। সুতরাং মহত্ কোনো চিন্তায় উদ্দীপ্ত না হলেও অন্তত আলোকিত আত্মস্বার্থের বিবেচনায় নাম মোছামুছির সংস্কৃতি থেকে শাসক দল সরে এলেই দেশ ও দশের মঙ্গল হবে। সবার শুভবুদ্ধির উদ্রেক হোক—এই কামনাই করি।
লেখক : অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.