বাঘা তেঁতুল-কথা কত কিসিম by সৈয়দ আবুল মকসুদ

থার দাম দুনিয়ার যেকোনো দামি জিনিসের চেয়ে বেশি। অবশ্য বাচাল ও নির্বোধের কথার কোনো দাম নেই। যে মানুষ যত বড় ও জ্ঞানী, তাঁর কথার ওজন ও দাম তত বেশি। রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে যাঁদের কারবার, তাঁদের কথাকে জনগণ খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তবে কথা হতে হবে কথার মতো কথা।


একই ব্যক্তি একই বিষয়ে মঙ্গলবার বললেন এক কথা, শুক্রবার আরেক কথা এবং রোববার সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। তাঁর স্বগোত্রীয়রাও বলতে থাকলেন একেক দিন একেক কথা। বাংলাদেশে বিশ্বের সর্বোচ্চ বাকস্বাধীনতা থাকায় তা তাঁরা বলতেই পারেন; কিন্তু শ্রোতাকে যদি তা বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হয়, তা শ্রোতার জন্য জুলুম। কারও গলায় গামছা দিয়ে অনেক কিছু করানো সম্ভব; কিন্তু বিশ্বাস জিনিসটি একেবারেই ব্যক্তিগত, তা জুলুম করে করানোর চেষ্টা চেঙ্গিস খানের পক্ষেও সম্ভব ছিল না। বৈচি ফলকে কেউ যদি গোপালভোগ আম বলে চালাতে চায়, তা বাধ্য হয়ে, অর্থাৎ ঠেলায় পড়ে কেউ মেনে নিলেও বিশ্বাস করতে বাধ্য নয়।
কথা দিয়ে কোটি কোটি মানুষের মনে কামানের গোলার চেয়ে কঠিন আঘাত হানা যায়—তা শুধু বাংলাদেশের মানুষই জানে। কোনো কোনো কথায় অবশ্য আঘাত ততটা নয়—অবাক হওয়ার উপাদানই বেশি। শ্রোতা অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে চায়। কোনো কোনো কথায় দুঃখের উপাদান অসামান্য। কান্নায় ভেঙে পড়তে চায় পনেরো কোটি মানুষ। পরস্পরবিরোধী কথার যদি একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা হয়, আমাদের জনা পাঁচেক অংশগ্রহণকারী সবগুলো স্বর্ণ জয় করতে পারবেন।
দেশের সবচেয়ে বড় নদীটির ওপর ব্রিজ হবে। হারাধন সূত্রধর আর কালু মোল্লার বাড়ির মাঝখানের খালের ওপর বাঁশের সাঁকো বানানো নয়, দেশের বৃহত্তম ব্রিজ। সেটির ওপর দিয়ে যারা যাতায়াত করবে অথবা দূর থেকে সেটিকে তাকিয়ে যারা দেখবে— আনন্দিত হওয়ার কথা তাদের। কিন্তু তাদের খুশি হওয়ার আগেই খুশির ঘটনা ঘটে তাদের জীবনে, যাদের ওটি বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের খুশি স্থায়ী হওয়ার আগেই বিপত্তি ঘটাল তারা, যাদের টাকায় ওটি বানানো হবে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো আবোলতাবোল কথার প্রতিযোগিতা। নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে এক কথা। হিথরো বিমানবন্দরে আরেক কথা। ঢাকা বিমানবন্দরে অন্য রকম কথা। সচিবালয়ে আরেক কথা। বিশাল জনসভায় অন্য কথা। সংবাদ সম্মেলনে ভিন্ন কথা। কুয়ালালামপুর থেকে আসা অতিথিকে হাতের কাছে পেয়ে অন্য রকম কথা। কুয়ালালামপুরওয়ালা আশার বাণী শোনানোর পরে আর যদি তার টিকিটিরও দেখা পাওয়া না যায়, কোনো ক্ষতি নেই। এই মুহূর্তে তার ওই আশাটুকুর প্রয়োজন ছিল। উত্তাল সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া মানুষের কাছে খড়কুটোরও মূল্য রয়েছে।
কিন্তু ওই যে বলেছি বিশ্বাস—সে বড় সাংঘাতিক জিনিস। গলায় গামছা দিয়ে তা করানো সম্ভব নয়। ফুলের মতো নিষ্কলঙ্ক বাংলাদেশ সরকারকে টাকা যদি বিশ্বব্যাংকই দেবে, তাহলে কুয়ালালামপুর থেকে কর্জ করার প্রশ্ন আসে কেন? ওয়াশিংটনওয়ালারা পাকা লোক। কাঁচা কাজ তাঁরা কদাচ করেন। বিএনপি সরকারের দুর্নীতির জন্য এখন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে টাকা দেবে না—এ কথা আগে গোপন রাখা হয়েছিল কেন? বিএনপির দুর্নীতির জন্য ‘একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী’ এত দিন পরে বিশ্বব্যাংকের দুয়ারে ধরনা দিতে যাবেন কেন? তিনি যদি বিএনপির পেছনেই লেগে থাকেন, তাহলে তো তা বর্তমান সরকারের জন্য খুশির কথা। ‘কাজ শুরুই হলো না, দুর্নীতি হবে কীভাবে?’ কথাটি বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় প্রতিনিধিকে ডেকে কঠোর ভাষায় বলে দিলেই তো হতো। এখন যদি বিশ্বব্যাংক বলে বসে, টাকা মালয়েশিয়া থেকে নাও গিয়ে, আমরা কোনো টাকা হাওলাত দিতে পারব না। আবার শুনছি, নিজেদের টাকাতেই করা হবে। আগে নিজেদের টাকা কোথায় ছিল? বাংলার মানুষ ও বিশ্বব্যাংকের আমলারা নাবালক নয়।
রাষ্ট্রের টাকাকড়িসংক্রান্ত ব্যাপারে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব যাঁর, তিনি একদিন বললেন, ‘শেয়ারবাজার কী, আমি বুঝি না।’ আরেক দিন বললেন, ‘শেয়ারবাজার এক অদ্ভুত বাজার।’ এসব কথা শুনে শেয়ারবাজার সম্পর্কে যাঁর সত্যি সত্যি কোনো ধারণা নেই, তিনি মনে করবেন, এত লোক যখন ওদিকে ছোটে, আমিও না হয় বাজারের থলে নিয়ে মতিঝিল যাই! চকবাজার, ঠাঁটারীবাজারে যখন আগুন, কোরবানির ঈদের আগে শেয়ারবাজার থেকে পোলাওয়ের চাল-মুরগি-গরম মসলা কিনে নিয়ে আসি। একদিন বলা হলো, শেয়ারবাজার বিপর্যয়ে বিরোধী দল দায়ী। শেয়ারবাজারের তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে সতেরো রকম কথা শোনা গেল।
বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ শিক্ষিত মানুষ ভালো ইংরেজি জানেন না, সেটা কোনো দোষের নয়। কিন্তু খুবই খুশির কথা যে আজ বাংলার মাটির প্রতিটি নিরক্ষর লোক ‘করিডর’, ‘কানেকটিভিটি’, ‘ট্রানজিট’ ও ‘ট্রানশিপমেন্ট’ শব্দগুলোর এ. টি. দেবের অভিধানে কী অর্থ আছে, তা না জানলেও অন্তর্নিহিত অর্থ ঠিকই জানে। বাংলার মানুষের চেতনার মান এখন এতটুকু উঁচু যে দুই উপদেষ্টা হপ্তায় হপ্তায় টিভিতে ইংরেজিতে যা-ই বলুন, তাঁদের কথার অর্থ তারা না বুঝলেও তাঁদের চোখের ভাষায় বোঝে বাংলাদেশের ‘বেশি লাভের’ জন্য তাঁরা কী আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।
ব্যক্তি যখন ব্যক্তির সঙ্গে শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতা করে, তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ক্ষমা করলেও করতে পারে। কেউ যখন ব্যক্তিস্বার্থে গোটা জাতির সঙ্গে শঠতা করে, তার ক্ষমা নেই। মানুষ এখন প্রতিদিন কত কথা শুনছে এবং নীরবে বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ, তার গলায় গামছা। তবে গামছা একটি আলগা জিনিস। টান দিয়ে খুলে ফেলা সম্ভব। কোনো দিন যদি কোনো কথা অবিশ্বাস করতে সে বাধ্য হয়, সেদিন কোনো শক্তি তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.