আমার সমালোচনা ভালোভাবেই নেয়: লক্ষ্মী

র বয়স যখন ১৯, তখন আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পরে একদিন দিলীপ কুমার ও বৈজয়ন্তীমালা অভিনীত ছবি দেখাতে নিয়ে গেল আমাকে। ছবির একটি দৃশ্যে দেখা যায়, দিলীপ কুমার যাচ্ছেন বৈজয়ন্তীমালার কাছে। এ খবর শুনে বৈজয়ন্তীমালা যে কী খুশি, সেই দৃশ্যটির কথা আমি কোনোদিন ভুলব না।


ছবি দেখা শেষ করে আমি বললাম, ‘এ রকম করে যদি তুমি আমার কাছে আসতে পারতে বা এমন অভিনয় করতে, খুবই খুশি হতাম।’ সেদিন রাজ্জাক সাহেব শুধু হাসল।
এরপর একদিন হঠাৎ করেই বলল, ও কলকাতা ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাবে। আমার বাবা এ কথা শুনে রাজ্জাককে ডেকে বললেন, ‘তুমি আমার মেয়েটাকে এভাবে নিয়ে যাবে? যাওয়ার কী দরকার?’ তখন বাপ্পার বয়স মাত্র আট মাস। বাবার কথা শুনে রাজ্জাক সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে আপনি আপনার মেয়েকে রেখে দিন। আমি আমার ছেলেকে নিয়ে চলে যাব।’ আমার বাবা তখন বললেন, ‘না। তুমি যা চাইছ, তা-ই করো। তুমি যেখানে থাকবে, আমার মেয়েও সেখানে থাকবে।’
চলে এলাম নতুন দেশে, নতুন জায়গায়। রাজ্জাক সাহেব সারা দিন শুধু কাজের জন্য ছুটে বেড়ায়। আমি দেখেছি যে কীভাবে একজন মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য ছুটে বেরিয়েছে। এমনও দিন গেছে, তিন দিন, চার দিন মানুষটার কোনো খবরও নেই। তারপর একদিন এসে হাজির। দুই দিন থেকেই আবার চলে যেত। আমি ওকে কিছুই বলতাম না। কারণ, আমি চাইছিলাম, ও প্রতিষ্ঠিত হোক। একদিন এসে বলল, ‘আমি যদি সিনেমায় কাজ করি, তাহলে তুমি আপত্তি করবে না তো?’
আমি বললাম, ‘কেন আপত্তি করব? আমি তো চাই, তুমি ভালো কিছু করো।’ ও কাজ শুরু করল। একটার পর একটা ছবি। একদিন বলল, ‘দেখো, তোমার সহযোগিতা না থাকলে আমি রাজ্জাক হতে পারতাম না।’ কথাটা আমার খুবই ভালো লাগল।
রাজ্জাকের নাম তখন সবার মুখে মুখে। একদিন বললাম, তোমার সিনেমা দেখব। আমাকে নিয়ে আগুন নিয়ে খেলা ছবিটি দেখতে গেল, সিনেমা হলে। ছবি দেখে আমার চোখ ভিজে আসে। পরে বললাম, ‘কিছু কিছু জায়গায় তুমি আরও ভালো করতে পারতে।’ আমার সমালোচনাগুলো ভালোভাবেই নিল। রাজ্জাকের জনপ্রিয়তা তখন ভীষণ। একদিন শুটিং দেখতে নিয়ে গেল আমাকে। আমি বসে আছি। একজন এসে বলল, ‘ভাবি, নায়িকাকে যেভাবে রাজ্জাক জড়িয়ে ধরছে, এটাতে আবার কিছু মনে করবেন না।’ আমি উল্টো বললাম, আমার মনে এমন প্রশ্ন কি এসেছে? এটা তার কাজেরই অংশ। আমি যদি সে রকম কিছু মনে করি, তাহলে তো ও এই মাধ্যমে কাজই করতে পারবে না।
এ তো গেল কাজের কথা। এবার ব্যক্তিজীবন নিয়ে দুটি কথা বলি। আমার বিয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত আমরা এক দিনও কথা বন্ধ রাখিনি। ঝগড়াঝাটি হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে কোনো কারণে যদি দেখেছি যে রাজ্জাকের মুখটা ভার, আমি সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে হেসে বলেছি, ও কী তোমার মুখটা এত ব্যাজার কেন? রাজ্জাক হেসে দিয়েছে।
মানুষটার সঙ্গে আমি ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আছি। কোনো দিন দেখিনি যে সে অন্যের অমঙ্গল চেয়েছে। যদি কখনো শুনেছে যে কেউ তাকে মন্দ বলেছে, তবে সে হেসেছে। নিজের মধ্যে কোনো কষ্ট ধরে রাখত না। তাকে আমি প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে দেখিনি। শুধু বলত, ‘লক্ষ্মী, যে আমাকে মন্দ বলেছে, সে-ই একদিন আমাকে ভালো বলবে।’ হয়েছেও তা-ই।
আমার এখন তিন ছেলে, দুই মেয়ে। এক মেয়ে মারা গেছে। তিন ছেলের মধ্যে বাপ্পার সঙ্গে ওর বাবার দূরত্ব আছে। বাপ্পা কখনোই ওর বাবার কাছে কিছু চাইত না। এখনও মুখ ফুটে নিজের কোনো কথা বলে না। ছোট ভাই সম্রাট ওদের দুজনেরই দূত। ছোট ছেলেটার সঙ্গে বাবার খুবই ভাব। বাপ্পার মতো হয়েছে আমার ছোট মেয়ে ময়নাও।
রাজ্জাক যেমন রুপালি পর্দায় নিজেকে অনন্য এক স্থানে নিয়ে গেছে, তেমনি ভাবে তার ছেলে-মেয়েরাও তার বাবার আদর্শেই বড় হয়েছে। এটা আমার অনেক বড় পাওয়া। আমরা এখনো একান্নবর্তী পরিবার। তিন ছেলের বউ রাজ্জাকের কাছে যেন তিন মেয়ে। রাজ্জাক আসলে সব দিক থেকেই ভাগ্যবান একজন মানুষ। পেয়েছে মনের মতো ছেলেমেয়ে, পেয়েছে মনের মতো ছেলের বউ। এ কথা বললে সে বলে, ‘পেয়েছি আমি আমার লক্ষ্মীকে।’ রাজ্জাক বেঁচে থাকুক আরও অনেক অনেক বছর—এই শুভকামনাই করি।

No comments

Powered by Blogger.