জেলহত্যা দিবস-কতটুকু দুঃখ পেলে দুঃখগুলো প্রতিবাদী হয়ে ওঠে? by সিমিন হোসেন রিমি

মরা কয়েকজন নানা বয়সের বন্ধু নতুন কোনো লেখা, কোনো নতুন বই অথবা যেকোনো ভালো লাগার মতো কিছু পেলেই যতক্ষণ না নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পারছি, রীতিমতো অস্থির হয়ে থাকি। অবশ্য বিষয়গুলো যে সব সময় আনন্দের হয়, তা কিন্তু নয়। সত্যি বলতে, দৈনিক পত্রিকা থেকে যা পড়ে আমরা শেয়ার করি, তার বেশির ভাগই কষ্টের।


তবে কষ্ট থেকে যেসব চিন্তা আসে মনে, তা আশাবাদেরও জন্ম দেয়। আমাদের প্রচণ্ড আশাবাদী এবং সুস্থির এক বন্ধু আছে। সে নানা রকম উদাহরণ টেনে আনে সামনে। আমাদের স্বপ্নের বুনন থেমে থাকে না।
২৬ অক্টোবর প্রথম আলোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের বৈঠকের একটি খবর ছিল। সেই খবরের একটি লাইন ছিল: ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তার আশ্বাস দিয়ে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল বলেছেন, বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় সামরিক শাসকেরা থাকায় দেশটির কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি।’
খবরটির এটুকু কথা শত কথার জন্ম দিল মনে। যথারীতি এ বিষয়টি নিয়ে যখন কথা হচ্ছিল, আমার আশাবাদী বন্ধু আমাকে মনে করিয়ে দিল একটি যোগসূত্র। বইয়ের পৃষ্ঠা নম্বর পর্যন্ত বলে দিল, যেন আমি আবার পড়ি। আমি নতুন করে আবার পড়লাম। কথাগুলো ঠিক ৪০ বছর আগের—মুক্তিযুদ্ধকালের। মনে হয়, দিব্যদৃষ্টিতে দেখা কোনো অবলোকন। আসলে, বাস্তববাদী জ্ঞানী প্রখর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অনন্য এক মানুষের অঙ্ক কষা ফলাফল।
১৯৭১ সালে জয় বাংলা পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে এক রাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে ডেকে পাঠান। সেই রাতে তাঁদের যে কথা হয়, তা আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা থেকে তুলে ধরছি।
তাজউদ্দীন আহমদ: আপনাকে একটা কথা বলার জন্য ডেকেছি। শত্রু এখন বন্ধুর ছদ্মবেশে আমাদের ভেতরে ঢুকছে। এখন আমাদের আরও বেশি সাবধান হওয়া দরকার।...সবচেয়ে বিপদের কথা, সাহায্য দেওয়ার নাম করে এগিয়ে এসে টাকা ছড়িয়ে পাশ্চাত্যের কোনো কোনো দেশ আমাদের সরকারের মধ্যে তাদের শক্তিশালী গ্রুপ তৈরি করেছে এবং মুক্তিবাহিনী ও বুদ্ধিজীবীদের নানাভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলার জন্য চেষ্টা করেছে।...এই বিদেশিরা আমাদের মুক্তিবাহিনীর অফিসারদের সঙ্গেও গোপন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের তারা বোঝাচ্ছে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতারা অপদার্থ, অযোগ্য এবং ভারতের দালাল। এরা ক্ষমতায় গিয়ে ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে মোতায়েন রেখে রাজত্ব চালাবে। সুতরাং, বাঙালি অফিসারদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। অন্যদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে একটা মিটমাট হলে অটোনোমাস বাংলাদেশে বাঙালি অফিসাররাই হবে মিলিটারি চিফ ও হর্তাকর্তা। পাকিস্তানের মিলিটারি বাজেটের সিংহভাগ দেয় আমেরিকা। তার সমান ভাগ বাংলাদেশ আর্মিও পাবে। আর পাকিস্তান যদি ভেঙেই যায়, তাহলেও মুক্তিবাহিনীর অফিসারদের উচিত হবে, অযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সরিয়ে নিজেদের হাতেই ক্ষমতা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়া।...তৃতীয় বিশ্বে ফরেন এইড বা বিদেশি সাহায্য এবং তার রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে মার্কিন লেখকদেরই কয়েকটি লেখা আমি পড়েছি। এই লেখা পড়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমি শঙ্কিত। এদের অপারেশন হবে অনেকটা এ ধরনের—বাংলাদেশ মুক্ত হলে এরা বিপুল সাহায্যের অফার নিয়ে এগিয়ে যাবে এবং নিজেদের তত্ত্বাবধানে সাহায্য বিতরণ করতে চাইবে। সাহায্য যা পাওয়া যাবে, তার বারো আনা ব্যয় হবে তাদের তদারকিতে, সাহায্য প্রেরণের জাহাজ ভাড়ায় ও তাদের লোকজনের খরচ মেটাতে। কিন্তু বাইরে প্রচার হবে, বাংলাদেশে সাহায্যের বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছে। এই সাহায্য প্রকৃত অভাবী লোকদের হাতে পৌঁছাবে না। সাহায্যের টাকার দৌলতে সরকারি প্রশাসনে তাদের সমর্থক শক্তিশালী গ্রুপ তৈরি করা হবে। দেশপ্রেমিক অফিসার ও মুক্তিবাহিনীর লোকজনকে দুর্নীতিপরায়ণ করার চেষ্টা হবে। সরকারবিরোধী এবং সংশ্লিষ্ট বিদেশিদের সমর্থক রাজনৈতিক দল ও পত্রিকাকে টাকা দেওয়া হবে। সরকারি দলের মধ্যে নিজেদের গ্রুপ তৈরি করা হবে। সামরিক বাহিনীর আনুগত্য ও দেশাত্মবোধ নষ্ট করা হবে। তারপর বাংলাদেশের নতুন সরকার যদি এই বিদেশিদের কথামতো না চলে, তাহলে সব দুর্নীতি ও খারাপ কাজের দায়দায়িত্ব সরকারের কাঁধে চাপানো হবে। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণীকে বিক্ষুব্ধ করে তোলা হবে। এভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের জনপ্রিয়তা নষ্ট করার পর সিভিল অথবা মিলিটারি ক্যু ঘটিয়ে তাদের পছন্দমতো তাঁবেদার সরকার বসানো হবে।...মুজিব ভাই দেশে ফিরে কী করতে চাইবেন, আমি জানি না। যদি তিনি আমার কথা শোনেন, তাহলে এই বিপদও মোকাবিলা করা যাবে। (সূত্র: ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর, পৃষ্ঠা ১০২-১০৫, ঢাকা ১৯৯৪)
আজ ৩ নভেম্বর, জেল হত্যা দিবস। ৩৬ বছর আগে এই দিনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর বিনা অপরাধে জেলে বন্দী করে রাখা মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, প্রথম উপরাষ্ট্রপতি ও জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আরও দুজন জাতীয় নেতা এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে নির্মমভাবে গুলি করে ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয়। একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, লাখো মানুষের জীবনদান ও একাত্মতা এবং অবিস্মরণীয় নেতৃত্বের গুণে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে জন্মলাভের মাত্র তিন বছর ১০ মাসের মধ্যে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং জেলের ভেতর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ফলে সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারাই শুধু ব্যাহত হয়নি, দেশের চরিত্রটাও কেমন বদলে যায়। হয়তো তাই এখানে ৪০ বছরেও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন রাজনীতির বিকাশ ঘটে না।
আমি আজকের লেখার শিরোনামটি ধার করেছি প্রথম আলোর গত ২৭ অক্টোবর সংখ্যার চিঠিপত্র বিভাগের একটি চিঠি থেকে। সেই চিঠির শেষ লাইনটি ছিল: ‘আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, কতটুকু দুঃখ পেলে পদ্মার ভাঙন আসে অসহায় চোখের কিনারে; আর কতটুকু দুঃখ পেলে দুঃখগুলো প্রতিবাদী হয়ে ওঠে?’
ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন পৃথিবীতে তরুণদের সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতিবাদী হবে তরুণেরা। সুস্থ সমাজ, যোগ্যতাসম্পন্ন রাষ্ট্র নির্মাণে তারা এগিয়ে আসবে—এ বিশ্বাসে পথচলা যেন থেমে না থাকে।
সিমিন হোসেন রিমি: সমাজকর্মী।
simrim_71@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.