অসুন্দরের মভান by আতাউর রহমান

মাদের দেশের শিল্পের রকম-প্রকরণ নিয়ে সম্প্রতি আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছি। অর্থাত্ আমরা শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে যা করে চলেছি তা কি সত্যিকার অর্থে শিল্পচর্চারূপে স্বীকৃত হয়? বিনোদন শিল্পের প্রধান উপকরণ তা অনস্বীকার্য সত্য এবং পাশাপাশি একথাও সত্য যে শিল্পকে রুচিসম্মতভাবে রসমণ্ডিত হতে হয়।
শিল্প ও সাহিত্যের সব মাধ্যমের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি আমি প্রযোজ্য বলে মনে করি। আমি নিজে যে প্রয়োগ শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে বহু সময় ধরে জড়িত, আমার ধারণায় সে মাধ্যমটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে একটি সম্মানজনক স্থানে এসে পৌঁছেছে। আমার মাধ্যম হলো মঞ্চনাটক। দেশে-বিদেশে আমাদের নাট্যচর্চার গুণগত মান আজ স্বীকৃত। সম্প্রতি আমাকে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে আমাদের দেশের কিছু মূলধারার চলচ্চিত্র দেখতে হচ্ছে এবং এই চলচ্চিত্রগুলোর গুণগত মান আমাকে হতাশ করছে। আমার ধারণায়, আমাদের দেশে নির্মিত শতকরা ১৫ ভাগ চলচ্চিত্র সহনীয় এবং বাকি ৮৫ ভাগ অসহনীয়। চলচ্চিত্র একটি অর্থলগ্নিকারী শিল্পমাধ্যম হলেও এই মাধ্যমের শিল্পরূপকে আমরা একেবারে ভুলে যেতে পারি না। এই প্রয়োগ মাধ্যমে বর্তমানে প্যারালাল সিনেমা নামে কিছু নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র হচ্ছে। সেসব চলচ্চিত্র শুদ্ধধারার চলচ্চিত্র হিসেবে দেশে-বিদেশে কিছু স্বীকৃতি ও পুরস্কার পেয়েছে। তবে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প-সৃষ্টির ক্ষেত্রে এখনও বলার মতো কিছু অর্জন করতে পারেনি। নিরীক্ষার নামে যেসব চলচ্চিত্র হচ্ছে সেগুলোর বেশিরভাগই কাহিনীচিত্র না হয়ে কিছুটা কাহিনী এবং কিছুটা তথ্যচিত্র হয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি, চলচ্চিত্র কেবল দু’রকমই হয়, যথা ভালো চলচ্চিত্র ও মন্দ চলচ্চিত্র। পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই থাকে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা যখন দর্শক দ্বারা সর্বতোভাবে গৃহীত হয় তখন সেই চলচ্চিত্র সব মানুষের হয়ে যায়। দর্শকদের রুচিমাফিক ছায়াছবি নির্মাণ করা উচিত, এই বলে অনেক নির্মাতা রূপহীন ছায়াছবি বানিয়ে পার পেতে চান। যিনি শিল্পমাধ্যমে জড়িত আছেন, তার একটা সামাজিক দায়িত্বও থাকে যাতে করে দর্শকের রুচির উন্নয়ন ঘটে। এটা যদি ধরে নেয়া হয় যে দর্শক কেবল অশ্লীলতা, নাচ-গান ও মারামারি পছন্দ করে, তাহলে সেটা ভুল মনে করা হবে। আমরা অতীতে দেখেছি, জমজমাট কাহিনীসম্পন্ন কমার্শিয়াল ছবি অর্থকরী বাজারেও বিরাট সাফল্য অর্জন করেছিল। আমরা এখন জহির রায়হানের ‘কাঁচের দেয়াল’, সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’, খান আতার ‘সিরাজদ্দৌলা’র মতো ছায়াচিত্র দেখতে পাই না। এই বঙ্গের প্রথমদিককার ছায়াছবি ‘রাজধানীর বুকে’র মতো ভব্য চলচ্চিত্র এখন নির্মিত হয় না। পশ্চিমবঙ্গেরও একই হাল হয়েছে। উত্তম-সুচিত্রার বাণিজ্যিক পরিচ্ছন্ন ছায়াছবির মতো আজকাল ছায়াছবি হয় না। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর এমনকি আশির দশকেও চলচ্চিত্রের জোরের জায়গাটি ছিল একটি কাহিনী পরিচ্ছন্নভাবে পরিবেশন করা, তাতে কমবেশি অলীকের মিশ্রণ থাকলেও এমন দোষের মনে হতো না। এখনকার চলচ্চিত্রের বেশিরভাগই ফর্মুলা ছবি, অর্থাত্ এতটা নাচ থাকতে হবে, এতটা গান এবং এতটা ফাইটিং থাকতে হবে; তবেই না চলচ্চিত্র হবে। যারা তথাকথিত আর্ট কিসিমের চলচ্চিত্র বানাতে চান, সেগুলোও কেমন আরোপিত হয়ে যায়। সত্যজিত্ রায়, ঋত্বিক ঘটক, কুরোসাওয়া, মৃণাল সেন, রেঁনোয়া, অরসন ওয়েলস—এরা অন্য ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা। সবাই তো গ্রেট মাস্টার হন না এবং তা হওয়াটাও জরুরি নয়। চলচ্চিত্র পরিচ্ছন্ন মনোরঞ্জনকারী এবং সামান্য হলেও বক্তব্য সংবলিত হবে, এমনটা আমরা আশা করি।
অনেক দিন পর আমার কাজের প্রয়োজনে একটি বই আবার পড়া শুরু করলাম। অসাধারণ বই। নন্দন তত্ত্ব ও সৌন্দর্যবোধের ওপর লেখা প্রবন্ধাবলী সংকলন, পৃথিবীর অন্য ভাষায় এ ধরনের বই কম আছে বলে আমি মনে করি। বইটির রচয়িতা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নাম ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’। অবন ঠাকুরের শিল্পের বিভিন্ন রূপ ও সৌন্দর্যবোধ সম্পর্কে বিভিন্ন বক্তৃতামালা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪১ সালে বই আকারে প্রকাশ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃব্য। অবন ঠাকুর ছিলেন যথার্থ শিল্পগুরু ও শিল্পাচার্য। তার মতো অঙ্কনশিল্পী আমাদের ভূখণ্ডে বিরল। ১৯৫১ সালের ৫ ডিসেম্বর এই মহাপুরুষের দেহাবসান ঘটে। আমি মনে করি, শিল্পের বিভিন্ন শাখার যে কোনো সৃজনশীল মানুষ বইটি পড়ে দেখতে পারেন। মঞ্চনাটক ও চলচ্চিত্র-শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গরা এই বইটি পড়েন তাহলে তাদের অন্তর্গত সৃজনের দৃষ্টি খুলে যাবে। শিল্পের সচলতা ও অচলতা প্রবন্ধে অবন ঠাকুর আমাদের জানাচ্ছেন—‘শিল্প যে আনন্দ দেয় সে-ই আনন্দই তার ভাষা।’ সৌন্দর্যের সন্ধান প্রবন্ধে অবন ঠাকুর এক জায়গায় বলছেন, ‘আমাদের দেশ যখন বলল—সুন্দর মানুষ গড়ো না, সুন্দর করে দেবমূর্তি গড়ো সেই ভালো, ঠিক সেই সময় গ্রিস বলল—না, মানুষকে করে তোল সুন্দর প্রায়দেবতা কিংবা দেবতাকে করে তোল প্রায়মানুষ!’ এই উদ্ধৃতি আমাদের শিল্পের রকম-প্রকরণ সম্পর্কে কিছুটা হলেও সজাগ করে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘অসুন্দর’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন, যা ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’র অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই প্রবন্ধের এক জায়গায় অবন ঠাকুর বলছেন, ‘অসুন্দরের একটা ভান থাকে, সুন্দরের কোনোরূপ ভান থাকে না—এটা লক্ষ্য করা গেছে। মিথ্যার আবরণে অসুন্দর নিজেকে আচ্ছাদন করে আসে, সুন্দর আসে অনাবৃত—সত্যের ওপর তার প্রতিষ্ঠা।’
আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের, আমাদের মঞ্চনাটক নির্দেশকদের, এক কথায় ফাইন আর্টস এবং পারফরমিং আর্টসের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব ব্যক্তির মনে রাখা উচিত, সহজিয়া ও নিরাভরণ আচরণের ওপর সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠা ঘটে। কিছু কিছু দুরূহ শিল্প কাজ মানুষের অনুমোদন পেয়েছে, মাঝে মাঝে শ্রেষ্ঠ হিসেবেও বিবেচিত হয়েছে; কিন্তু সেগুলোকে আমরা ব্যতিক্রম হিসেবে গণ্য করি। যে কোনো শিল্প কাজের দ্যোতনা হবে সহজ ও সুন্দর।
লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক

No comments

Powered by Blogger.